এ প্রতিবেদন যখন লেখা হচ্ছে (১৭ এপ্রিল, শুক্রবার) তখন বাংলাদেশে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১ হাজার ৮৮২ জন। ১৮ কোটির বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে মাত্র ১৮ হাজার ৭৫৩ জন ব্যক্তির রক্তের নমুনা পরীক্ষা করে এই সংখ্যা পাওয়া গেছে। অর্থাৎ প্রতি কোটিতে মাত্র ১ হাজারের কিছু বেশি লোক পরীক্ষার আওতায় আনা গেছে। আক্রান্তদের মধ্যে মারা গেছেন ৭৫ জন। তাদের মধ্যে সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন চিকিৎসকও রয়েছেন। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, দেশের শীর্ষ সারির সমস্ত সংবাদ মাধ্যমের খবর বলছে, করোনাভাইরাসের উপসর্গ প্রতিদিন কমপক্ষে ১০-১২ জন করে ব্যক্তি মারা যাচ্ছেন।
গত ১১ এপ্রিল যা ছিল সর্বোচ্চ ১৯ জন ছিল। স্বাস্থ্যকর্মীরা যাদের আতঙ্কে হাসপাতালে জায়গা দিচ্ছেন না বলে অভিযোগ উঠেছে।
অনেক স্বাস্থ্যকর্মী হাসপাতাল ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ারও প্রমাণ মিলেছে। তাদের অভিযোগ করোনা রোগী শণাক্ত, নিজেদের নিরাপত্তার জন্য পর্যাপ্ত সরবরাহ দিতে পারছে না সরকার। ঢাকার সোহরাওয়ার্দী ও অর্থপেডিক হাসপাতালের নার্সরা এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, যেসব পিপিই সরকার হাসপাতালগুলোতে বরাদ্দ দিয়েছে সেগুলো শুধু ডাক্তাররা ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। এ পরিস্থিতির মধ্যে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি স্বাস্থ্যকর্মীদের উদ্দেশ্যে কড়া বক্তব্য দেন। দায়িত্বের অবহেলা করলে চাকরি কেড়ে নেওয়ারও হুমকি দেন তিনি। ফরিদপুরে একজন দিনমজুর জ্বর, সর্দি ও কাশি নিয়ে সড়কের পাশে মৃত্যুবরণ করেছেন। সারাদিন ওই ব্যক্তি সড়কের ধারে পড়ে থাকলেও ভাইরাস আক্রান্ত হবার ভয়ে কেউ তার পাশে দাড়ায়নি। কিন্তু ওই ব্যক্তি আসলেই করোনা আক্তান্ত কী না আজও জানা সম্ভব হয়নি। একইভাবে করোনার আক্রান্ত হয়ে এ ভয়ে টাঙ্গাইলের সখীপুরে একজন নারীকে তার স্বামী সন্তান জঙ্গলে ফেলে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
প্রায় এক মাস দীর্ঘ লকডাউনে ইতোমধ্যে দেশের দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের মধ্যে হাহাকার শুরু হয়েছে। ত্রাণের জন্য হত দরিদ্ররা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ, এমনকি ত্রাণ ছিনতাই করে নেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে পড়েছেন রাজধানী ঢাকার নগর দারিদ্রের শিকার প্রায় এক কোটি বাসিন্দা। যারা মূলত দিনমজুর, রিকশাওয়ালা, হকার, চা দোকানদার, ভিক্ষুক, ভাসমানসহ নানা অস্থায়ী কর্মকাণ্ডের মধ্যদিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। কোনো কোনো বস্তিতে ৩ দিনের বেশি সময় চুলো জ্বলেনি বলে এ প্রতিবেদক দেখেছেন। ক্ষুধার জ্বালায় শিশুরা কান্নাকাটি করলে বাবা-মা মারধোর করছেন। ভিক্ষে করে রুটি কলা খেয়ে অনেকে দিন পার করছেন। দরিদ্রদের সহায়তায় প্রধানমন্ত্রীর উপহার লেখা সম্বলিত যে ত্রাণের ব্যবস্থা সরকার করেছে সেটি এখনো ঢাকার বস্তিগুলোতে পৌঁছায়নি। ত্রাণ পৌছানোর দায়িত্বে নিয়োজিত ঢাকা জেলা প্রশাসনের হটলাইন নম্বরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চেষ্টা করেও প্রবেশ করা সম্ভব হচ্ছে না।
মহানগরী ঢাকা দেখভালের দায়িত্বে দুই সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। প্রথমদিকে ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম কিছু কিছু এলাকায় হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু গত ১ ফেব্রুয়ারি সমালোচনার ভোটে জয়ী হওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসকে এখন পর্যন্ত কোথাও দেখা যায়নি। যে ব্যক্তি মাত্র এক মাস আগে তার নির্বাচনী প্রচারণায় বার বার বক্তব্য দিয়েছিলেন মেয়র হলে তিনি ২৪ ঘণ্টা দক্ষিণ সিটির নাগরিক সেবা নিশ্চিত করবেন! এদিকে দেশে করোনার ব্যাপক সংক্রমণ বৃদ্ধির মধ্যে সরকারি ত্রাণ কর্মসূচিতে ব্যাপক দুর্নীতির খবর দেশে প্রধান আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। চাল চোর নিয়ে নানা ধরণের ট্রল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ভেসে বেড়াচ্ছে। চাল চুরির অপরাধে স্থানীয় পর্যায়ে কয়েকজন জনপ্রতিনিধি ও আওয়ামী লীগ নেতা গ্রেফতারও হয়েছেন।
শুরুটা যেমন ছিল
বাংলাদেশ যে করোনাভাইরাসের উচ্চ ঝুঁকিতে আছে এ বিষয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে সতর্ক করে দিয়েছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। এমনকি জাতিসিংঘের এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে সতর্ক করে বলা হয় যে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে অধিক ঘন বসতির এ দেশে পাঁচ লাখ থেকে ২০ লাখ মানুষ প্রাণ হারাতে পারে। কিন্তু জাতিসংঘের এ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা নিয়ে দেশের সব গণমাধ্যমই সেলফ সেন্সরশিপে ভুগেছে। অনেকে গুরত্ব দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করলে টেলিভিশন, পত্রিকাগুলোতে গুজব ছড়ানো হচ্ছে এ অভিযোগ তুলে তথ্য মন্ত্রণালয় প্রথমে গণমাধ্যম মনিটরিং সেল গঠন করে। সমালোচনারমুখে পরবর্তীতে এটি তুলে নেয়া হয়। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন তথ্য পরিবেশন করার দায়ে কয়েকজনকে গ্রেফতার করে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী। এমনকি লকডাউন নিয়ে প্রশাসনের সমালোচনা করায় সম্প্রতি ঠাকুরগাঁওয়ে একজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলাও করেছে পুলিশ।
করোনাভাইরাস এমন এক সময় দেশে আঘাত হানে যখন বহু সমালোচনায় বিদ্ধ আওয়ামী লীগ সরকার তার সবচেয়ে বড় কর্মসূচী নিয়ে ব্যস্ত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকীর ও মুজিববর্ষের অনুষ্ঠান নিয়ে সরকারী দলের মধ্যে এক ধরনের তুঘলকী কারবার চলছে। ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিমদের বিরুদ্ধে বৈষ্যম্যমূলক আইন ও দাঙ্গা বাধিয়ে মানুষ হত্যার জন্য নিজের দেশ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিন্দিত নরেন্দ্র মোদীকে প্রধান অতিথি করে মুজিববর্ষের অনুষ্ঠান করতে বদ্ধ পরিকর হাসিনা সরকার। বাংলাদেশে এ নিয়ে দেশে তুমুল প্রতিবাদ হলেও আওয়ামী লীগ নেতারা মোদীর পক্ষে সাফাই গাওয়া শুরু করেন। এরইমধ্যে গত সাত মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ উপলক্ষে জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে কনসার্টের আয়োজন করে সরকার। সেখানে ব্যাপক জনসমাগম ঘটানো হয়। অবশ্য ওই কনসার্টে গায়করা ইংরেজি, হিন্দি উর্দু ও নানা অশ্রাব্য ভাষা প্রয়োগ করে গান গেয়ে ব্যাঙ্গের শিকার হন। ততোদিনে দেশে করোনা আক্রান্ত রোগী চিহ্নিত হয়ে গেছে। বিশ্বস্ত একটি সূত্র বলছে, করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পরও মুজিববর্ষের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের কথা ভেবে বিষয়টি চেপে যেতে চেয়েছিল সরকারের একাংশ। জার্মান গণমাধ্যম ডয়েচে ভেলের বাংলা বিভাগের প্রধান খালেদ মুহিউদ্দিনের একটি টকশোতে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলেছিলেন, আপা আমাদের অনুষ্ঠানটি (১৭ মার্চ মুজিববর্ষের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান) শেষ হয়ে যাক তারপর না হয় ঘোষণা দেয়া যাবে! কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তাতে সায় না দেওয়ায় পরদিন দুপুরে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) নিয়মিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে বিষয়টি জানান প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা। তবে এ ঘোষণার পর থেকে আওয়ামী লীগের মন্ত্রীরা দীর্ঘদিনের চর্চিত নিয়ম অনুসারে করোনার বিরুদ্ধে একে একে বিষোদগার শুরু করেন।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, আওয়ামী লীগ করোনার চেয়ে শক্তিশালী, নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, শেখ হাসিনা থাকতে করোনাভাইরাস কিছুই করতে পারবে না। মোহাম্মদ নাসিম বলেন, শেখ হাসিনার মতো নেত্রী পেয়েছি বলে করোনাভাইরাস প্রতিরোধ করতে পারছি। এমনকি স্বয়ং স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক করোনাভাইরাস মারাত্মক নয় ছোয়াছে বলে সমালোচিত হন। এর আগের বছর দেশ যখন ডেঙ্গু রোগে কাবু হয়ে পড়েছিল এমন সময় পরিবার নিয়ে তিনি সিঙ্গাপুর সফরে গিয়ে সমালোচিত হয়েছিলেন।
করোনাভাইরাসের প্রকোপ যখন বাড়ছে এমন সময় ১৭ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, মানিক মিয়া এভিনিউওসহ রাজধানীর বিভিন্ন লোকেশনে কয়েকটন আতশবাজি করে সরকার। এসময় ব্যাপক লোকের জনসমাগম ঘটানো হয়। একই সঙ্গে নানা মহলের সমালোচনা সত্বেও ঢাকা-১০ আসনের উপ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব এড়াতে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পরামর্শ ছিল হাত ধুয়ে ভোট দেয়ার। কিন্তু ভোটের ফলাফলে দেখা গেছে মাত্র ৫ শতাংশ মানুষ এ নির্বাচনে ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিনকে নির্বাচিত করে! যা রীতিমত বিস্ময়কর।
যা চলছে দেশে
কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত ও তাদেরকে আইসোলশনে পাঠানো নিয়ে বার বার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরামর্শ দিলেও সেদিকে বাংলাদেশের গ্রাহ্য ছিল কম। এমনকি শুরু থেকে বিদেশ ফেরত লোকদের বিমানবন্দর ও অন্যান্য স্থল বন্দরে স্বাস্থ্য পরীক্ষা, প্রাতিষ্ঠানিক বা হোম কোয়ারেন্টিনে পাঠানো নিয়ে ছিল ব্যাপক অব্যবস্থাপনা। বিদেশ ফেরত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্মাল স্ক্যানার কাজ না করায় কয়েক ঘণ্টা বসিয়ে রেখে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এছাড়া টাকার বিনিময়ে বিদেশ ব্যক্তিদের ছেড়ে দেওয়ার ঘটনাও গণমাধ্যমের খবরে আসে। এর বাইরে হিলি, বেনাপোলসহ দেশের স্থলবন্দরগুলো দিয়ে যাতায়াতকারী ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা সম্ভব হয়নি কারণ খবরে জানা গেছে, সেখানকার থার্মাল স্ক্যানারগুলো দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট হয়ে পড়ে ছিল। যাহোক, শুরুতে রোগ শনাক্তের যথেষ্ট কিট না থাকলেও সরকারি তরফে এটি শিকার করা হয়নি। এমনকি প্রথম রোগী শনাক্ত হওয়ার দীর্ঘদিন পর আইসিডিডিআরবিসহ বেশ কয়েকটি হাসপাতালকে করোনা পরীক্ষার অনুমতি দেওয়া হয়। তবে
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের বর্তমান পরিস্থিতি
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, করোনাভাইরাস শনাক্তের জন্য ঢাকাসহ দেশের ১৭টি জায়গায় পরীক্ষা করা হচ্ছে। এসবের মধ্যে ঢাকায় রয়েছে- আইইডিসিআর, জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, আইসিডিডিআরবি, শিশু স্বাস্থ্য গবেষণা ফাউন্ডেশন (সিএইচআরএফ), আইডিইএসএইচআই, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ল্যাবরেটরি মেডিসিন, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, আর্মড ফোর্সেস ইনস্টিটিউট অব প্যাথলজি ও বিএসএমএমইউ
ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস, রংপুর মেডিক্যাল কলেজ, রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ, ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ, সিলেটে এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, খুলনা মেডিক্যাল কলেজ, বরিশালে শেরে বাংলা মেডিক্যাল কলেজ, কক্সবাজার মেডিক্যাল কলেজে করোনাভাইরাসের পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
জানা গেছে, বর্তমানে দেশে ৫০০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স আছে। এগুলোতে গড়ে ২১ জন করে চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও আছে ৮-১০ জন করে। এছাড়া জেলা পর্যায়ে আরও ৬৫টি হাসপাতাল আছে। এখানে ৩৫ জন করে চিকিতসকের পদ থাকলেও আছে ২০-২৫ জন করে। এর বাইরে দেশে সরকারি মেডিকেল কলেজ আছে ৩৬টি মেডিকেল আছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ২০১৯ সালের হিসাব বলছে, দেশের সব সরকারি হাসপাতালে ২০ শতাংশের বেশি চিকিৎসক পদ খালি রয়েছে। তবে বেসরকারি হিসাবে দেশের জেলা ও উপজেলায় ৬০ শতাংশের বেশি চিকিৎসক পদ খালি। চিকিৎসকের অভাবে সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের হিসাবে স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত এক লাখের বেশি চিকিৎসক নিবন্ধন নিয়েছেন। তবে বর্তমানে যারা সরাসরি চিকিৎসা পেশায় যুক্ত এমন চিকিৎসকের সংখ্যা (সরকারি ও বেসরকারি) ৬০-৭০ হাজার। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র ২৫-৩০ হাজার।
স্বাস্থ্য খাত নিয়ে গবেষণা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক জানিয়েছেন, দেশের সরকারি বেসরকারি সব হাসপাতাল মিলে বেড আছে ১ লাখ ৩৭ হাজার ২৪টি। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালে আছে ৪৯ হাজার ৪১৪টি। বেসরকারিতে আছে ৮৭ হাজারের কিছু বেশি। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন ১১২টি আইসিইউ করোনা রোগীর জন্য তৈরি আছে। ভেন্টিলেটর আছে সাড়ে ৫০০। একটি সমর্থিত সূত্রের খবর বলছে, দেশে সরকারি বেসরকারি মিলে আইসিইউ আছে প্রায় ৩০০টি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই অধ্যাপক বলেন, করোনা রোগীর জন্য সব আইসিইউ চালানোর মতো দক্ষ জনবল এখনো নেই। এছাড়া সব আইসিইউ করোনা রোগীর জন্য বরাদ্দ হলে সাধারণ রোগীদের জীবনহানির শংকা দেখা দেবে। তিনি আরও বলেন, প্রতিদিন ২০০ করে রোগী আক্রান্ত হলে এপ্রিলের শেষে এ সংখ্যা হবে প্রায় ৫ হাজার। এসব রোগীর অন্তত ৫-৬ শতাংশের আইসিইউ প্রয়োজন হবে। যার সংখ্যা হবে প্রায় ২০০। অথচ সরকারের প্রস্তুতকৃত আইসিইউ আছে ১১২টি। মে মাস নাগাদ রোগীর সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে গেলে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক একজন উপাচার্য বলেন, করোনাভাইরাস একটা যুদ্ধ। এর জন্য বিভিন্ন স্তরে বাহীনি তৈরি করতে হবে। কিন্তু সরকারের সে উদ্যোগ নেই। ডাক্তার-নার্সরা আক্রান্ত হচ্ছে। এভাবে এদের সবাই যদি আক্রান্ত হয় তাহলে পরবর্তীতে চিকিৎসা দেবে কে? এজন্য আলাদা আলাদা টিম তৈরি করা দরকার। তিনি বলেন, সরকার যেসব পিপিই দিচ্ছে এগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন আছে। এন-৯৫ মাস্ক বেশ কার্যকর। অথচ সরকার এটা দিতে পারছে না। তাহলে জেনে বুঝে ডাক্তাররা মৃত্যুরমুখে যেতে চাইবে কেন?
দক্ষিণ এশিয়ার সর্বনিম্ন স্বাস্থ্য ব্যয় বাংলাদেশের, আছে দুর্নীতিও
২০১৮ সালে বিবিসি বাংলার করা এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিইয়ার আট দেশের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার ব্যয় সর্বনিম্ন। মোট জিডিপির যা দশমিক ৮ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় ছিল মাত্র ২৩ হাজার কোটি টাকা। অথচ জনসংখ্যার ঘনত্ব বিবেচনায় বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের তুলনায় এগিয়ে। সরকারি সংস্থা বিবিএসের হিসাবে দেশের অন্তত চার কোটি মানুষ এখনো দারিদ্র সীমার নিচে বাস করে। যাদের বেশিরভাগই সঠিক স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। তবে সরকার স্বাস্থ্য খাতে যে বাজেট দেয় এটিরও যথাযথ বাস্তবায়ন হয় না দুর্নীতির কারণে। কয়েকজন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতির বিষয়টি অনেকেটা ওপেন সিক্রেট। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে এ খাতের অধস্তন পর্যায় পর্যন্ত দুর্নীতিতে জড়িত। অধিকাংশ হাসপাতালের শীর্ষ পদ আওয়ামী পন্থী চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিতসজক পরিষদের (স্বাচিপ) নেতাদের দখলে। এতে কেনাকাটায় অনিয়ম দুর্নীতি এক ধরনের নিয়ম হয়ে দাড়িয়েছে। মেডিকেল কলেজ হাসপ্তালগুলোতে কার পদোন্নতি হবে, হবে না এসব নির্ধারণ করে স্বাচিপ নেতাদের সঙ্গে সম্পর্কের ওপর। আওয়ামী রাজনীতি ঘনিষ্টদের ছত্র ছায়ায় স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিকরণ করা হয়েছে বলে মত দিয়েছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক একজন সভাপতি।
* রানা প্রতাপ নিরাপত্তাজনিত কারণে ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে।