[ আমাদের কথা: একটা বিতর্ক চলছে। ‘ভাস্কর্য আর মূর্তি নিয়ে। কারো কারো ধারণা এ সব বিতর্ক ‘অমূলক‘। আবার কেউ কেউ মনে করেন সুকৌশলে কেউ কেউ এমন বিতর্কের অবতারণা করে স্বার্থ হাসিল করছে। এ নিয়ে নানা জনের নানা প্রতিনিধিত্বশীল ও ব্যক্তিগত কিছু মতামত আমরা সোজা কথা ডটকম এর পাঠকদের জন্য ছাপতে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ পর্বের প্রথম লেখাটি আজ ছাপা হলো। – সম্পাদক]
‘ভাস্কর্য আর মূর্তি এক জিনিস নয়।’ একটি ভূল ব্যাখ্যা
– ওমর ফারুক লুক্স
‘ভাস্কর্য আর মূর্তি এক জিনিস নয়।’- এটাই এখন দেশের সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা বা বিতর্কের বিষয়।
দেশের বিখ্যাত সব বুদ্ধিজীবীরা দেশের আপামর জনগণকে বোঝানোর দায়িত্ব নিয়েছেন যে, ভাস্কর্য আর মূর্তি এক জিনিস নয়। তাদের দেয়া ব্যাখ্যামতে- ভাস্কর্য হচ্ছে নান্দনিক শিল্পকর্ম; যা প্রদর্শন বা সাজিয়ে রাখা হয়। আর মূর্তি হচ্ছে ধর্মীয় দেব-দেবীর প্রতিমা; যাকে পূজা করা হয়।
আমার ভাস্কর্য বিষয়ে ইয়োরোপের একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা, চারুকলা বিষয়ে দীর্ঘ তিন যুগের জ্ঞানার্জন এবং বিশ্বের অর্ধেকটা ঘুরে শিল্পকর্ম দেখা আর সকল সময়ের সকল সভ্যতার শিল্পকলার ইতিহাস সম্পর্কে জানা আর অভিজ্ঞতাকে মিথ্যা প্রমাণিত করে দিয়েছে বাঙালি শিল্পবোদ্ধা সকল বুদ্ধিজীবীদের দেয়া ভাস্কর্য আর মূর্তির মধ্যে পার্থক্য বিষয়ক এই ব্যাখ্যাটি। আমার জানা নেই- আমাদের শ্রদ্ধেয় বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা এই আধুনিক সময়ে বসে এই উদ্ভট ব্যাখ্যাটি কোথায় পেলেন? এ কথা লেখা আছে ঠিক কোন্ গ্রন্থে, কোন্ আইনে অথবা কোন ওহিতে? কারণ, বাঙালি শিল্পবোদ্ধা বুদ্ধিজীবীদের দেয়া এই ব্যাখ্যা বা সূত্রটি সঠিক হলে একটা গণতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের জনগণের ধর্ম পালনের স্বাধীনতা এবং চিন্তার স্বাধীনতা- দুটোই ভীষণভাবে বাধাগ্রস্ত হতে বাধ্য। কোন্ বস্তুু পূজা করতে হবে, আর কোন্ বস্তুকে শিল্পজ্ঞান করে সাজিয়ে রাখা যাবে, এটা কি কেউ নির্দিষ্ট করে বলে দিতে পারেন? কিছু উদাহরণ দিই, আপনাদের বুঝতে সুবিধা হবে।
যেমন, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের দূর্গা প্রতিমাকে যখন পূজামান্ডপে পূজা করা হয়, তখন তাকে বলা হয়- মূর্তি। আবার এই একই প্রতিমাকে যখন পশ্চিমা দেশের কোনো আর্ট মিউজিয়ামে প্রদর্শনীর জন্য রাখা হয়, তখন সেটার গায়ে আর ‘মূর্তি’ লেখা হয়না, লেখা হয়- ‘Indian traditional Sculpture of God’. সরস্বতী, গণেশ কিংবা কিংবা শিবলিঙ্গ বিশ্বের অসংখ্য মিউজিয়ামে সাজানো আছে ভারতীয় ভাস্কর্য হিসেবে, পূজার প্রতিমা হিসেবে নয়।
আবার, নেলসন ম্যান্ডেলা, মহাত্মা গান্ধী কিংবা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যগুলোকে আমরা বিখ্যাত ব্যক্তিদের ভাস্কর্য বলেই জানি। কিন্তু এসব ভাস্কর্যকে নিজের বাড়িতে মূর্তিজ্ঞান করে পূজা করার লোকেরও কি অভাব আছে এই পৃথিবীতে? ভোটের আগে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছবি বা ভাস্কর্যকে পূজা করা, অসুস্থ হলে অমিতাভ বচ্চনের প্রতিকৃতিকে পূজা করার খবর কি আমরা পড়ছি না? কোনো অন্ধ ভক্ত যদি তার প্রিয় বা আদর্শের নেতার ভাস্কর্যকে প্রতিদিন পূজা করে, তাতে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে? রাষ্ট্র বা জনগণের কোনো ক্ষতি সাধিত হবে?
ম্যারাডোনা, শচিন টেন্ডুলকার, কিংবা মাইকেল জ্যাকসনের ভাস্কর্যকে নিজের বাড়িতে রেখে নিয়মিত পূজা করার মতো পাগল ভক্ত কি পৃথিবীতে নেই? আবার, গৌতম বুদ্ধের কিংবা গণেশের মূর্তিকে কি কোটি কোটি মানুষ ভাস্কর্য হিসেবে বাড়িতে সাজিয়ে রাখেনি? মানুষের পূজা করার বা ব্যক্তিগত পছন্দের শিল্প নিজের বাড়িতে সাজিয়ে রাখার অধিকারকে কি আমরা বাধা দিতে পারি?
আরো সহজ একটা উদাহরণ দিই।
একটা উদ্ভট বা মজার বা জটিল আকৃতির ইট বা পাথরকে রাস্তায় মোড়ে একটু উচু স্থানে সাজিয়ে রাখুন। ইট বা পাথরটির মাথার দিকে একটা সিঁদুর বা লাল রঙ মেখে দিয়ে এবার পর্যবেক্ষণ করুন। দেখবেন, আপনার কুড়িয়ে পাওয়া সেই ইট বা পাথরটিকে কোনো অজানা দেবতার মূর্তি ভেবে প্রতিদিনই কেউ না কেউ পূজা দিচ্ছে। ভারতবর্ষে এরকম ঘটনা অহরহ ঘটছে।
আবার সেই ইট বা পাথরটিকেই পরিস্কার করে একটা গ্যালারী বা শিল্প প্রদর্শনীতে কাঠের বাক্সের উপর সাজিয়ে রাখুন। পাশে দাঁড়িয়ে দাবি করুন- এটি আপনার তৈরি একটা বিমূর্ত ভাস্কর্য। দেখবেন, লোকজন ওয়াও ওয়াও করে সেটার ছবি তুলছে। কেউ একজন হয়ত সেটার দামও জিজ্ঞেস করে বসবে।
আমি বলতে চাচ্ছি, যে কোনো একটা ভাস্কর্যকে, প্রতিকৃতিকে, এমনকি একটা কুড়িয়ে পাওয়া পাথরকেও দেবতা ভেবে পূজা করার অধিকার একটা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের জনগণের আছে; যতোক্ষণ পর্যন্ত সেই অধিকার অন্যের অধিকারকে খর্ব না করে। আবার যে কোনো একটা ধর্মীয় মূর্তি, প্রতিমা, প্রতিকৃতি এমনকি কুড়িয়ে পাওয়া সেই পাথরটিকে ভাস্কর্য দাবী করে নিজের বাড়িতে সাজিয়ে রাখার অধিকারও একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জনগণের থাকতে হবে; যতোক্ষণ তার চিন্তার স্বাধীনতার সুযোগ আছে।
তবে আপনারও স্বাধীনতা আছে- অন্যের উদ্ভট আর হাস্যকর কর্মকাণ্ডকে নিয়ে হাসাহাসি করার; তবে কাউকে গালাগালি, হুমকি-ধামকি আর আক্রমণ না করে। আপনারও অধিকার আছে- কেউ একজন যা ইচ্ছা তাই শিল্প বা ভাস্কর্য বলে দাবী করলে তাকে প্রত্যাখ্যান করার।
শেষ কথা, আপনি যা খুশী তাই মূর্তি ভেবে পূজা করতে পারেন। যা খুশী তাই ভাস্কর্য ভেবে বাড়িতে সাজিয়ে রাখতে পারেন। আবার আপনার পছন্দ না হলে অন্যদের এই দুটো ভাবনাকেই হেসে উড়িয়ে দিতে পারেন। একটা গণতান্ত্রিক আর ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র জনগণের এই ধর্মপালনের এবং স্বাধীন চিন্তার অধিকারকে নিশ্চিত করতে বাধ্য।
(লেখাটা বড় যাচ্ছে, তাই ‘মূর্তি ভাঙ্গার সংস্কৃতি আর ভাস্কর্যের বিরোধি চিন্তার উৎস’ সম্পর্কে পরের লেখায় লিখবো।)
– ওমর ফারুক লুক্স লেখক, অনলাইন এক্টিভিস্ট
(ফেইসবুকে লেখাটি ২ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে প্রথম প্রকাশিত হয়)