নিজস্ব প্রতিবেদক সিলেট থেকে
ভারতে খাসিয়াদের হাতে আটক সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ও বরখাস্তকৃত উপ-পরিদর্শক (এসআই) আকবরকে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয়দের সহযোগিতায় সাদা পোশাকের পুলিশ আটক করেছে বলে জেলা পুলিশ দাবি করেছে।
সোমবার সন্ধ্যায় আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সিলেটের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন এই দাবি করেন।
পুলিশ সুপার বলেন, ‘গত ২৬ দিন ধরে আকবরকে আটকের চেষ্টা করছে পুলিশ। গত রাতে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায় যে সোমবার সে কানাইঘাট সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালানোর চেষ্টা করবে তাই কানাইঘাট ও জকিগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে সীমান্তে নজরদারি বাড়ানো হয়। তারাই আকবরকে আটক করেন।’
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে আকবরের বক্তব্য বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা আটকের আগে কেউ এরকম ভিডিও বানিয়েছে কিনা তা আমরা বলতে পারবো না। তবে জেলা পুলিশ কোনো ভিডিও বানায়নি। আর আমরা সবসময়ই আসামি গ্রেফতারে সাধারণ মানুষের সহযোগিতা নেই, এখানেই কিছু বিশ্বস্ত বন্ধু আমাদের সহযোগিতা করেছেন।’
তবে, পুলিশ ভারতীয় খাসিয়া জনগোষ্ঠীর সহযোগিতা নিয়েছিলো কী না সে বিষয়ে কিছু বলতে চাননি তিনি। এ ছাড়াও, আকবর ভারতে পালিয়ে গিয়েছিলো কী না এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘হতে পারে সে ভারতে পালিয়ে গিয়েছিলো। বাংলাদেশে ঢুকতে গিয়েই সীমান্তে আটক হয়েছে। অথবা যে ভারতে যাওয়ার সময় আটক হয়েছিলো। তবে এটুকু আমরা বলতে পারি যে সিলেট জেলা পুলিশের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানেই তাকে আটক করা হয়েছে।’
এদিকে বরখাস্ত এসআই আকবর হোসেন ভুইয়াকে আটকের পর তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। সোমবার রাত ৮টার দিকে তাকে সিলেট পুলিশ সুপার কার্যালয়ে পিবিআইয়ের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হয় বলে সাংবাদিকদেরকে জানিয়েছেন পিবিআই সিলেটের বিশেষ পুলিশ সুপার মুহাম্মদ খালেদ-উজ-জামান।
আকবরের আটকের পর বেশ কিছু ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে যাতে আকবর ও তাকে আটক করা ব্যক্তিদের কথাবার্তায় পরিষ্কার বোঝা যায় যে তারা ভারতীয় অংশের খাসিয়া জনগোষ্ঠী।
একটি ভিডিওতে আকবরকে বাংলাদেশি নাগরিকদের কাছে হস্তান্তর করা হচ্ছে তাও নিশ্চিতভাবে দেখা যায়। এ সকল ভিডিওতে বিভিন্ন জিজ্ঞাসাবাদে আকবরও বলে যে, সে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়েছিলো।
আকবরকে আটকের ব্যাপারে জানতে সোমবার দুপুরে এক ইংরেজি দৈনিকের সাংবাদিকের কথা হয় মামলার তদন্তকারী প্রতিষ্ঠান পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর বিশেষ সুপার মুহাম্মদ খালেদ-উজ-জামান ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এর ১৯ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়ন এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাঈদ হোসেনের সঙ্গে। তখন পিবিআইয়ের সুপার ঐ সাংবাদিককে বলেন, ‘আকবরকে ভারতে খাসিয়ারা আটক করে বাংলাদেশ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে। জেলা পুলিশের সুপার বিষয়টি জানিয়েছেন। তবে কী প্রক্রিয়ায় তাকে হস্তান্তর করা হয়েছে তা জানা নেই।’
১৯ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক একই সাংবাদিককে বলেন, ‘আকবরকে ভারত সীমান্তের অভ্যন্তরে খাসিয়ারা আটক করেন। পরে তারা সীমান্ত এলাকার আব্দুর রহিম নামের এক বাসিন্দার সঙ্গে যোগাযোগ করে সীমান্তেই আকবরকে তার হাতে তুলে দেন। আব্দুর রহিমই পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে আকবরকে পুলিশে হস্তান্তর করে।’
তিনি বলেন, ‘এটি সীমান্তের একটু দুর্গম এলাকা। আর বিএসএফ বা আমরা বিষয়টি জানার আগে স্থানীয়রাই হস্তান্তর করে ফেলেছেন’।
এদিকে আটকের পর খাসিয়াদের জেরার মুখে আকবর জানান, সিনিয়র এক অফিসারের কথায় তিনি পালিয়ে যান।
তিনি বলেন, ‘আমাকে এক সিনিয়র অফিসার বলছিল, তুমি এখন চলে যাও। দুই মাস পরে আইসো। তখন মোটামুটি ঠান্ডা হয়ে যাবে।’
আকবর আরো বলেন, ‘ইন্ডিয়ার একটা পরিবার বলছিলো তুমি এদিকে এসে থাকো এখানে। মাঝেরগাঁও ভোলাগঞ্জ দিয়ে গিয়েছি।’
মাঝেরগাঁও ভোলাগঞ্জ সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার একটি এলাকা। আকবর তার আত্মীয় ও এই উপজেলার এক সাংবাদিক আবদুল্লাহ আল নোমান এবং স্থানীয় হেলাল উদ্দিনের সহযোগিতায় এ সীমান্ত দিয়েই ভারতে যান বলে পুলিশের বিভিন্ন সূত্রে আগে জানিয়েছিলো।
আকবরকে পালিয়ে যেতে কারা সহযোগিতা করেছিল তা তদন্তে পুলিশ সদরদপ্তরের একটি বিশেষ তদন্ত দল গঠন করা হয় গত ১৯ অক্টোবর।
পরদিন থেকে সিলেটে তদন্ত কাজ শুরু করে তদন্ত দল। পরে আকবরকে পালাতে সহযোগিতার কারণে ২১ অক্টোবর বন্দরবাজার ফাঁড়ির আরেক উপ-পরিদর্শক হাসান উদ্দিনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
এদিকে, হেলাল উদ্দিনকে অবৈধ পাথর উত্তোলনের একটি মামলায় গত ২২ অক্টোবর গ্রেপ্তার করে কোম্পানীগঞ্জ থানা পুলিশ। তবে তাকে আকবরকে পালাতে সহযোগিতার ব্যাপারেও জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ।
গতকাল সন্ধ্যায় আয়োজিত প্রেস কনফারেন্সে পলাতক নোমানকে আটকের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে সিলেটের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন বলেন, ‘নোমানকে আটক করতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে। যেহেতু আকবরকে আটক করা গেছে, এখন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে দ্রুতই নোমানের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে।’
এদিকে প্রেস কনফারেন্স চলাকালে পুলিশ সুপার কার্যালয়ের বাইরে বিক্ষুব্ধ জনতাকে ‘ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই, আকবরের ফাঁসি চাই’ স্লোগান দিতে দেখা গেছে। সন্ধ্যা পৌনে ৬টায় কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে আকবরকে পুলিশ সুপার কার্যালয়ে আনা হয়। এর আগে আকবরকে সিলেটে নিয়ে আসার খবরে বিক্ষুব্ধ জনতার ঢল নামে সিলেটের কোর্ট পয়েন্ট এলাকাসহ পুলিশ সুপার কার্যালয় এবং বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির আশপাশের এলাকায়।
নিহত রায়হান আহমদের মা সালমা বেগম সাংবাদিকদেরকে বলেন, এতদিন পর আকবরকে গ্রেফতার করা হল। তবুও আমার মন কিছুটা শান্তি পেয়েছে। তিনি বলেন, আকবরকে কিন্তু পুলিশ, পিবিআই কেউ গ্রেফতার করেনি। তাকে আটক করেছে জনগণ। এজন্য আমি জনগণকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। কারণ তারা বুঝতে পেরেছেন সন্তানহারা মায়ের আকুতি। তাই তারা আকবরকে আটক করেছেন। এখন আমার দাবি, আকবরকে পুলিশ, পিবিআই কারও কাছে হস্তান্তর না করে যেন তাকে র্যাবের কাছে দেয়া হয়।
১০ অক্টোবর মধ্যরাতে রায়হানকে নগরীর কাষ্টঘর থেকে ধরে নিয়ে যায় বন্দরবাজার ফাঁড়ি পুলিশ। পরদিন ১১ অক্টোবর সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে তাকে গুরুতর আহত অবস্থায় ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন ফাঁড়ির এএসআই আশেকে এলাহী। সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে হাসপাতালে মারা যান রায়হান। এ ঘটনায় তার স্ত্রী হত্যা ও হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইনে থানায় মামলা করেন। এরপর তদন্ত সাপেক্ষে ফাঁড়ি ইনচার্জ এসআই আকবরসহ চার পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত এবং তিনজনকে প্রত্যাহার করা হয়।
শেষ পর্যন্ত প্রতিবেশি দেশের সীমান্তবর্তী মানূষ আকবরকে আটক করলেন।