সন্দ্বীপ টাউনে সভা সমাবেশ ও ক্রস বাঁধ (৩)
রোদনে ভরা এই সন্দ্বীপ! রোদনে ভরা এই সন্দ্বীপের ক্রসবাঁধ! রোদনে ভরা এই সন্দ্বীপের ৫৯২ বর্গ কিলোমিটারের সীমানা!
বর্ষায় থৈ থৈ পানিতে ডুবে যায় বাংলাদেশের নদী। বর্ষার কিছু দিন পর সন্দ্বীপের উপকূলীয় অববাহিকায় পানির প্রবাহ একেবারেই কমে যায়। হয়তো একুল থেকে অকুল দেখা যাবে। এক সময় সারা বছরই পানি থাকতো এই সন্দ্বীপের উপকূলীয় অববাহিকায়। গত দশক থেকে স্রোত কমে যাচ্ছে। নদীগর্ভে কয়েক’শ কিলোমিটারের উঁচু চর জেগে উঠেছে সন্দ্বীপের সীমানায়।
বাংলাদেশে ১৯৬০ এর দশকে ৭৫০ টি নদী ছিল। বর্তমানে এ সংখ্যা কমে মাত্র ২৩০ টি নদীতে দাঁড়িয়েছে। ৫০ বছরে হারিয়ে গেছে ৫২০ টি নদী। ২৩০ নদীর মধ্যে ৫৯ টি আন্তর্জাতিক। এগুলোর মধ্যে ৫৪ টি ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এসব নদীর উৎসমুখে বিভিন্ন স্থানে ব্যারেজ নির্মাণ কিংবা পানির প্রবাহে বাধা দেওয়ায় বাংলাদেশে ঢোকার পর এসব নদীতে পানির পরিমাণ একেবারেই কমে যায়। শুকনো মৌসুমে এসব নদীতে পর্যাপ্ত পানি থাকে না। ফলে বদলে যাচ্ছে নদীগুলোর গতিমুখ, শুকিয়ে মরে যেতে যেতে দেশের মানচিত্র থেকেই হারিয়ে যাচ্ছে একের পর এক নদী। নদী হারিয়ে যাওয়া পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীব বৈচিত্রের জন্য হুমকি স্বরূপ।
ভারত থেকে আসা ৫৪ টি আন্তর্জাতিক নদী থেকে ৫৩ টি নদীর পানির প্রবাহ ভারতের রাজস্থান পর্যন্ত নিয়ে যাবে ভারত। ভারতের পরিকল্পনা হলো ভারতের সর্বত্র পর্যাপ্ত পানি ও ফসলের জন্য সেচ ব্যবস্থার নিশ্চিত করা। ফলে আমাদের বর্ষার পানি প্রিজার্ভ করে আমাদের পানির যোগান নিশ্চিত করতে হবে। পানি ধারণের জন্য ড্রেজিং, নদীর দু’কূলে কংক্রিট ঢালাই করা ও শুষ্ক মৌসুমের জন্য পানি সংরক্ষন ও বর্ষা মৌসুমে দেশের নিম্ম ভূমিতে বন্যা রোধ করতে হবে। এই গুলো হলো নদী শাসনের মূল উদ্দেশ্য। আর এইগুলো করতে হলে দেশের অভ্যন্তরীন নদীগুলোতে ক্রসবাঁধ ও স্লুইস গেইট নির্মাণ করা অপরিহার্য হয়ে পড়বে।
পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর বড় বড় শহরগুলোতে নদীর পানিতে প্লাবিত হতো। তাই তারা নদীর দু’পাশ কংক্রিট ঢালায় করে বেঁধে ফেলে। আর এই ভাবে প্রথিবীর বড় বড় শহরগুলো নদীর দু’ধারে শহর গড়ে উঠেছে। আমাদের দেশে নদী শাসনের অভাবে নদীর একধারে শহর গড়ে উঠেছে। ফলে শহর বন্দরের সুবিধা ও আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক- ব্যবসায়িক সভ্যতা থেকে আমরা পিছিয়ে পড়েছি বৈকি!
১৯৫০ এর দশকে হল্যান্ডের ড্যানহ্যাগের সফল বাঁধ নির্মাণের পর সন্দ্বীপের ভাঙ্গন রোধে ক্রসবাঁধের প্রস্তাব ও দাবি উঠে। হল্যান্ডের অপর নাম নেদারল্যান্ড। নেদারল্যান্ডের অর্থে হলো নাইদারল্যান্ড অর্থাৎ দেশ ছিল না। প্রযুক্তির মাধ্যমে নদী ও ভূমি উদ্ধার করেছে ডাচরা। বর্তমানে প্রযুক্তি ব্যবহার করে পৃথিবীর অনেক দেশ ভূমি উদ্ধার ও পুনরুদ্ধার করছে। তাই দেশের সকল সরকার সন্দ্বীপের ক্রসবাঁধের এই দাবি যৌক্তিক বলে মনে করে ও বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেয়। পরবর্তীতে এইসব প্রতিশ্রুতিগুলি আমাদের দক্ষ নেতৃত্বের অভাবে অন্যত্র বাস্তবায়ন হতে থেকে। সন্দ্বীপ শহর যখন নদী গর্ভে পতিত হচ্ছিল; তখন সন্দ্বীপ টাউনে ক্রসড্যাম নির্মাণের জন্য যারপরনাই আন্দোলন ও দাবি পেশ করা হয়েছিল, ২ সপ্তাহ অসহযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু আমাদের দাবি পূরণ হয়নি। চাঁদপুর শহর রক্ষার দাবি পূরণ হয়েছিল। দাবি পূরণ করেছিলেন ওই সময়ের প্রধান মন্ত্রী (জুলাই ৯, ১৯৮৬ – মার্চ ২৭, ১৯৮৮) মিজানুর রহমান চৌধুরী। চাঁদপুরে বাড়ি তার।
১৯৫০ এর দশক থেকে আমাদের ক্রসবাঁধ বাস্তবায়নের মত অর্থ পাকিস্তানের ছিল। ১৯৬০ সালে পাকিস্তান জার্মানিকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ দেয়। ওই সময় যুদ্ধে বিধস্ত ও পরাজিত জার্মানিকে সাহায্যের জন্য পাকিস্তান এগিয়ে আসে। শুনেছি মাত্র ১৫ কোটি টাকা ব্যয় হতো সন্দ্বীপের ক্রসড্যাম নির্মাণ করতে। ১৯৫০ দশকে সন্দ্বীপের ক্রসড্যাম নির্মিত হলে আমাদের এত বিপুল সংখ্যক মানুষ নদী ভাঙ্গনের শিকার হতো না।
১৯৬০ এর দশকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান সন্দ্বীপে এসেছিলেন। সন্দ্বীপ হাই স্কুলের মাঠে এক বিরাট জনসভায় উনি বক্তৃতা করেছিলেন। আমি ওই জনসভায় উপস্থিত ছিলাম। সভা শেষে সৈনিকরা প্রেসিডেন্টের জন্য রাস্তা ক্লিয়ার করতে গিয়ে জনস্রোত সামলানোর সময়ে আমি হারিয়ে যায়। পরে আবার রাস্তা চিনতে পেরে পোলঘাটের বাসায় নিরাপদে আসতে পেরেছি। আম্মা বেশ চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন। যাহোক, ভাগ্যিস! তখন সন্দ্বীপে রোহিঙ্গা ‘হোলা ধরা’ ছিল না। এই রোহিঙ্গারা এক সময় সন্দ্বীপে হোলা ধরে বিক্রি করে দিতো পূর্তগীজ ও মগদের কাছে।
১৯৫০ এর দশকে সন্দ্বীপের ৩ টি দাবি উল্লেখ করার মত ছিল। সন্দ্বীপের ভূখণ্ডের জন্য ক্রসবাঁধ, মূলভূমি চাটগাঁয়ের সাথে স্থল পথে যাতায়াতের জন্য গুপ্তচরা – কুমিরা সেতু ও আকাশ পথে এয়ারপোর্ট। এয়ারপোর্টের জন্য পূর্ব হরিশপুরে জমি একোয়ার করা হয়েছিল। পরিকল্পনা এমন ছিল যে, সন্দ্বীপ টাউন নদী ভাঙ্গনে পতিত হবার আগেই ক্রসবাঁধ বাস্তবায়ন করা হবে। সে জন্য টাউনের স্থাপনাগুলো পর্ব হরিশপুরে নির্মিত হচ্ছিল। ইতোমধ্যে সিও, ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসসহ কয়েকটি অফিস বিল্ডিং নির্মিত হয়ে গিয়েছিল।
আমরা ১৯৬০ এর দশক থেকে শুনে আসছিলাম যে, অচিরেই ক্রসবাঁধ নির্মিত হবে। ক্রসবাঁধ নির্মাণে স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে কাজ করার সুযোগ থাকবে। স্বেচ্ছাসেবী হবার ধারণাটা আসছে ১৯৪৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বরে। ওই দিন সরলীকরণ করার জন্য খাল কাটার নির্ধারিত দিন ছিল । চট্টগ্রামের রাউজান ও ফটিকছড়ির মধ্য দিয়ে বয়ে চলা হালদা নদীর বাঁকের কারণে বন্যার শিকার হতে হতো এলাকাবাসীর। এলাকাবাসীরা কয়েকটি বাঁকে খাল কেটে নদীর গতিপথকে সোজা করতে চেয়েছিলো। অন্যদিকে সরকারের সেচ বিভাগের আগ্রহ ছিল ব্যয়বহুল ড্রেজারে ও নদী শাসনের কর্তৃত্ব নিজেদের হাতেই রাখা। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে ফসলের ক্ষতিতে আগ্রহী ছিল না এলাকাবাসী। তাই এলাকাবাসি ডাক ঢোল পিটিয়ে কোদাল ও খন্তা দিয়ে খাল কাটার জন্য জমায়েত হয় ও ৩ টি খাল কেটেও ফেলে।
পরবর্তীতে আমি জানতে পারি যে, ওই এলাকাবাসীর স্বেচ্ছাসেবী গণজমায়েতে প্রায় চল্লিশ হাজার মানুষ নিজেদের ফসলহানি থেকে রক্ষা করতে একত্র হয়েছিল। প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে। জনগণ তা বুঝতে পারেনি কেন ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে স্বেচ্ছাশ্রমের বিরুদ্ধে। প্রশাসন গুলি চালায়, ১০ জন নিহত হন ও ২২ জনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতলে ভর্তি করা হয়েছিল। ১৯৪৮ সালের সদ্য স্বাধীন দেশে গ্রামের নিরহ জনগণের উপর গুলি চালিয়েছিল; যা আজ আমাদের স্মৃতি থেকে মুছে গেছে। আমাদের সরকারগুলো আজ পর্যন্ত রাষ্ট্রের নিরাপত্তার নামে গণস্বার্থের চেয়ে জনপ্রতিনিধি, আমলা ও বহুজাতিক পুঁজির স্বার্থকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে তাদের স্বার্থ রক্ষা করেছে। জনগণের স্বার্থকে সরকার দেখছে কিনা; তা আপনিও ভালো বলতে পারবেন।
আমার মনে হয়, ওই হালদা নদীর বাসিন্দাদের আত্মত্যাগের স্মৃতিতে কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রবিবার থেকে ‘বিশ্ব নদী দিবস’ হিসেবে পালন করতে শুরু করে। ২০০৫ সালে জাতিসংঘ নদী রক্ষায় জনসচেতনতা তৈরি করতে ‘জীবনের জন্য জলদশক’ ঘোষণা করেছিল। সেই থেকে সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রবিবার ‘বিশ্ব নদী দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশে ২০১০ সাল থেকে এ দিবস পালিত হচ্ছে।
বর্তমানে বৈশ্বিক উষ্নতা সন্দ্বীপের ৫৯২ বর্গ কিলোমিটারের সীমানাভুক্ত সন্দ্বীপের উপকূলকে একটি ভয়াবহ প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের উপকূলের জোয়ারে উচ্চতাও বাড়ছে। ফলে একমাত্র সমাধান নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্বি আর জমিতে পলি জমতে দিয়ে ভূমির গঠন প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হবে। সে হিসেবেও ক্রসবাঁধ ও উপকূলীয় অববাহিকা সম্বন্ধে সরকার নতুনভাবে ভাবতে হবে।
সন্দ্বীপের নদী ভাঙা মানুষের কষ্ট। রোদনেও কষ্ট তাদের। বাস্তুভিটা হারানোর কষ্ট। কবি হেলাল হাফিজের ‘ফেরিওয়ালা’ কবিতায় মানুষের কষ্টকে এই ভাবে তুলে এনেছেন-
কষ্ট নেবে কষ্ট
হরেক রকম কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট।
লাল কষ্ট নীল কষ্ট কাঁচা হলুদ রঙের কষ্ট
পাথর চাপা সবুজ ঘাসের সাদা কষ্ট,
আলোর মাঝে কালোর কষ্ট
মাল্টি কালার কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট।
ঘরের কষ্ট পরের কষ্ট পাখি এবং পাতার কষ্ট
দাড়ির কষ্ট
চোখের বুকের নখের কষ্ট,
একটি মানুষ খুব নীরবে নষ্ট হবার কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট।
প্রেমের কষ্ট ঘৃণার কষ্ট নদী এবং নারীর কষ্ট
অনাদর ও অবহেলার তুমুল কষ্ট,
ভুল রমণী ভালোবাসার
ভুল নেতাদের জনসভার
তাসের খেলায় দুইটি জোকার নষ্ট হবার কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট।
দিনের কষ্ট রাতের কষ্ট
পথের এবং পায়ের কষ্ট
অসাধারণ করুণ চারু কষ্ট ফেরীঅলার কষ্ট
কষ্ট নেবে কষ্ট।
আর কে দেবে আমি ছাড়া
আসল শোভন কষ্ট,
কার পুড়েছে জন্ম থেকে কপাল এমন
আমার মত ক’জনের আর
সব হয়েছে নষ্ট,
আর কে দেবে আমার মতো হৃষ্টপুষ্ট কষ্ট।
সন্দ্বীপের মানুষের কষ্ট দূর করতে হলে উদ্ভাবিত আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে অবাধ জোয়ার ভাটার কার্যক্রম চালু রেখে নদীগুলোকে প্রবাহ ফিরিয়ে দেয়া ও সন্দ্বীপের ৫৯২ বর্গ কিলোমিটারের চরগুলোতে সন্দ্বীপীদের বসতি স্থাপন করতে তাদের ফিরিয়ে দেয়া।
১৯৪৮ সালে গ্রামের নিরহ জনগণের উপর ও হালদা নদীর জলবায়ু উদ্বাস্তুদের উপর গুলি চালিয়েছিল। স্বাধীনতা ও মুক্তির প্রায় ৫০ বছর পর আরেকটি হালদা নদী দেখতে চাই না। ব্রত হোক জনস্বার্থের, কল্যাণীয় ভূমিপুত্রদের।
[এ লিখাটি বা পর্বটি ওরাল হিস্ট্রি বা স্মৃতিকথন, ইতিহাস নয়। তবে ইতিহাসবিদরা এই লিখা বা পর্বগুলো থেকে তথ্য-উপাত্তগুলো গবেষণার জন্য সূত্র বা রেফারেন্স উল্লেখপূর্বক এবং সোশ্যাল মিডিয়া ও অনলাইন নিউজ পোর্টালে শেয়ার করতে হলে পূর্ব অনুমতি নিয়ে উদ্ধৃতি বা লেখকের টাইম লাইন থেকে শেয়ার করতে পারবেন। গবেষক ছাড়া অন্যরা পর্যালোচনা এবং প্রবন্ধ লেখার ক্ষেত্রে উদ্ধৃত করতে হলে লিখিত অনুমতি ব্যতিরেকে, আংশিক বা সম্পূর্ণ কোন ধরণের অনুলিপি করা যাবে না। বাংলাদেশ ও আর্ন্তজাতিক কপিরাইট আইন দ্বারা লেখক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। লিখিত অনুমতির জন্য ইমেইল: sandwip21st@gmail.com]
স্মৃতিকথনে: শিব্বীর আহমেদ তালুকদার
আইনজীবী, সমাজ সংগঠক ও কথ্য ইতিহাস গবেষক।
sandwip21st@gmail.com