সন্দ্বীপ টাউনে সভা সমাবেশ ও ক্রস বাঁধ (৪)
সন্দ্বীপের ক্রসবাঁধ দাবি পূরণ হয়নি। সন্দ্বীপ-কোম্পানীগঞ্জ ক্রসবাঁধের আলোচনা চলেছে ১৯৬৬ সাল থেকে। প্রায় ৬ দশক, ৬০ বছরের কাছাকাছি সময় ধরে শুধু আলোচনা চলেছে। এক দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনা, প্রায় ২-৩ প্রজন্ম কাল। এই দীর্ঘ সময়ে সন্দ্বীপের কোনো দাবি পূরণ হয়নি। ১৯৫০ এর দশক থেকে ৮০’র দশক পর্যন্ত একটু একটু করে কষ্টের রক্ত জমাট বাঁধতে শুরু করে। জনমনে ক্ষত সৃষ্টি হতে থাকে। ক্রসবাঁধ নিয়ে সন্দ্বীপীদের মনের ক্ষত না শুকাতে শহর রক্ষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল। শহরেরও শেষ রক্ষা হলো না। তলিয়ে গেলো অথৈ জলে – সেই চির চেনা টাউন, সন্দ্বীপের ৫-৭ শত বছরের ঐতিহ্য সমৃদ্ধ ও বহু কালের সাক্ষী এই টাউন।
১৯৮৬ সালের সন্দ্বীপের অধুনালুপ্ত টাউনে ক্রসবাঁধ বাস্তবায়নের জন্য দাবি আদায়ের আন্দোলন শক্তিশালী হয়েছিল। সন্দ্বীপের আপামর জনগণের স্বতুস্ফূর্ত সমর্থন ছিল তাতে। টাউনের সকল বাসিন্দা সময় দিয়েছে ও মিছিল সমাবেশ করেছেন ওই সময়। ফলে ক্রসবাঁধ বাস্তবায়নের প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়েছিল সরকারি পর্যায়ে, যা ১৯৮৮ সালে শুরু হয়ে ১৯৯২ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল। বার বার আশ্বস্ত করা হয়েছে সন্দ্বীপবাসীকে। সন্দ্বীপের মানুষের মনে হয়েছিল যে, এই বুঝি ক্রসবাঁধ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ক্রসবাঁধ আজও হয়নি। সন্দ্বীপবাসীর বাঁচার দাবি কোনোদিনই বাস্তবায়িত হয়নি।
সন্দ্বীপের উপকূলে চর জেগেছে বলে ক্রসবাঁধের প্ৰয়োজনীয়তা পুড়িয়ে যায়নি। ক্রসবাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে ভাসান চর – সন্দ্বীপ – উড়ির চর – কোম্পানীগঞ্জ (নোয়াখালী) এর মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। সন্দ্বীপে অর্থনৈতিক শিল্প জোন হচ্ছে, তাই শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে উৎপাদিত পণ্য বিপণনের জন্য কাঁচামাল ও ফিনিশিং গুডস আমদানি ও রপ্তানির জন্য ক্রসবাঁধের মাধ্যমে ঢাকা ও ঢাকার অদূরে শিল্প-কারখানা ও অর্থনৈতিক জোন থেকে সন্দ্বীপের সাথে সরাসরি যোগাযোগ জরুরি হয়ে পড়েছে।
অন্যদিকে মিরেরসরাইয়ের বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক জোনের উৎপাদিত পণ্য বিপণন ও কাঁচামাল আমদানি ও রপ্তানি করতে সন্দ্বীপ-চট্টগ্রাম সেতু নির্মাণ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। তাছাড়া নদী পথে উত্তর বঙ্গ, যেমন সুদূর রংপুরসহ অন্যান্য অঞ্চলের অর্থনৈতিক জোন ও বিসিক শিল্প কারখানার মালামাল ও উৎপাদিত পণ্য বিপণন ও কাঁচামাল আমদানি ও রপ্তানি করতে ভাসান চরে নৌবন্দর নির্মাণ করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে পণ্য আমদানি ও রপ্তানির জন্য জেটি নির্মাণ করা হলে পণ্য সরবরাহের খরচ কমবে, পণ্য মূল্যও কম হবে। সন্দ্বীপ হবে বহির্বিশ্বের সাথে আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে এক অর্থবহ অর্থনৈতিক গেইট ওয়ে।
সন্দ্বীপের নিয়ামস্তি ইউনিয়ন ভেঙ্গে গিয়ে গড়ে উঠেছে ভাসানচর। স্থানীয়ভাবে ঠেঙ্গারচরও বলা হতো। গুগল ম্যাপে ভাসানচরকে চরপিয়া দেখানো হয়েছে। আসলে ভাসানচরের প্রকৃত মালিক সন্দ্বীপবাসী। সন্দ্বীপের বাংলা বাজার ঘাট দিয়ে ভাসানচরে স্পিডবোটে বা ট্রলার বা নৌকায় করে যাওয়া আসা যাচ্ছে। ট্রলারে সময় লাগে প্রায় আধা ঘণ্টা। অন্য দিকে হাতিয়ার নলচিরা ঘাট থেকে ভাসানচরে যেতে ট্রলারে প্রায় ৩ ঘণ্টা সময় লাগে।
প্রশাসনিক অদক্ষতার জন্যে সন্দ্বীপের পয়স্তি ভূমি ভাসানচরকে হাতিয়ার অন্তর্ভুক্ত বলে উল্লেখ করেছে। এ ব্যাপারে হাইকোর্টে রিট হয়েছে। ভাসানচর সন্দ্বীপের অতি নিকটবর্তী সন্দ্বীপের পয়স্তি মূল ভূখন্ড। নদী সিকস্তি আইন ও বিধান অনুযায়ী ভাসানচর সন্দ্বীপের অংশ। কিন্তু প্রভাবশালীদের চাপে জোরপূর্বক ভাসানচরকে হাতিয়ার অংশ দেখানো হচ্ছে। সন্দ্বীপীদের পক্ষে প্রভাবশালীদের কেউ নাই। এখন সন্দ্বীপীদের উদ্যোগ নিতে হবে । নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সন্দ্বীপের নদী ভাঙা মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসতে হবে।
প্রায় ১২ লক্ষ সন্দ্বীপীদের মধ্যে ৮ লক্ষ সন্দ্বীপী নদী ভাঙ্গনের কবলে পতিত হয়ে কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। সন্দ্বীপের নদীর কূলবর্তী ভেড়িবাঁধে কোনভাবে অস্থায়ীভাবে দিন কাটাচ্ছে। অনেকের কোনো বাসস্থান, কোনো শিক্ষা, কোনো স্বাস্থ্য সেবা নাই। এককালের ঘর বাড়ি থাকা পরিবারগুলো এখন দেশে বিদেশে মানবেতর জীবনযাপন করছে; তাদের দেখার কেউ নেয়। নদী ভাঙ্গনের শিকার মানুষগুলোর কথা প্রশাসন সেভাবে ভাবছে না।
সরকার সারাদেশে অসহায় মানুষের আবাসন করে কর্মসংস্থান করে দিচ্ছে। এমনকি রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের পরিকল্পনা করছে। ঠিক তেমনি সন্দ্বীপের নদী ভাঙ্গনের শিকার মানুষদের সন্দ্বীপের জেগে উঠা চরে আবসানের ব্যবস্থা করছে না। স্বর্ণদ্বীপ ও ভাসানচরসহ অন্যান্য স্থানে নদী ভাঙ্গনজনিত সন্দ্বীপের মানুষের আবসানের ব্যবস্থা করা ও তাদের ভেঙে যাওয়া জমি জমা ফিরিয়ে দেয়া এখন সময়ের দাবি।
ইদানিং জলবায়ু উদ্বাস্তু নামক শব্দটি অহরহ শুনা যাচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্ব ব্যাপী দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। এই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীর তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা বৈশিক উষ্ণতা বা গ্রিন হাউস প্রভাব নামে অধিক পরিচিত। জলবায়ু ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে নানা প্রকারের দুর্যোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে অতি বৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, আকস্মিক বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদির প্রাদুর্ভাব বেশি বেশি দেখা যাচ্ছে। যার ফলশ্রুতিতে প্রতি বছর জানমালের ক্ষতি ও কোটি কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হচ্ছে। জীব বৈচিত্র ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
গত শতাব্দীতে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বেড়েছে ২৩%, নাইট্রাস অক্সাইডের পরিমাণ বেড়েছে ১৯% এবং মিথেনের পরিমাণ বেড়েছে ১০০%। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য হুমকি হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে গড় বার্ষিক তাপমাত্রা গত ১৯৮৫-১৯৯৮ সালে পর্যন্ত ১.৫ সে. বৃদ্ধি পেয়েছে। মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ১০,৫০০০০ হেক্টর জমিতে। গড় বৃষ্টিপাত বৃদ্ধি পেয়েছে ও ভয়াবহ বন্যার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। গ্রীষ্মকালে সমুদ্রের লোনাপানি দেশের অভ্যন্তরে প্রায় ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত নদীতে প্রবেশ করেছে।
এক গবেষণা রিপোর্টে বলছে, কক্সবাজার উপকূলে বছরে ৭.৮ মিমি. হারে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত চার দশকে ভোলা দ্বীপের প্রায় তিন ৩ শত বর্গকিলোমিটার এলাকা সমুদ্রের পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। আর সন্দ্বীপ তো ভাঙছে কয়েক শতাব্দী ধরে। বিভিন্ন গবেষণা রিপোর্ট পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ২১০০ সন নাগাদ সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মি. উঁচু হতে পারে, যার ফলে বাংলাদেশের মোট আয়তনের ১৮.৩ অংশ নিমজ্জিত হতে পারে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, রাজশাহীর উচ্চ বরেন্দ্র এলাকায় ১৯৯১ সনে পানির স্তর ছিল ৪৮ ফুট, ২০০০ সনে তা নেমে ৬২ ফুট এবং ২০০৭ সনে তা নেমে ৯৩.৩৪ ফুটে এসে দাঁড়িয়েছে। ফলে আর্সোনিকের প্রভাব বেড়েছে। স্বাভাবিক বন্যায় দেশের মোট আয়তনের প্রায় ২০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। তাছাড়া ভারত থেকে আসা নদীর প্রবাহ দেশের একতৃতীয়াংশ বন্যায় ভাসিয়ে দেয় প্রতি বছর।
বাংলাদেশের পানি উন্নয়ন বোর্ডের জরিপ বলছে যে, এ পর্যন্ত ১,২০০ কিমি. নদীতীর ভেঙে গেছে এবং আরও ৫০০ কিমি. ভাঙনের সম্মুখীন। স্যাটেলাইট চিত্র থেকে দেখা যায়, ১৯৮২ থেকে ১৯৯২ সন পর্যন্ত ১,০৬,৩০০ হেক্টর নদী তীরের ভাঙনের বিপরীতে মাত্র ১৯,০০ হেক্টর নতুন ভূমি জেগেছে। জলবায়ুর পরিবর্তন অব্যাহত থাকলে ভাঙা গড়ার এ ভারসাম্য আরও প্রকট হবে।
ভাঙাগড়ার এ খেলার মাধ্যমেই গত চার দশকে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে যুক্ত হয়েছে অন্তত ১০,০০০ বর্গকিলোমিটার বা ১০ লাখ হেক্টর নতুন ভূমি। ক্রসড্যাম ও বনায়নের চলমান প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে ভবিষ্যতে এর সঙ্গে আরো ২০,০০০ বর্গকিলোমিটার বা ২০ লাখ হেক্টর ভূমি যুক্ত হবে। বাংলাদেশের মোট আয়তন হচ্ছে ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গ কিলোমিটার। এর মধ্যে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৯১০ বর্গ কিলোমিটার ভূখণ্ড এবং ১৩ হাজার ৬৬০ বর্গ কিলোমিটার পানি। নতুন জমির কারণে আয়তনের পরিবর্তন হবে না, তবে ভূখণ্ড ও পানির অনুপাত পরিবর্তন হবে বৈ কি।
সন্দ্বীপসহ দক্ষিণাঞ্চল নিন্মভূমি হবার কারণে জলবায়ুর এ বিরূপ পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য বিশেষ করে বিভিন্ন কলাকৌশল রপ্ত করতে হবে, যাতে করে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে কৃষিকে মুক্ত রাখা বা ঝুঁকি কমানো যায়। এছাড়া দুর্যোগমুক্ত সময়ে শস্য বহুমুখীকরণ ও ফসলের নিবিড়তা বাড়িয়ে দুর্যোগের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার দিকে নজর দিতে হবে।
সন্দ্বীপের ত্রিসীমানায় জেগে উঠা চরগুলোকে রক্ষা ও সাস্টেইনেবল পর্যায়ে নিয়ে যাবার জন্য ক্রসবাঁধ ও কোস্টাল বেল্ট টিকসই করে তৈরী করা ছাড়া অন্য কোন বিকল্প নাই। সন্দ্বীপবাসীর প্রায় ৭০ বছর ধরে ক্রসবাঁধের দাবি শুধু দাবিই থেকে গেলো!
সন্দ্বীপীদের প্রায় ৭০ বছর ধরে এত আন্দোলন, এত সভা সমাবেশ, লেখালেখি, সংগঠন, প্রচার ও এইগুলো করতে লাখ লাখ কর্মঘন্টা বিফলে যাবে কি? শেষের কবিতায় রবি ঠাকুর বলেছেন-
‘যার হয় তারই হয়, আমার হয় না।’
ক্রসবাঁধের দাবি সন্দ্বীপীরা প্রথম করেছিল। অথচ ক্রসবাঁধ বাস্তবায়ন হয়েছে পার্শ্ববর্তী এলাকাতে – ‘যার হয় তারই হয়, সন্দ্বীপের হয় না’।
স্মৃতিকথনে: শিব্বীর আহমেদ তালুকদার
আইনজীবী, সমাজ সংগঠক ও কথ্য ইতিহাস গবেষক।
sandwip21st@gmail.com