এই পর্বটি লিখছি ৩১ অক্টোবরে রাতে। মধ্য রাত বা রাত পোহালে ১ নভেম্বর। আমার সাপ্তাহিক পর্ব লেখার দিনক্ষণ। আজ থেকে ৪৭ বছর আগে একটি রাজনৈতিক দলের বার্থডে ছিল ‘৩১ অক্টোবরে ১৯৭২ সাল’। এই রাজনৈতিক দলের নাম হলো জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল – জাসদ।
সন্দ্বীপে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জাসদ একটি মোস্ট প্রমিজিং রাজনৈতিক দল ছিল। বয়সে তরুণরাই এই দল গঠন করে। রাতারাতি তরুণ নেতা-কর্মীরা জাতীয় রাজনীতিতে বয়সে প্রবীণ রাজনীতিবিদদের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেন। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জাসদের ছাত্র সংগঠনের নাম হলো ছাত্র লীগ। জাসদ ছাত্র লীগ নামেও সমধিক পরিচিতি লাভ করে। তারা মূল ধারার ছাত্র লীগ বলে নিজেদের মনে করতো। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত জাসদের রমরমা ভাব ছিল।
আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের একটা অংশ দেশ পুনর্গঠনে ১৫ দফা প্রস্তাবনা করেছিল। ১৯৭২ সালের শুরুতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ দেশ পুনর্গঠনে ১৫ দফা প্রস্তাবনা হাজির করে। এতে ‘বিপ্লবী জাতীয় সরকার’ গঠনের প্রস্তাব ছিল। এসব প্রস্তাবনা প্রত্যাখ্যাত হলে অনিবার্য হয়ে ওঠে নতুন সংগঠন গড়ার। প্রত্যাখ্যাত হয়ে স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণকারীরা নিজেদের দল গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। ৩১ অক্টোবর ১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগে ভাঙ্গন হলো। শুরু হলো অভ্যন্তরীন শত্রূ খতমের পালা। একদা রাজনৈতিক সতীর্থ এখন আর বন্ধু নয়, প্রতিপক্ষ নিপাত করা শুরু হতে থাকে। রাজনীতির মানসে দূরত্ব বেড়ে যেতে থাকে। ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’ [১] দেশাত্মবোধক বাংলা গানটির অনুপ্রেরণায় যারা জীবন বাজি রেখেছিল; তারাই সহোদর ফুলকে মারতে প্রস্তুতি নিতে থাকে। রক্ষীবাহিনী ও গণবাহিনী মুখোমুখি হতে থাকে। তবে মোটামুটি সন্দ্বীপ দুই বাহিনীর এই নিধনযজ্ঞ থেকে মুক্ত ছিল।
বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিকভাবে জাসদ বিরোধীতা করেছে। এই বিরোধিতা কতেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও আদর্শিক ছিল বটে। ন্যায্য ও ন্যায়সঙ্গত অনেকগুলো কারণও ছিল বৈ কি। ১৯৭৫ সালে পটপরিবর্তন ও বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জাসদ রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন হতে থাকে। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রায়োগিক আদর্শ ধীরে ধীরে নিভো নিভো হয়ে আসে। সামরিক শাসনের বিপরীতে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য জাসদ বাংলাদেশের রাজনীতিতে বৃহত্তর ঐক্যের জন্য রাজনীতির সূচনা করে ও ক্ষমতার কাছাকাছি অবস্থান করতে থাকে। বৃহত্তর ঐক্যের মধ্যে বাম রাজনীতির ঐক্যবদ্ধ স্বতন্ত্র অবস্থান গড়ে তুলতে আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে। যাহোক না কেন, এরশাদের সামরিক শাসনের আমলে স্থানীয় সরকারের নতুন ভার্শন ‘উপজেলা পদ্ধতি’ ইন্ট্রোডিউস করতে পেরেছিল জাসদ।
১৯৭২ সালে জাসদ সাত সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটির ঘোষণা করে। আহবায়ক কমিটির আহবায়ক হন মেজর (অব:) এম এ জলিল এবং আ স ম আবদুর রব হন যুগ্ম আহবায়ক। জাসদ ২২ ডিসেম্বর ১৯৭২ সালে কাউন্সিলে অধিবেশনে ১০৫ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করে। ঘোষণাপত্রে সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র তথা শ্রেণিহীন-শোষণহীন-কৃষক-শ্রমিক রাজ প্রতিষ্ঠা করার দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা দেয়া হয়। জাসদ ৭ মার্চ ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় নির্বাচনে ২৩৭টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, শতকরা ৭ ভাগ (১,২২৯,১১০) ভোট পেয়ে ৫টি আসনে বিজয়ী হয়। তখন স্বাধীন দেশে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ আনা হয়েছিল। সন্দ্বীপে জাসদ থেকে সাংসদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন জসিম উদ্দিন ও আওয়ামী লীগ থেকে ওবায়দুল হক। জয় লাভ করেন ওবায়দুল হক।
দেশে ১৯৭৪ সালে সরকারের অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাট, নির্যাতনের বিরুদ্ধে নতুন মাত্রায় আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করে জাসদ। জাসদ ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ সালে দেশ ব্যাপী প্রথম হরতালের ডাক দেয়। আমার যতটুকু মনে আছে, এই কর্মসূচিগুলো সন্দ্বীপে পালিত হয়েছে। ১৭ মার্চ পল্টন ময়দানের জনসভা শেষে প্রায় ৩০ হাজার বিপ্লবী ও উত্তেজিত ছাত্র-জনতার এক বিক্ষোভ মিছিল সহকারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মুনসুর আলীর সরকারি বাসভবনে স্মারকলিপি দেবার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। মিছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ির সামনে পৌঁছলে পুলিশের সাথে ছাত্র-জনতার বিরোধ বাধে। মারমূখী ছাত্র-জনতাকে রুখতে ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রক্ষীবাহিনী তলব করা হয় এবং রক্ষীবাহিনীর গুলিতে প্রায় ২২/২৩ জন জাসদ কর্মী নিহত হয়। ভিয়তনাম দিবসের পর ইহাই ছিল বড় আকারে ছাত্র হত্যা।
উক্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে সারাদেশে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। তার আগেও রক্ষীবাহিনী ও গণবাহিনী মুখোমুখি ছিল। এক সময়ের ৭১ এর যুদ্ধে একে অপরের প্রাণ বাঁচিয়েছিল। আর এখন একে অপরকে প্রাণে মারছিল। মোটামুটি সন্দ্বীপে এইসব তেমন হয়নি। দু’একটি ঘটনা ছাড়া।
জাসদ রাজনীতির বাতি ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে আক্ষরিক অর্থে নিভে যায়। এরপর ১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই কর্নেল তাহেরকে তরিখড়ি করে ফাঁসিতে ঝুলায় সামরিক আদালত এক অসম আইনের মাধ্যমে। ভারতীয় দূতাবাস আক্রমণের ঘটনা, জেলখানায় কর্নেল তাহেরের সাথে শেষ দেখা এবং জাসদ নেতাদের তখনকার সময়ে অবস্থান নিয়ে অনেক রূপ কথা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে রাজনৈতিক সমাজে।
জাসদ গঠনের পর পরই সশস্ত্র শাখা গণবাহিনী নিজেকে আরবান গেরিলার প্রতিচ্ছবি হিসেবে দেখতে শুরু করে। সোশালিস্ট ও কমুনিস্ট আন্দোলনের দোলা খেতে শুরু করে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে। একদিকে অনেক নতুন জাতিরাষ্ট্রের জন্ম হচ্ছে বা হয়েছে। অন্যদিকে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যের বেদনায় ও যাতনায় বিদীর্ণ হচ্ছিল তৃতীয় বিশ্বের এই সব দেশগুলো। ওই সময়ে বিপ্লবী হওয়ার মরণ নেশায় কাতর হয়ে দেশে দেশে তরুণেরা নিজেদের চিরতরে নিঃশেষ করে দিয়েছিল ও আত্ম বলিদান করতে দ্বিধাহীন ছিল। ওই দশকগুলোতে দেশে দেশে অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানে হতে থাকে। গুলি গালা মৃত্যু গুম অপহরণ চলতে থাকে রাজনৈতিক আদর্শের নামে। আপাতদৃষ্টিতে সন্দ্বীপ শান্ত ছিল।
সম্ভবত ‘মিনি-ম্যানুয়াল অফ দি আরবান গেরিলা’ বইটি তখনকার বিপ্লবীদের পড়া ছিল। ওই সময় অজস্র গেরিলা বাহিনীর পাঠ্য ছিল মারিগেল্লার ‘মিনি-ম্যানুয়েল অফ আরবান গেরিলা’। ব্রাজিলিয়ান বিপ্লবী মারিগেল্লা তার বইতে শহরভিত্তিক গেরিলা কর্মকাণ্ডের এক ‘রেসিপি’ লিখেছিলেন। দ্রুত এই বইটি বিপ্লবীদের কাছে পাঠ্য হয়ে উঠে।
কি ছিল এই বইতে। মারিগেল্লা তার বইতে অপহরণকে শহরভিত্তিক গেরিলা অপারেশনের একটি অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। মারিগেল্লা ও তার সতীর্থরা ১৯৬৯ সালে ব্রাজিলে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকে ৭২ ঘন্টার জন্যে অপহরণ করে সারা বিশ্বে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিল। ওই রাষ্ট্রদূত অপহরণের বিষয়টি বিশ্বব্যাপী আরবান গেরিলাদের প্রিয় কৌশল হয়ে উঠে। ১৯৭২ সালে, কোস্তা গাভরাসের বিখ্যাত সিনেমা ‘State of Siege’ এ দেখা যায় উরুগুয়ের টুপামারো গেরিলারা এক মার্কিন কূটনীতিককে অপহরণ করছে। এই সিনেমাটি বাস্তব ঘটনার উপর ভিত্তি করেই নির্মিত হয়েছিল। মারিগেল্লার অপহরণ কাণ্ড নিয়ে নির্মিত হয়েছে ‘Four Days in September’
কমরেড সিরাজ সিকদারের সর্বহারা ও জাসদের সশস্ত্র শাখা গণবাহিনীর নেতৃবৃন্দ ওই সময় মারিগেল্লার রচনাকর্মের প্রতি মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। বিপ্লবীরা অপহরণ-অভিযানের রোমাঞ্চপবিয়াতে নিজেকে উৎসর্গ করতে ছবি আঁকতে থাকে। এক ধরণের এডভেঞ্চারে দীপ্ত হয়ে উঠে। স্বাধীনতা যুদ্ধে লড়াই করা যোদ্ধারা, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও তখনো গেরিলা এডভেঞ্চার পরিহার করতে পারলেন না। জাসদীয় রাজনীতি এই মারিগেল্লার এডভেঞ্চারে আকৃষ্ট হতে থাকে ও ধীরে ধীরে জনবিচ্ছিন্ন হতে থাকে। ঠিক একই ভাবে সর্বহারারাও।
১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাস ছিল জাসদ রাজনীতির জন্য এক সন্ধিক্ষণের। ১৯৭৫ সাল বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে রহস্যময় মাস, সবচেয়ে ঘটনাবহুল তিরিশটি দিন। মাসের শুরুতেই খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান। জেল হত্যা। মাসের সপ্তম দিনেই আবার অভ্যুত্থান, এইবার জেনারেল জিয়াকে বন্দি দশা থেকে মুক্ত করে কাঁধে চড়িয়ে ক্ষমতায় বসালেন কর্নেল তাহের। কিন্তু ক্ষমতার রাজনীতির অদ্ভুত চালে কর্নেল তাহের নিজেই বন্দী হয়ে গেলেন ২৪ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে। জাসদের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সকলেই জিয়ার সরকারের হাতে গ্রেফতার হয়ে গিয়েছিলেন। ঠিক এই সময়ই ঘটলো মারিগেল্লার অপহরণের কায়দায় ভারতীয় হাই কমিশনার সমর সেন অপহরণ ট্রাজেডি যা জাসদের জন্যে দুর্ভাগ্য ব্যতীত আর কিছু বয়ে আনেনি। রাজনীতি বিজ্ঞানী ও জাসদের তাত্ত্বিক গুরু দাদা যিনি রাজনীতির রহস্য পুরুষ ছিলেন, সেই সিরাজুল আলম খানের দাবার গুটিও ফসকে যায়।
১৯৬২ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত যারা নিরস্ত্র ও সশস্ত্রভাবে জাতীয় স্বাধীনতার জন্য নিরলসভাবে ভূমিকা রেখেছেন, তারাই ১৯৭২ সালে গঠন করেছেন ‘সমাজতান্ত্রিক গণসংগঠন’। এই গণসংগঠন গঠনের পিছনে কি ছিল- ক্ষমতার ভাগাভাগি, অক্ষ বা মিত্র শক্তির হাত বা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কারসাজি? তার মূল্যায়ন নিশ্চয় ভবিষ্যত গবেষকগণ করবেন।
প্রগতিশীল রাজনীতি ও বিশ্ব রাজনীতির পালস ধরতে না পারার কারণে আমরা এখনো বিদেশী শক্তির আজ্ঞাবহ হয়ে সরকার পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখছি!
………………………
…………………….
অথচ পাল্টে গেলো কত কিছু — রাজনীতি
সিংহাসন, সড়কের নাম, কবিতার কারুকাজ,
কিশোরী হেলেন।
কেবল মানুষ কিছু এখনো মিছিলে, যেন পথে-পায়ে
নিবিড় বন্ধনে তারা ফুরাবে জীবন। [২]
স্মৃতিকথনে: শিব্বীর আহমেদ তালুকদার
আইনজীবী, সমাজ সংগঠক ও কথ্য ইতিহাস গবেষক।
sandwip21st@gmail.com
………
সূত্রঃ
১. ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’ গোবিন্দ হালদার রচিত এবং আপেল মাহমুদ কর্তৃক সুরারোপিত
২. কবি হেলাল হাফিজ, যে জলে আগুন জ্বলে, ৪ জানুযায়ী ১৯৭৪ ইং।
……….
[এ লিখাটি বা পর্বটি ওরাল হিস্ট্রি বা স্মৃতিকথন, ইতিহাস নয়। তবে ইতিহাসবিদরা এই লিখা বা পর্বগুলো থেকে তথ্য-উপাত্তগুলো গবেষণার জন্য সূত্র বা রেফারেন্স উল্লেখপূর্বক এবং সোশ্যাল মিডিয়া ও অনলাইন নিউজ পোর্টালে শেয়ার করতে হলে পূর্ব অনুমতি নিয়ে উদ্ধৃতি বা লেখকের টাইম লাইন থেকে শেয়ার করতে পারবেন। গবেষক ছাড়া অন্যরা পর্যালোচনা এবং প্রবন্ধ লেখার ক্ষেত্রে উদ্ধৃত করতে হলে লিখিত অনুমতি ব্যতিরেকে, আংশিক বা সম্পূর্ণ কোন ধরণের অনুলিপি করা যাবে না। বাংলাদেশ ও আর্ন্তজাতিক কপিরাইট আইন দ্বারা লেখক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। লিখিত অনুমতির জন্য ইমেইল: sandwip21st@gmail.com]