নিজস্ব প্রতিবেদক
করোনা সংকটকালে স্বাস্থ্য খাতে সংঘটিত অনিয়ম ও দুর্নীতি, নারী ও শিশুর প্রতি ক্রমশ সহিংসতা বৃদ্ধি এবং গণমাধ্যমের ওপর প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক চাপ বৃদ্ধিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর সদস্যদের বার্ষিক সভায় অংশগ্রহণকারী সদস্যবৃন্দ। একইসাথে, কোভিড-১৯ এর ন্যায় বৈশ্বিক বিপর্যয় মোকাবিলা ও টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তরুণদের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত; কার্যকর, জবাবদিহিমূলক ও স্বচ্ছ প্রতিষ্ঠানের বিকাশ; ব্যাংকিং খাতের প্রতি সাধারণের আস্থা ফেরাতে সুস্থ ও নিরাপদ ব্যাংকিং ব্যবস্থা এবং দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে একটি সুশাসিত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার বাস্তবায়নের জোরালো আহ্বান জানিয়েছেন ২০১৯-২০২০ বার্ষিক সভায় অংশগ্রহণকারী সদস্যগণ। একইসাথে, দেশে বিদ্যমান দুর্নীতির মহোৎসব নিয়ন্ত্রণে দুর্নীতি দমন কমিশন ও অন্যান্য সংস্থার যথেষ্ট আইনগতভিত্তি থাকা সত্ত্বেও তারা সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অংশগ্রহণকারীগণ। সদস্যবৃন্দ মনে করেন, বিভিন্ন সময়ে টিআইবির কার্যক্রম ও গবেষণা প্রতিবেদন সম্পর্কে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিরূপ মন্তব্য করা হয়, যা প্রকারান্তরে দায় এড়ানোর অপচেষ্টা বলে প্রতিয়মান হয়। এক্ষত্রে, টিআইবি যেমন কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে নির্মোহ থেকে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ থেকে বিরত থাকতে বদ্ধপরিকর, একইভাবে সংস্থাটির সাথে সম্পৃক্ত সদস্যবৃন্দও ব্যক্তি ও পেশাগত জীবনে রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
বৃহস্পতিবার আয়োজিত এক ভার্চুয়াল সভায় টিআইবির সাথে স্বেচ্ছাসেবারভিত্তিতে দুর্নীতিবিরোধী সামাজিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার ৪৪ জন সদস্য অংশগ্রহণ করেন। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এর সঞ্চালনায় সভায় সভাপতিত্ব করেন টিআইবির সাধারণ পর্ষদে সদস্যদের নির্বাচিত প্রতিনিধি কাজী মোঃ মোরতুজা আলী। সভায় উপস্থাপিত ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে টিআইবি পরিচালিত গবেষণা, অধিপরামর্শমূলক ও প্রচারণাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম এবং সংশ্লিষ্ট আর্থিক হিসাবের সর্বোচ্চ মানসম্পন্ন নিরীক্ষা প্রতিবেদন সম্পর্কে সদস্যগণ ইতবাচক মন্তব্যের পাশাপাশি সার্বিক কার্যক্রমের বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন।
সভা শেষে এক ঘোষণাপত্রে উপস্থিত সদস্যবৃন্দ সারা বিশ্বের ন্যায় করোনাকালীন সময়ে বাংলাদেশেও নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়ে যাওয়া এবং ন্যায় বিচার নিশ্চিতের অভাবে ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধ মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এ প্রেক্ষিতে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা ও ধর্ষণ বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে অপরাধীর যথাযোগ্য শাস্তি নিশ্চিত করার জোরালো আহ্বান জানান সদস্যবৃন্দ। একইসাথে, দুর্নীতিগ্রস্ত স্বাস্থ্য খাতের সংকট কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে আরো গভীরতর হয়েছে বলে মন্তব্য করার পাশাপাশি করোনা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে দুর্নীতির নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে এবং তা ব্যবহার করে নিজেদের আখের গোছাতে সুযোগসন্ধানী, দুর্নীতিবাজ, দুর্নীতির সুবিধাভোগীরা পরস্পর যোগসাজশে দুর্নীতির মহোৎসবে নেমেছে। সরকার করোনা ভাইরাস মোকাবিলার বদলে এ সংক্রান্ত কার্যক্রম নিজ নিয়ন্ত্রণে রাখাটাকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছে এবং এক ধরনের সংকোচনমূলক নীতি অবলম্বন করেছে। ফলে, তথ্য নিয়ন্ত্রিত হয়েছে এবং স্বাস্থ্যখাতে জনগণের অভিগম্যতা কমে গেছে বলে মন্তব্য করেন তাঁরা। সম্মুখসারির সকল স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রাপ্য প্রণোদনা দ্রুত বিতরণের ব্যবস্থা এবং দেশজুড়ে প্রান্তিক ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সহযোগিতার জন্য সরকারি বিভিন্ন কার্যক্রমের পাশাপাশি বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করারও আহ্বান জানান অংশগ্রহণকারীগণ।
দেশে মৌখিকভাবে স্বাধীন সাংবাদিকতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং মুক্ত গণমাধ্যমের প্রচার থাকলেও বাস্তবে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক উভয় পদ্ধতিতেই গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যথেচ্ছ ব্যবহার জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ অন্যান্য বিভিন্ন আইনের চাপে গণমাধ্যম নিজেও ‘সেল্ফ সেন্সরশিপে’ গুটিয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছে, যা স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধারণা ও বিশেষ করে স্বাধীন বাংলাদেশের চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক। গণমাধ্যমের ওপর চাপ গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত, যা আত্মঘাতীমূলক ও বুমেরাং হতে বাধ্য। তাই অবিলম্বে মুক্ত সাংবাদিকতার পথ উন্মুক্ত করতে সরকার ও সংশ্লিষ্ট সকল মহলের কাছে জোর আহ্বান জানান সদস্যবৃন্দ।
পুরো বিশ্বের মতো কোভিড-১৯ বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও ব্যাপক ও গভীর ক্ষত তৈরি করেছে। সমাজের সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষের ওপর এর প্রভাব পড়লেও বিশেষ করে তরুণ জনগোষ্ঠীর জন্য ঝুঁকিটা বেশি। অতিমারি পরিস্থিতিতে তরুণদের চাকুরীর ক্ষেত্রগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তাদের কর্মক্ষেত্র সংকুচিত হয়েছে; নতুন ও অভিনব কর্মক্ষেত্রে অভিগম্যতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিশাল সম্ভাবনাময় তরুণদের সিংহভাগই পিছিয়ে আছে। এক্ষেত্রে তরুণ সমাজকে নতুন বাস্তবতার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জনের সুযোগ তৈরি করতে হবে। একইসাথে, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের ১৬৯টি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের মধ্যে ২০টিতেই সরাসরি তরুণদের কথা বলা হয়েছে। তাই এসডিজি অর্জনের সক্রিয় অংশীজন হিসেবে যুব সমাজ যাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, নীতি ও কৌশল প্রণয়ন, কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ এবং তার বাস্তবায়নকারীর ভূমিকা পালনে সক্ষম হতে পারে, তার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করারও জোর দাবি জানানো হয় সভায়।
কার্যকর, জবাবদিহিমূলক ও স্বচ্ছ প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বের কথা উল্লেখ করে সদস্যবৃন্দ বলেন, একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থাকে বলা হয় জবাবদিহিতার প্রথম ও অপরিহার্য উপাদান। জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার অন্যতম সূচক নির্বাচন পদ্ধতি। একটি প্রশ্নবিদ্ধ জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারি দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন এবং নিয়মরক্ষার প্রধান বিরোধীদল হওয়ায় সরকারের জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় তাঁদের জোরালো ভূমিকার ঘাটতি দৃশ্যমান। অন্যদিকে নির্বাচন কমিশন যে একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সেই সত্যটাও কমিশন সংশ্লিষ্টরা সম্ভবত ভুলে গেছেন। বাংলাদেশে একসময় নির্বাচন যে একটি উৎসব হিসেবে বিবেচিত হতো, তা বর্তমান কমিশন যাদুঘরে পাঠাবার বন্দোবস্ত পাকাপোক্ত করেছেন বলে প্রতীয়মান হয়েছে। এমন বাস্তবতায় প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশন, বিচার ব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশন ও মানবাধিকার কমিশনের নিরপেক্ষতা, বস্তুনিষ্ঠতা, দক্ষতা ও পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করার দাবি জানান সদস্যরা।
রাষ্ট্র মালিকানাধীন বা ব্যক্তি মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যে জনগণের অর্থ ও আমানত নিয়েই ব্যবসা করে থাকে- এই বাস্তবতার স্বীকৃতি বাংলাদেশে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব জনগণের আমানত তদারকি এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করা- তারাও নেতৃত্বের অদক্ষতা, রাজনৈতিক প্রভাব এবং ঋণ খেলাপিদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অকার্যকর একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তাই এই সংকট থেকে উত্তরণে অবিলম্বে সম্পূর্ণ স্বাধীন, নিরপেক্ষ এবং সরকার কিংবা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণমুক্ত একটি কমিশন গঠন করে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনাসহ কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন অপরিহার্য।
দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে জবাবদিহিতার জায়গাটা এমন এক পর্যায়ে আটকে আছে যে, সেখানে শুধু চুনোপুঁটি নিয়ে টানাটানি হচ্ছে। রাঘব বোয়ালরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। একটা ঘটনা চাপা পড়ে যাচ্ছে আরেকটা নতুন ঘটনায়। এর কারণ হচ্ছে প্রভাবশালীদের যারা এসব অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, তাদের কোনো না কোনোভাবে প্রত্যক্ষ হোক বা পরোক্ষ হোক, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার একটা সূত্র পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর দায় আছে। ব্যক্তির পরিচয় ও অবস্থানের ঊর্ধ্বে থেকে প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্নীতি দমনে যে আইনি এখতিয়ার দেওয়া আছে তার যথাযথ প্রয়োগ হলে দেশে একটার পর একটা দুর্নীতির ঘটনা ঘটত না। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত অবস্থান কেবল তাঁর বক্তব্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে কী-না এমন আশঙ্কাও প্রকাশ করেন সদস্যবৃন্দ। পাশাপাশি, একটি ন্যায়ভিত্তিক, সুশাসিত ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতেও সরকারের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানানো হয়।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে দুর্নীতিবিরোধী সামাজিক আন্দোলনের কার্যক্রমে জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধিতে আগ্রহী বিভিন্ন পেশাজীবী ও সাধারণ নাগরিককে টিআইবি সদস্যভুক্ত করে আসছে। পাশাপাশি সারাদেশে সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) ও ইয়ুথ এনগেজমেন্ট অ্যান্ড সাপোর্ট (ইয়েস) প্লাটফর্মের মাধ্যমে স্বেচ্ছাসেবারভিত্তিতে যুক্ত রয়েছেন প্রায় সাত হাজার নাগরিক যাদের বেশির ভাগই হচ্ছেন তরুণ প্রজন্মের সদস্য।