প্রাক কথন: ভার্চুয়াল বই মেলা অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। সোজাকথা ডটকমের পাঠকদের জন্য এ-সংক্রান্ত বিতর্কের উপর কিছু লেখা ছাপাতে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আজ এই পর্বের প্রথম লেখাটি ছাপা হলো।- সম্পাদক (অ.)
মহামারীর সময়ে আর সব কিছু চললে কেন বইমেলা চলবে না, এমন একটা প্রতিক্রিয়ামূলক লেখা লিখেই ফেলেছিলাম গতকাল। আমার দাবিটা ছিল মার্চে হলেও করা হোক বইমেলা। আসলেই এর প্রধান কারণ ছিল একটা উষ্মা, একটা রাষ্ট্র তার নাগরিকদের রক্ষায় ন্যূনতম কোন প্রস্তুতির ইচ্ছাও প্রদর্শন করেনি, বরং করোনাকে কেন্দ্র করেও লুণ্ঠন করে যাচ্ছে। এত বিপুল ব্যর্থতা আর নিষ্ক্রিয়তার পরও প্রায় নির্বিকার নির্লজ্জ একটা সরকার হতে পারে! দেশের আর সব কিছু চলবে ,মৃত্যুদণ্ডের খাড়াটা হয়তো কেবল বইমেলার মত আয়োজনগুলোর ওপর দিয়েই যাবে।
কিন্তু বাস্তবতা তো এই যে, মহামারী এখন বাংলাদেশে খুব তীব্র ভাবেই ছড়িয়েছে। গত বিশ দিনে আমার ঘনিষ্ঠ বেশ কয়েকজন মারা গেলেন করোনাতে, অসুস্থ আছেন আরও অনেকে। হাসপাতালগুলোতে উপচে পড়া ভীড়, আইসিইউ পাওয়া একটা যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। হয়তো আবারও আবহওয়াগত কারণে, কিংবা আমাদের দেশে ছড়ানো করোনার জীবানুর বিশেষ ধরনের কারণে মৃত্যুহার কম থাকবে বলেই আশা করি, কিন্তু মৃত্যু তো মৃত্যুই।
***
বইমেলা নিয়ে একটা আবেগ কাজ করে সেই ১৯৯০ দশক থেকে। এখন আর ততটা যাই না প্রায়, কিন্তু একটা সময়ে প্রতিদিন যেতাম। বইকেনা তো শুধু নয়, সারা দেশ থেকে কবি- লেখক-পাঠক-শিক্ষকরা আসতেন। পরিচয় হতো, ঘনিষ্ঠতা হতো, হতো তুমুল আড্ডাবাজি। অজস্র নতুন মানুষ আর নতুন চিন্তার সাথে যুক্ত করে দিয়েছিল বইমেলা। ফেব্রুয়ারির এই মাসটা যে প্রতিদিনের চাঞ্চল্য আর উত্তেজনার যোগান দেয়, বলা যায় সারা বছর সেই রসদ কাজ করে। নিজেরা যে আনন্দ আমরা আমাদের তারুণ্যে পেয়েছি, তা থেকে এখনকার কিশোর আর তরুণেরা বঞ্চিত হোক, তা কিছুতেই চাই না। বরং সংস্কৃতির এই ধারাবাহিতার মাঝেই একটা অগ্রসরতা থাকে, পুরনো সরে গিয়ে নতুন চিন্তা আসে। এভাবেই একটা দেশের ভাবসম্পদ তৈরি হয়।
এক একটা দেশের এক এক রকমের ঐতিহ্য তৈরি হয়, বইমেলা আমাদের একটা ঐতিহ্য। সেটা ফেলনা নয়। অনেকে এমনকি বইমেলাকে বাণিজ্যিকভাবে (এবং ব্যবস্থাপনাগতভাবেও) কার্যকর করবার জন্য ৭ দিন বা বড়জোড় ১৫ দিন করার প্রস্তাব দেন। বইমেলাতে আসলে সব মিলে আয়োজনের খরচ ইত্যাদি এত কম যে, একটা গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক আয়োজনের দিক দিয়ে ভাবলে এই সামান্য টাকা প্রায় তুচ্ছ। যদিও বেহিসেবী টাকা খরচে অভ্যস্ত এই রাষ্ট্র ঠিকই বইয়ের মত আয়োজনগুলোতে কৃপন এবং হিসেবী হয়ে ওঠে, ব্যতিক্রম ছাড়া।
তবু বইমেলার আয়োজনের বাধ্যবাধকতার জন্য কেউ যেন অসুস্থ না হন, মৃত্যুবরণ না করেন, এই বিবেচনাটাও আসলেই আমাদের করতে হবে। সরকার তার গাফিলতি করে যাচ্ছে, আমরাও তো সাধ্যমত তার প্রতিবাদ করি। আমাদেরও কোন কাজ বা আচরণ যেন সরকারকে তার অন্যায় কাজকে জায়েজ করার সুযোগ না দিক। আমি নিশ্চিত বহু মানুষ আছেন, বইমেলার আকর্ষণ যারা উপেক্ষা করতে পারবেন না, অথচ যারা মহামারীর শিকার হতে পারেন।
কিন্তু বইমেলা আয়োজন না করার সিদ্ধান্তটাও এখনই না নেয়া হোক। পরিস্থিতি দেখেই সকল মতকে বিবেচনায় নিয়ে একটা উপসংহারে আসা দরকার। প্রকাশকদের ক্ষয়ক্ষতি যাই হোক, তারা মারা যাবেন না। বরং অনেক বেশি সঙ্কটে থাকবেন মুদ্রনপ্রতিষ্ঠানের কর্মী, কারিগর, বাঁধাইকর ইত্যাদি পেশার মানুষ। যাদের জন্য কোন ক্ষতিপূরণ হবে না, বইমেলা না হলে যাদের অন্নসংস্থান কঠিন হয়ে পড়বে। বইমেলা না হবার একটা মস্ত বড় বিপদ হবে এটাও যে, অন্তত এক বছরের জন্য বাংলাদেশের বইয়ের বাজারে দেশীয় লেখকরা বিপন্ন হবেন। বইমেলাতে এমন অজস্র বইয়ের দেখা মেলে যেগুলোকে দেশের বইয়ের দোকানগুলোতে মিলবে না, লাভ কম হয় বলে। সেখানকার তাকগুলো ভর্তি থাকে ভারতীয় বই দিয়ে। এই লড়াইতে বাংলাদেশের লেখকদের বিপননের জায়গাতে বাঁচিয়ে রেখেছে বইমলাই। কিন্তু সারাবছর দেশী বইয়ের বিপনন কিভাবে দক্ষতার সাথে, দায়িত্বশীলতার সাথে সম্পন্ন হতে পারে, তার দায়িত্ব তো ছিল প্রকাশকদের সমিতিগুলোর, যাদের নেতারা ব্যক্তিগত কিছু ভাগ আর বাঁটোয়ারাতে এতই সন্তুষ্ঠ যে এইগুলো তাদের জন্য বিবেচ্য বিষয়ই না। তো তাদের এই সুবিধাবাদিতার ক্ষতিপূরণর জন্য বইপ্রেমী অজস্র মানুষকে বিপন্ন হতে হবে? সম্ভাবনা যদিও আছে, তবু আমরা কি নিশ্চিত যে মার্চেও এই প্রকোপ কমবে? যাই ঘটুক, মানুষের প্রাণরক্ষাই হোক প্রধান বিবেচ্য।
পিছিয়ে যাওয়া মানেই পরাজয় নয়। একটা বছর বইমেলা না হলেও এমন কিছু হবে না।
– ফিরোজ আহমেদ, রাজনৈতিক সংগঠক, বিশ্লেষক