সন্দ্বীপ টাউনে সভা সমাবেশ ও রাজনীতি (১)
সন্দ্বীপ টাউনে ১৯৭১ থেকে ৭৫ পর্যন্ত রাজনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন হতে থাকে। ৭১ পূর্ব বাংলাদেশে রাজনীতি করতো বাম ঘরনার ছাত্ররা। বিদেশী সামাজিক ও রাজনৈতিক তত্ত্ব ও তার প্রয়োগের জন্য বাম রাজনীতি করা ছিল ফ্যাশন। মাক্সবাদ-লেলিনবাদ ও মাওবাদ ছিল সন্দ্বীপের ওই সময়ের ছাত্র রাজনীতির মডেল। ওই সময় ভালো ছাত্রদের রাজনীতিতে আকৃষ্ঠ করতে নানা রকমের চেষ্টা তদবির করা হতো। এই সকল লাল বইগুলি লুকিয়ে পড়ার নিয়ম ছিল। আমি দুএকটি লাল বই রাত জেগে পড়েছি। এই তাত্ত্বিক বইয়ের লাল রংয়ের জন্য থানা পুলিশের ভয় ছিল। তাছাড়াও বাড়িতে এইসব বইয়ের বিরুদ্ধে ছিল মুরব্বিরা। লালে বিপ্লব, লালে রক্ত; কে দিতে চায়, বলুন!
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ হবার পর কলকাতা কেন্দ্রিক রাজনীতিক নেতৃবৃন্দ বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করে। অন্যদিকে ইংরেজ হটাও আন্দোলন ও স্বরাজ প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনৈতিক রেনেসাঁ শুরু হয়েছিল। সন্দ্বীপের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী লালমোহন সেন ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন ব্যক্তিত্ব ও অগ্নিযুগের বিপ্লবী। মাস্টারদা সূর্যসেনের বিপ্লবী কর্মী ছিলেন ও একত্রে তিনি চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণে অংশ নেন। গ্রেপ্তার হয়ে আন্দামান সেলুলার জেলে ছিলেন। বিভিন্ন জেলে ১৬ বছর আবদ্ধ থেকে ১৯৪৬ সালে মুক্তি পান। সুতরাং ছাত্রদের মধ্যে বিপ্লবীদের জীবন ও দেশের জন্য সর্বোচ্ছ ত্যাগের ব্যাপারে অনেকের ফ্যাসিনেশন ছিল। ওই বয়সে কিছু একটা করার উদ্দ্যোম সবার মধ্যে থাকা স্বাভাবিক।
১৯৭১ থেকে ৭৫ সাল অব্দি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ভিন্ন হতে থাকে। যার রাজনৈতিক দর্শনের জন্য প্রায় ১ দশক পর্যন্ত জিন্দাবাদ দেয়া হয়েছিল, এবার তারা তার রাজনৈতিক আদর্শের বিরুদ্ধে মুর্দাবাদ দিতে শুরু করে। নিউক্লিয়াসবাদীরা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের সূত্র রাজনৈতিক টেবিলে উপস্থাপন করলো। ম্যাক্সের সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করার জন্য উদ্যোগী হয়ে পড়ে। অন্যদিকে মাওবাদীরা বসে নেয়। ফলে সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ও প্রশাসন যন্ত্রের মধ্যে দূরত্ব বেড়ে যেতে লাগলো। ওই সব ভাব ধারার রাজনীতির প্রভাব সন্দ্বীপে পরিলক্ষিত হয়। ছাত্র রাজনীতির এই অংশ টাউনের কলা ভবনে, আদালত দীঘির পাড় ও ছোট খাটো নির্জন এলাকাসহ ৫ রাস্তার মোড়ের নিকটবর্তী চায়ের দোকানে জমায়েত হতো ছোট ছোট আকারে।
সন্দ্বীপের রাজনীতিতে স্বাধীনতা উত্তর কালে সন্দ্বীপের নিজস্ব সামাজিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে লক্ষ্য করা হয়নি। নদী সিকস্তি জনিত ভাঙ্গনের কারণে সন্দ্বীপবাসী দেশে বিদেশে বসতি স্থাপনের জন্য যেতে থাকে। হাই স্কুল শেষে কলেজে পড়াশুনার জন্য ছাত্ররা সন্দ্বীপের বাইরে যেতে থাকে। ফলে তরুণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সন্দ্বীপে স্থায়ী হতে পারেনি। বিদ্যমান সরকার ব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক প্রভাব এবং মানুষের রাজনীতিমনস্কতা কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে থাকে যারা সন্দ্বীপের বাইরে পড়াশুনা করে সন্দ্বীপের ভালোবাসায় ফিরে এসেছেন, তাদের মধ্যে। তারাও বাস্তবে সন্দ্বীপের সমাজ উন্নয়নে বিশেষভাবে অবদান ও ভূমিকা রাখতে প্রাণান্তকর চেষ্টা করেছেন। নিজেরা নেতা হননি, কিন্তু নেতা বানিয়েছেন অনেককে; যারা সন্দ্বীপের কথা বলতে পারবেন কেন্দ্রে।
দেশের রেডিওতে সরকারি প্রচার থাকতো। তাছাড়াও রেডিও বলতে বিবিসি ও ভয়েস অফ আমেরিকাকে বুঝাতো। দৈনিক পত্রিকা আসতো দু’তিন পর বিশেষ করে টাউনের হসপিটালের দক্ষিণ পাশের খদ্দর সাহেবের দোকানে। আমিও দৈনিক ইত্তেফাক, সংবাদ, আজাদ ও সাপ্তাহিক বিচিত্রা পড়েছি। অনেকে আবার পত্রিকাগুলো পড়ে রেখে আসতেন। অন্যদের পড়ার সুযোগ করে দিতেন। ১৯৭১ এ অস্থায়ী সরকার গঠন এবং অস্থায়ী সংবিধান প্রণয়নের পর থেকে বাংলাদেশের সরকার ব্যবস্থা কমপক্ষে পাঁচবার পরিবর্তিত হয়েছিল। যাহোক বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ব্যবস্থা সংসদীয় পদ্ধতির। আমার মনে হয় বিশেষ করে সন্দ্বীপের ছাত্র রাজনীতির লক্ষ্য ছিল গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা এবং জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থা; সন্দ্বীপের ক্রসবাঁধ।
সন্দ্বীপের মানুষ বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার চেয়ে রাজনীতি সচেতন ছিল। রাজনীতিতে টলারেন্স ছিল। যার যার দল ও মতের বিরোধিতা করতো যুক্তি দিয়ে, শক্তি দিয়ে নয়। ফলে শিক্ষা শান্তি ঐক্য একতা মৈত্রী ঐতিহ্যগতভাবে বামপন্থী, ধর্মনিরপেক্ষ ও ধর্মভিত্তিক দলসমূহের সঙ্গে সমান্তরালভাবে একটা ব্রীজ তৈরী হয়েছিল অন্তত ১৯৮০-৮২ সাল পর্যন্ত। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় থেকে ছাত্র রাজনীতিও বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি শক্তিশালী উত্তরাধিকার হিসেবে স্থান করে নিয়েছিল। সন্দ্বীপ তার আদর্শ ছিল।
স্বাধীনতাত্তোর মুক্তিযোদ্ধারা সন্দ্বীপে ফিরে আসেন নুতুন স্বপ্ন নিয়ে, নুতুন রাষ্ট্র ব্যাবস্থা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে। ওই সময় মুজিববাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর চিন্তাধারার ভিন্নতা লক্ষ্য করা গেছে। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্য তরুণ তাজা আবেগ রাজনীতিতে একটি মেরুকরণের দিকে নিয়ে যেতে থাকে। সেই যাহোক, এই অবস্থাতেও সন্দ্বীপ ও টাউন ছিল পুকুরের পানির মতো ডেউহীন বন্ধুত্ব ও ভাতৃত্বপূর্ন এক স্বচ্ছ সমাজ। তারা বিভোর ছিল মেহনতি, শ্রমিক ও খেটেখাওয়াদের জন্য সামাজিক মুক্তির ইতিহাসে সত্যিকারের এক বিপ্লব করবেন। কোটি কোটি বাংলাদেশের জনগণের মুক্তির মাধ্যমে মানবজাতির জন্য নিয়ে আসবেন আলোকিত সমাজ ও শান্তি আর প্রগতি।
১৯৬২ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত যারা নিরস্ত্র ও সশস্ত্রভাবে জাতীয় স্বাধীনতার জন্য নিরলসভাবে নির্ধারক ভূমিকা রেখেছেন, তারাই ১৯৭২ সালে গঠন করেছেন ‘সমাজতান্ত্রিক গণসংগঠন’ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল – জাসদ। জাসদ ছিল একটি পরিবর্তনের নাম। সামাজিক রাজনৈতিক পরিবর্তন। বৃটিশ, পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে জাতীয় স্বাধীনতার আন্দোলনের ও মুক্তিযুদ্ধের পর একটি রাজনৈতিক তাজা সংগঠন। কাপড়ে চোপড়ে; আচারে বলনে ভিন্ন ছিল তাদের রাজনৈতিক পরিচয়। তা ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে জাতীয় স্বাধীনতার আন্দোলন।
যারা নিউক্লিয়াস করেছেন, ৬৬ ‘র ৬ দফার আন্দোলন করেছেন, যারা ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান করেছেন, যারা বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’ করেছেন, যারা তাড়াহুড়া করে জাতীয় পতাকা তৈরি ও উত্তোলন করেছেন, যারা স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছেন, যারা শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দিয়েছেন, যারা বিএলএফ বা মুজিববাহিনী গঠন করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, যারা মুক্তিবাহিনীতে নেতৃত্ব দিয়েছেন– তারাই স্বাধীনতাত্তোর গঠন করেছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল – জাসদ। এই জাসদই ১৯৭২ সালের দেশ পুনর্গঠনে হাজির করেন ১৫ দফা প্রস্তাবনা; এতে তারা ‘বিপ্লবী জাতীয় সরকার’ গঠনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। প্রত্যাখ্যাত হলে বিপ্লবী রক্তে গর্জে উঠে আরেকটি আন্দোলন। মুক্তিযোদ্ধারাই গঠন করে জাসদ।
ওই ক্ষমতাসীন সরকার ও ক্ষমতার বাইরের শক্তি জাসদের সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠে। ফলে জাসদের রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়েছিল। সন্দ্বীপ টাউনে এই সবের তেমন আঁচড় পড়েনি। আমার জানা মতে ১ জনকে এরেস্ট করে চট্টগ্রাম চালান দেয়া হয়েছিল। তাকে দেখার জন্য শত শত মানুষ স্টিমার ঘাটে জড়ো হয়েছিল। উনি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দিয়েছেন। পুলিশি হেফাজতে থাকাবস্থায়। তা এক ধরণের অনুপ্রেরণা ছিল তরুণদের জন্য।
যাহোক, সন্দ্বীপে সর্বহারা পার্টির খবর আমার জানা নাই। সিরাজ সিকদার বিপ্লবী নেতা ছিলেন, দেশের অভ্যন্তরে থেকে পাকিদের মোকাবেলা করেছেন। উনি ককটেল বানানোর ফর্মুলা দিয়েছিলেন। উনি সশস্র বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা লাভের স্বপ্ন দেখতেন। অন্য জন হলেন সিরাজুল আলম খান। উনি অস্র হাতে নেননি। নিতে বলেছেন। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা ছিলেন।
১৯৭৬ সালে সিরাজুল আলম খান, যখন জাসদ আর জাসদ রইলোনা, বললেন – ‘অগোছালো, এলোপাথাড়ি, গোঁজামিল, দায়সারা কাজ দিয়ে বিপ্লব হয় না’। (নজরুল ইসলাম, আন্দোলন ও সংগঠন প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা ৭)। তা শুধু নয়, তিনি আরও বলেছেন – ‘রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে বুর্জুয়া শ্রেণীকে উচ্ছেদ নয়, বরং কিভাবে বুর্জুয়া শ্রেণীর সাথে মিলে বা তার অধীনে মন্ত্রী হয়ে গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করা যায়’। অথচ সম্পূর্ণ বিপরীত থিসিস দেন ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর ঘেরাও আন্দোলনের ব্যাপারে। সেখানে তিনি বলেন- রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে বুর্জুয়া শ্রেণী উচ্ছেদ এবং তার পরিবর্তে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রবর্তনের কথা বলা হয়।(ঐ, পৃষ্ঠা ৭)।
জাসদ নেতাদের মধ্যে কেউ না কেউ ১৯৮০’র দশক থেকে ক্ষমতার আসে পাশে রয়েছেন। ওইসব নীতি আদর্শ আলোরমুখ দেখেনি। দেখেছে ”ব্যাটলিং বেগমস” ও ”অফস্প্রিংস পলিটিক্স”। ফলে সন্দ্বীপ টাউন নদী গর্ভে বিলীন হওয়ার সাথে সাথে সন্দ্বীপের রাজনীতির মিররগুলোও বিলীন হয়ে গেলো। সমাজ পরিবর্তনের সেই মহান পুরুষরা হারিয়ে গেলেন সন্দ্বীপের রাজনীতির মঞ্চ থেকে।
শত প্রচেষ্টা থাকার পরও স্থানীয় ও জাতীয় রাজনীতি এখন আর জনকল্যাণমুখী হয়ে উঠেনি, হয়েছে ব্যবসা বান্ধব!
(এ লিখাটি বা পর্বটি ওরাল হিস্ট্রি বা স্মৃতিকথন, ইতিহাস নয়। তবে ইতিহাসবিদরা এই লিখা বা পর্বগুলো থেকে তথ্য-উপাত্তগুলো গবেষণার জন্য সূত্র বা রেফারেন্স উল্লেখপূর্বক এবং সোশ্যাল মিডিয়া ও অনলাইন নিউজ পোর্টালে শেয়ার করতে হলে পূর্ব অনুমতি নিয়ে উদ্ধৃতি বা লেখকের টাইম লাইন থেকে শেয়ার করতে পারবেন। গবেষক ছাড়া অন্যরা পর্যালোচনা এবং প্রবন্ধ লেখার ক্ষেত্রে উদ্ধৃত করতে হলে লিখিত অনুমতি ব্যতিরেকে, আংশিক বা সম্পূর্ণ কোন ধরণের অনুলিপি করা যাবে না। বাংলাদেশ ও আর্ন্তজাতিক কপিরাইট আইন দ্বারা লেখক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।আগ্রহীরা লিখিত অনুমতির জন্য ইমেইলে যোগাযোগ করতে পারেন।)
স্মৃতিকথনে: শিব্বীর আহমেদ তালুকদার
আইনজীবী, সমাজ সংগঠক ও কথ্য ইতিহাস গবেষক।
sandwip21st@gmail.com