ঢাকা, ১৭ ডিসেম্বর ২০২০: সরকার প্রদত্ত মোট প্রণোদনা অর্থের প্রায় অর্ধেক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তৈরি পোশাক শিল্প খাতে। অথচ আমাদের জিডিপিতে তাদের অবদান মাত্র ১০ শতাংশ। এখানে প্রণোদনা বরাদ্দের ক্ষেত্রে এক ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়েছে বলে আমরা মনে করি। তৈরি পোশাক খাতে সুশাসনের উল্লেখযোগ্য ঘাটতি বিভিন্ন সময়ে উঠে আসলেও তা নিরসনে সরকার ও মালিকপক্ষের সদিচ্ছা ও কার্যকর পদক্ষেপের ঘাটতি লক্ষ্যণীয়- করোনার সময়ে এই প্রবণতা আরও প্রকট হয়েছে। মালিকপক্ষ ব্যবসার সম্ভাব্য ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিভিন্ন প্রণোদনা আদায় করলেও শ্রমিকদের অধিকার, সুরক্ষা ও নিরাপত্তায় কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে ব্যাপক ঘাটতি লক্ষ্য করা যায় । অপরদিকে করোনা সংকটকালে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানসমূহ শ্রমিক সুরক্ষার ওপর গুরুত্ব না দিয়ে এবং দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া এবং কারখানা মালিকদের ওপর বিভিন্ন ধরনের চাপ সৃষ্টি ও নৈতিক ব্যবসা না করার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। ‘তৈরি পোশাক খাতে করোনা ভাইরাস উদ্ভূত সংকট: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত বুধবার এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) পক্ষ হতে উল্লেখিত মন্তব্য করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপিত গবেষণার ফলাফলে আরো বলা হয় যে, করোনা সংকটের প্রাথমিক পর্যায়ে শ্রমিকদের স্বার্থ বিবেচনায় না নিয়ে শুধু ব্যবসায়িক স্বার্থে আইনের অপব্যবহারের মাধ্যমে কারখানা লে-অফ ঘোষণার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়েছে। সর্বোপরি করোনা সংকটের কারণে দেশের তৈরি পোশাক খাত ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ায় সংকট হতে উত্তরণের জন্য এ খাতে সরকার বিপুল প্রণোদনা ও সহায়তা প্রদান করলেও তার ক্ষুদ্র অংশই শ্রমিকরা পেয়েছে । গবেষণা ফলাফলেরভিত্তিতে করোনা উদ্ভূত বর্তমান এবং ভবিষ্যতের সংকট মোকাবিলায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ উত্তরণে অংশীজনদের করণীয় চিহ্নিত করে ৯ দফা সুপারিশ প্রস্তাব করে টিআইবি।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্ট-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মোহাম্মদ নূরে আলম মিল্টন এবং আ্যাসিসট্যান্ট প্রোগ্রাম ম্যানেজার নাজমুল হুদা মিনা। সংবাদ সম্মেলনটি সঞ্চালনা করেন টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মনজুর-ই-আলম।
তৈরি পোশাক খাতে করোনা ভাইরাস উদ্ভূত সংকট মোকাবিলায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও করণীয় চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যে মে থেকে নভেম্বর ২০২০ সময়কালে গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে। এটি একটি গুণগত গবেষণা, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয় উৎস হতে তথ্য সংগ্রহ করার পাশাপাশি প্রযোজ্য ক্ষেত্রে পরিমাণগত তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য সুশাসনের ছয়টি সুনির্দিষ্ট নির্দেশক ও সংশ্লিষ্ট উপ-নির্দেশকের ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত নির্দেশকসমূহ হলোÑ আইনি সীমাবদ্ধতা ও প্রায়োগিক চ্যালেঞ্জ, সাড়া প্রদান, অংশগ্রহণ ও সমন্বয়, স্বচ্ছতা, শ্রমিক অধিকার এবং নিরাপত্তা ও জবাবদিহিতা।
গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬; দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১২ এবং সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮ এর সীমাবদ্ধতা ও প্রায়োগিক চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান থাকায় শ্রমিকদের অধিকার ও সুরক্ষায় তা কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেনি। বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ এর ধারা ১৬(১) অনুযায়ী লে-অফ ঘোষণা করা কারখানায় এক বছরের কম কাজ করা শ্রমিকদের কোনো ক্ষতিপূরণ প্রদান না করা এবং ৪৫ দিনের বেশি লে-অফ হলে ধারা ২০ এর অধীনে ছাঁটাই করার বিধান [ধারা ১৬(৭)] থাকার ফলে মালিকপক্ষ একতরফা সুবিধা ভোগ করে। মহামারিকালে মালিকপক্ষের ব্যবসায়িক স্বার্থ নিশ্চিতে কারখানা লে-অফ করার প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় শ্রমিকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উল্লেখিত দুটি ধারার কারণে করোনা সংকটকালে লে-অফ ঘোষণা করা কারখানাসমূহে একবছরের কম সময় কাজ করা প্রায় ২০ শতাংশ তৈরি পোশাক শ্রমিক কোনো প্রকার ক্ষতিপূরণ পায়নি। তাছাড়া মহামারিকালে অধিকাংশক্ষেত্রে শ্রম আইন লঙ্ঘন করে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। সরকারের নির্বাহী আদেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হলেও কারখানার ক্ষেত্রে তা কীভাবে প্রতিপালিত হবে স্পষ্ট করা হয়নি। এছাড়া, মহামারির মধ্যে অপরিকল্পিতভাবে কারখানা খুলে দিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শ্রমিকদের নিয়ে আসা এবং সমালোচনার কারণে আবার ফিরিয়ে দেওয়ার ফলে সংক্রমণ অধিকহারে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি সৃষ্টি হলেও শ্রম মন্ত্রণালয় কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি এবং সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮ অনুসরণ করে শ্রমিকদের করণীয় সম্পর্কে সম্পূরক কোনো নির্দেশনা জারি করেনি।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে সরকার ও মালিকপক্ষ মার্চ ২০২০ পর্যন্ত করোনা সংকট মোকাবেলায় তৈরি পোশাক খাতে কোনো পরিকল্পনা ও কৌশল প্রণয়ন করেনি। সরকার করোনার পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে মূলত মালিকপক্ষের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করে। তাছাড়া, এ খাতের নেতৃবৃন্দের করোনা মহামারির কারণে চীন থেকে তৈরি পোশাক ব্যবসার একটি বড় অংশ বাংলাদেশে চলে আসবে এমন আত্মতুষ্টিতে ভোগার উদাহরণ রয়েছে। অধিকাংশ ক্রেতা প্রতিষ্ঠান করোনার ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েছে বলে মালিকপক্ষের অভিযোগ রয়েছে। ক্রেতা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক চলমান ও নতুন কার্যাদেশে পণ্যের ৫ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত মূল্য ছাড় এবং অর্থ পরিশোধের জন্য ৯০ থেকে ১৮০ দিন সময় দাবি করা হয়। ফলে সরবরাহকারী দেশি তৈরি পোশাক প্রতিষ্ঠানসমূহ শ্রমিকদের মজুরি প্রদান ও ব্যবসা পরিচালনায় সংকটে পড়ে, পোশাক শিল্পে নগদ প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয় এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে চলমান ব্যবসা বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।
সরকার কর্তৃক ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে তৈরি পোশাক খাতের জন্য বিভিন্ন সুবিধা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে রপ্তানি প্রণোদনার জন্য ২ হাজার ৮ শত ২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ, নতুন বাজারের জন্য চলমান ৫ শতাংশ প্রণোদনা অব্যাহত রাখা, এবং কর হার পরবর্তী দুই বছরের জন্য ১০ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশ অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়। সরকার, উন্নয়ন সহযোগী ও ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রদেয় মোট প্রণোদনার ১৬ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ শ্রমিকদের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। সরকার কর্তৃক ঘোষিত শ্রমিকদের বেতনভাতা বাবদ প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে বঞ্চিত হয়েছে ৪২ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ শ্রমিক। অবশিষ্ট ৫৭ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ সরকারের বেতনভাতা বাবদ প্রণোদনায় অন্তর্ভুক্ত ছিলো। তাছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলে তৈরি পোশাক খাতের ঋণের পরিমাণ ৩৫০ থেকে ৫০০ কোটি ডলারে উন্নীতকরণ এবং সুদের হার কমানো হয়েছে। তবে প্রণোদনা বিতরণেও বৈষম্য লক্ষ্য করা গেছে। ঋণের টাকা পরিশোধে বৃহৎ শিল্প খাতের জন্য দুই বছর নির্ধারণ করলেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের জন্য তা এক বছর নির্ধারণ করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঝুঁকি বিবেচনায় সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ঋণ প্রদানে অনাগ্রহ প্রকাশের অভিযোগ রয়েছে। তাছাড়া ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের জন্য গঠিত প্রণোদনা তহবিল ছাড়ে দীর্ঘসূত্রতা লক্ষণীয়। অপরদিকে নতুন অর্থবছরে (২০২০-২১ অর্থবছর) পোশাক খাতের জন্য উৎস কর পূর্বের ০.২৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ০.৫০ শতাংশ নির্ধারণ করার ফলে এ খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, মার্চ ২০২০ এ করোনা মহামারির শুরুতে সরকার কর্তৃক দেশব্যাপী সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হলেও সরকার বা মালিকপক্ষের কোনো দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষই কলকারখানা বন্ধের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। ফলে পরবর্তী সময়ে সরকার ১ এপ্রিল ২০২০ এই সাধারণ ছুটি বর্ধিত করলেও কারখানা মালিকগণ অপরিকল্পিতভাবে কারখানা খুলে দেয়। কারখানা খোলার খবরে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তৈরি পোশাক শ্রমিকরা কারখানা অধ্যুষিত এলাকায় চলে আসে, আবার একই দিনে কারখানা বন্ধ ঘোষণায় পুনরায় ফেরত যেতে বাধ্য হয়। এতে করে পরিবহণ সংকটে শ্রমিকদের হয়রানির শিকার হতে হয় এবং সারাদেশে ব্যাপকভাবে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি সৃষ্টি হয়। অধিকাংশ তৈরি পোশাক কারখানায় কোভিড-১৯ সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়নি। বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর সহায়তায় আইএলও ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে কারখানা সুরক্ষা বিষয়ক প্রশিক্ষণের জন্য ‘লার্নিং হাব’ প্রকল্প চালু করে। আগস্ট ২০২০ পর্যন্ত লার্নিং হাব প্রকল্পের অধীন মোট ১৫০ জন শ্রমিককে কারখানার সুরক্ষা বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়, যা তৈরি পোশাক খাতের মোট শ্রমিকের সংখ্যা বিবেচনায় অতি নগণ্য।
গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য মতে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও কারখানা খোলার ক্ষেত্রে শ্রমিক ও শ্রমিক সংগঠনের সাথে মালিকপক্ষ কোনো আলোচনা করেনি। এক্ষেত্রে সরকার, বিজেএমইএ, মালিকপক্ষ ও শ্রমিক সংগঠনের মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। অঞ্চলভেদে নির্দিষ্ট সংখ্যক কারখানা খোলার পরিবর্তে এবং সংক্রমণের ঝুঁকি বিবেচনা না করে বিশৃঙ্খলভাবে সারাদেশে কারখানা খোলা হয়। স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে প্রধান করে কমিটি করা হলেও মন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী কারখানা খোলা ও বন্ধের বিষয়ে তাঁকে জানানো হয়নি। তাছাড়া, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত তৈরি পোশাক কারখানা পরীবিক্ষণ কমিটিসমূহে শ্রমিক প্রতিনিধি না রাখার ফলে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়নি। অনুরূপভাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটিতে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরকে সংযুক্ত না করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক একক সিদ্ধান্তে কমিটি গঠন করার ফলে কমিটিসমূহ কার্যকরভাবে কারখানা পরিদর্শন করতে পারেনি। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর কর্তৃক রেজিস্টার চালু করা হলেও করোনা ভাইরাস সংক্রমিত রোগীর হালনাগাদ কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। জুলাই মাস পর্যন্ত শিল্প পুলিশ কর্তৃক করোনা সংক্রমিত কারখানা ও শ্রমিকের তথ্য প্রকাশ করা হলেও পরবর্তিতে সরকার ও মালিকপক্ষের চাপে আগষ্ট মাস থেকে এ সংক্রান্ত তথ্য উম্মুক্ত করা থেকে শিল্প পুলিশ বিরত থাকে। করোনা মহামারির ফলে উদ্ভূত সংকটের শুরুতে বিজিএমইএ কর্তৃক কার্যাদেশ বাতিলের পরিমাণ, ক্ষতিগ্রস্ত কারখানা ও শ্রমিকের সংখ্যা এবং কোভিড-১৯ আক্রান্ত শ্রমিকের সংখ্যা প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করে। তবে সরকার কর্তৃক প্রকাশিত তথ্যের তুলনায় বিজিএমইএ-প্রকাশিত তথ্যে ছাঁটাই ও করোনা আক্রান্ত শ্রমিকের সংখ্যা কম দেখানো হয়। তাছাড়া বাতিল হওয়া প্রায় ৯০ শতাংশ কার্যাদেশ পুনর্বহাল হলেও বিজিএমইএ সে বিষয়ে স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশে বিরত থাকে।
মে মাস হতে শ্রমিকদের মজুরি নিয়মিত প্রদানের বিজিএমইএ কর্তৃক নির্দেশনা থাকলেও অনেকক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিয়মিত মজুরি দেওয়া হয়নি এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কর্মঘন্টার প্রাপ্য মজুরি ও ভাতা প্রদান করা হয়নি। ফলে করোনা উদ্ভূত সংকটে তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকরা আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এপ্রিল মাসে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর কারখানা লে-অফ ও শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ করার জন্য সংশ্লিষ্ট মালিক সংগঠন ও মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায় এবং বিজিএমইএ কর্তৃক কারখানার মালিকদেরকে শ্রমিক ছাঁটাই না করে বকেয়া মজুরি কম অংশ প্রদানের নির্দেশনা দেয়। তবে বাস্তবতায় দেখা যায় অনেকক্ষেত্রেই তা প্রতিপালন করা হয়নি। তথ্যানুযায়ী, সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বিজিএমইএর ৩ শত ৪৮টিসহ মোট ১ হাজার ৯ শত ৪টি কারখানা লে-অফ ও বন্ধ ঘোষণা করে এবং প্রায় ৬০ থেকে ৬৫ হাজার শ্রমিক ছাঁটাইয়ের শিকার হয়। কারখানাসমূহে ইচ্ছাকৃত ছাঁটাই আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে কম বেতন ও মজুরি ছাড়া অতিরিক্ত কর্মঘন্টায় কাজ করানো এবং ছাঁটাইকৃত শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ না করার অভিযোগ রয়েছে।
স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে বিজিএমইএ বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতায় তৈরি পোশাক কারখানার জন্য একটি স্বাস্থ্য সুরক্ষা গাইডলাইন প্রণয়ন করে। তবে, অধিকাংশ কারখানায় মাস্ক পরা নিশ্চিত করলেও হাত ধোয়ার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই; শ্রমিকদের খাবার ও বিশ্রামের জায়গা এবং টয়লেটের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়নি। শিফটিং পদ্ধতিতে ৩০ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ শ্রমিকের মাধ্যমে কারখানা চালুর নির্দেশনা অধিকাংশ কারখানা মালিক মানেনি। তাছাড়া, করোনা ভাইরাস পরীক্ষার ব্যবস্থা সীমিত হওয়ায় প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও অনেক শ্রমিক এই পরীক্ষা সুবিধা নিতে পারছেন না এবং অনেকক্ষেত্রে চাকরি হারানোর আতঙ্কে উপসর্গ থাকা সত্ত্বেও শ্রমিক কর্তৃক তা লুকানোর প্রবণতার কারণে কারখানার অন্যান্য শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সকল কারণে তৈরি পোশাক খাতে করোনাভাইরাস আক্রান্ত শ্রমিকের প্রকৃত সংখ্যা জানা যাচ্ছে না। অধিকাংশ তৈরি পোশাক কারখানার মালিক কর্মরত শ্রমিকদের জন্য পৃথক আইসোলেশন সেন্টারের ব্যবস্থা করেনি। কিছুক্ষেত্রে করোনা আক্রান্ত বা উপসর্গ থাকা শ্রমিকদের সাধারণ ছুটি দেওয়ার পরিবর্তে ছাঁটাই করা এবং কোনো কোনো কারখানায় আক্রান্ত শ্রমিককে সাধারণ ছুটি দিলেও মজুরিসহ ছুটি না দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী তৈরি পোশাক খাতে কর্মরত নারী শ্রমিকদের জন্য মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ এর কারখানাসমূহে ‘দ্যা ল্যাকটেটিং মাদার এইড ফান্ড প্রজেক্ট’ চালু করা হয়। জুন মাসে নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনালের সহযোগিতায় বিকেএমই-এর কারখানাসমূহে ‘নিউট্রিশন অফ ওয়ার্কিং ওমেন’ প্রকল্প চালু করা হয়। তবে কারখানা মালিক কর্তৃক করোনার কারণে মাতৃস্তন্যপানকারী শিশুদের কর্মস্থলে আনা নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এছাড়া, করোনা মহামারির সময়ে সরকার কর্তৃক শ্রমিক সংগঠনের নিবন্ধন বন্ধ রাখা হয়েছে। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, শ্রম অধিদপ্তর ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে কারখানার জবাবদিহিতা নিশ্চিতে ২৬টি ‘ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট কমিটি’ গঠন করা হয়। এসব কমিটি ঢাকার অভ্যন্তরে হাতেগোনা কয়েকটি কারখানা পরিদর্শন করে। প্রয়োজনীয় যানবাহন ও সুরক্ষা সমগ্রীর ঘাটতির কারণে এসব কমিটি অধিকাংশ কারখানা পরিদর্শন করতে পারেনি।
করোনা ভাইরাস আমাদের অর্থনীতিতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। আমাদের জিডিপির ১০ শতাংশ এবং রপ্তানি বাণিজ্যের প্রায় ৮৪ শতাংশের অংশীদার তৈরি পোশাক খাত উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “তৈরি পোশাক খাতটি উৎপাদন ও রপ্তানি উভয় ক্ষেত্রেই যেহেতু বিদেশের ওপর নির্ভরশীল। স্বাভাবিকভাবেই নেতিবাচক প্রভাব ব্যাপকতর এ খাতটিকে ঘিরে। আমরা লক্ষ্য করেছি ব্যাপকভাবে কার্যাদেশ বাতিল হয়েছে। রপ্তানি বাণিজ্য প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো কিছুদিনের জন্য, শত শত কারখানা লে-অফসহ বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং শ্রমিকদের চাকরি হারানোর ঘটনা ঘটেছে। বৈদেশিক বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে এ খাতের এই যে ভূমিকা, তা ঝুঁকির মধ্যে পড়ায় সার্বিকভাবেই বাংলাদেশের অর্থনীতি অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। সরকার ও মালিক পক্ষের কারোরই করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে সমন্বিত কোনো পরিকল্পনা না থাকায়, এ খাতের অবস্থা আরো নাজুক হয়ে পড়েছে। চার দশক ধরে এ খাতের নেতৃবৃন্দের যে পুঞ্জীভূত মানসিকতা অর্থাৎ সরকারি প্রণোদনার ওপর নির্ভরশীলতা, সেটি এই সময়ে ব্যাপকভাবে আরো প্রকটতর রূপে দেখা গেছে। প্রকৃতপক্ষে এ খাতের বোঝাটি কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকার তথা জনগণের ওপরই বর্তেছে। মালিকপক্ষের আচরণে মনে হয়েছে যে, পুরো অর্থনীতিতে শুধুমাত্র তারাই যেন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সরকারের প্রণোদনার সিংহভাগের মালিকানা তথা অধিকার যেনো তাদেরই, এরকম একটা ভাব আমরা লক্ষ্য করেছি। আমরা দেখেছি সরকার প্রদত্ত মোট প্রণোদনা অর্থের প্রায় অর্ধেক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তৈরি পোশাক শিল্প খাতে। অথচ আমাদের জিডিপিতে তাদের অবদান মাত্র ১০ শতাংশ। এখানে প্রণোদনা বরাদ্দের ক্ষেত্রে এক ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়েছে বলে আমরা মনে করি।”
“গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে সুশাসনের যে-সকল মাপকাঠি ব্যবহৃত হয়েছে, তার প্রায় প্রতিটির ক্ষেত্রেই ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। যা নিরসনে সরকার ও মালিক পক্ষের উভয়ের দিক থেকেই সদিচ্ছা ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের ঘাটতি ছিলো,” বলে মনে করেন ড. জামান।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, “চলমান অতিমারি সংকট আবারো প্রমাণ করলো যে, সরকারি প্রণোদনা তথা জনগণের অর্থের ওপর নির্ভর করে মালিকপক্ষ ও ক্রেতা সংস্থাগুলোর অনেকেই নিজেদের সুবিধা আদায়ে তৎপর ও সফল হয়েছেন। সংকট মোকাবিলায় আত্মনির্ভরশীল ও দায়িত্বশীল ব্যবসার দৃষ্টান্ত প্রায় কেউই দেখাতে পারেননি। মালিকপক্ষ সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন প্রকার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে প্রণোদনা আদায় করতে পারলেও উৎপাদনের যে মূল উপাদান অর্থাৎ শ্রমিক পক্ষ, সেই শ্রমিক পক্ষের অধিকার, তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কোনো প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। এক্ষেত্রে কার্যকর কোনো কর্মপরিকল্পনা বা কর্মকৌশল গ্রহণে মালিকক্ষকে সক্রিয় হতে দেখা যায়নি। ক্রেতা সংগঠনসমূহের মধ্যেও আমরা অত্যন্ত নেতিবাচক আচরণ লক্ষ্য করেছি। কোনো কোনো ক্রেতা সংগঠন নাম মাত্র কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার ওপর ততটা গুরুত্ব তারা দেয়নি। তারা তাদের দায়িত্ব এড়িয়ে গিয়েছে। মালিকদের ওপর চাপ প্রয়োগ করেছে এবং নৈতিক ব্যবসা চর্চায় তারা ব্যর্থ হয়েছে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সরকার তথা জনগণের ওপর। অর্থাৎ জনগণকেই পুরো বোঝাটি বহন করতে হয়েছে।”
কোনো কোনো মালিকপক্ষ প্রাথমিক অবস্থায় শ্রমিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়ে শুধুমাত্র ব্যবসায়িক স্বার্থে আইনের অপব্যবহারের মাধ্যমে ব্যাপকহারে লে-অফ করে শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে মন্তব্য করে ইফতেখারুজ্জামান বলছেন, “প্রণোদনা প্যাকেজের সিংহভাগই মালিকপক্ষের হাতে চলে গেছে। শ্রমিকরা যার ক্ষুদ্র অংশ মাত্র পেয়েছে, যা অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। শুধু তা-ই নয়, এক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের যে প্রক্রিয়ায় সরকার যেখানে মালিকদের সাথে বিভিন্ন পর্যায়ে প্রত্যক্ষভাবে আলোচনা করেছে, সেই তুলনায় শ্রমিকদের সাথে বা শ্রমিক সংগঠনসমূহকে অংশগ্রহণমূলক কোনো প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করতে দেখা যায়নি। আমরা আশা করছি, সংশ্লিষ্ট অংশীজনসহ সরকার ও মালিকপক্ষ আমাদের সুপারিশসমূহ বিবেচনায় নিয়ে ভবিষ্যতে অধিকতর কল্যাণমুখী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তৈরি পোশাক খাতকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।”
তৈরি পোশাক খাতে করোনা উদ্ভূত বর্তমান ও ভবিষ্যতের সংকট মোকাবিলায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ উত্তরণে অংশীজনদের করণীয় চিহ্নিত করে ৯ দফা সুপারিশ প্রস্তাব করা হয়েছে প্রতিবেদনে। উল্লেখযোগ্য সুপারিশসমূহ হলো- করোনা মহামারি বিবেচনায় নিয়ে সকল শ্রেণির শ্রমিকের চাকরির নিরাপত্তার বিধান সংযুক্ত করে ‘ বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬’ এর ধারা ১৬ ও ২০ সংশোধন করতে হবে; বিজিএমইএ কর্তৃক প্রণীত গাইডলাইন মোতাবেক শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহ এবং স্বাস্থ্য-বিধি প্রতিপালন ব্যত্যয় হলে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ‘ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশন (ইউডি)’ সুবিধা বাতিল এবং জরিমানার ব্যবস্থা করতে হবে; বিজিএমইএর অঙ্গীকার করা করোনা ভাইরাসের নমুনা পরীক্ষার বাকি তিনটি ল্যাব দ্রুততার সাথে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে স্থাপন করতে হবে; ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নৈতিক ব্যবসা পরিচালনায় অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে। পোশাকের ভিত্তিমূল্য নির্ধারণ ও কার্যাদেশসমূহের বিদ্যমান শর্তের সাথে দুর্যোগকালে শ্রমিক অধিকার নিশ্চিতকরণের বিষয় সংযুক্ত করতে হবে; করোনার দ্বিতীয় পর্যায়ের সংক্রমণ মোকাবেলায় সরকার ও মালিক সংগঠনসমূহ কর্তৃক গঠিত বিভিন্ন কমিটিকে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী ও যাতায়াতের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে এসব কমিটি শ্রমিকদের অধিকার ও কারখানায় তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে; লে-অফকৃত কারখানায় একবছরের কম কর্মরত শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে; শ্রমিক অধিকার ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতে সরকার, মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির নিয়মিত ও কার্যকর পরিদর্শন নিশ্চিত করতে হবে; ইইউ ও জার্মানির সহায়তা তহবিল ব্যবহারের জন্য করোনা মহামারির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের সঠিক তালিকা অবিলম্বে প্রণয়ন করতে হবে এবং করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া, শ্রমিক ছাঁটাই, কার্যাদেশ বাতিল ও পুনর্বহাল, প্রণোদনার অর্থের ব্যবহার ও বণ্টন, ইত্যাদি সব তথ্য সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে ও নিয়মিত হালনাগাদ করতে হবে।