দেশের দু-তিনটা মানসম্পন্ন প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ ছাড়া বাকি সবগুলিই জাস্ট গার্বেজ। সেসব মেডিকেল কলেজে পরীক্ষা নিতে গেলে নিজের মানসিক সুস্থতাই ধরে রাখা দায়। সর্বশেষ এই করোনাকালে ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে একটি প্রাইভেট মেডিকেল কলেজের ফাইনাল এমবিবিএস এর পরীক্ষা নিতে গিয়েছিলাম। যিনি বিভাগীয় প্রধান তিনি আমার নিজেরই শিক্ষক পরীক্ষক ছিলেন।
আমি অবাক হয়ে দেখলাম এদের প্রায় অধিকাংশ ইতিমধ্যে দশ-বারোবার ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে ফেলেছে। এবং আমি নিশ্চিত আরো দশ-বারোবার পরীক্ষা দিলেও তাদের লেভেল ঠিক একই রকম থাকবে একটুও উন্নতি হবে না। উন্নতিটা করবে কে? সেখানে মানসম্পন্ন কোনো শিক্ষক নেই যে হাতে ধরে তাদের ভুলগুলো ধরিয়ে দিবে, আগের পরীক্ষার চেয়ে পরের পরীক্ষায় ভালো প্রস্তুতি নিয়ে যাবে সে ব্যবস্থা করে দেবে।
পরীক্ষা নেয়াটা যেন উভয় সংকটের মতো, যাকে আমি ফেল করাবো আমি জানি আরও শত বার পরীক্ষা দিলেও সে একই প্রস্তুতি নিয়ে আসবে। কি এক মনো:কষ্ট। আবার দয়াপরবশ হয়ে যদি পাশ করিয়ে দেই সমাজের জন্য কি ক্ষতি আমি করে ফেললাম। এই অনন্ত সংশয়ে আসলে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। তাছাড়া আমি এত জুনিয়র external হিসেবে গিয়ে শিক্ষকের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়াটা কতটা সহজ কতটা কঠিন সেটা ভেবে নেয়া যেতে পারে।
ফাইনাল এমবিবিএস পরীক্ষা, ডাক্তার হয়ে যাবে, এ অবস্থায় কাউকে লিভার হাত ধরে দেখানোর জন্য বলা হলে যদি থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তাহলে কেমন দেখায় ব্যাপারটা? লিভার বুকে থাকে না পেটে থাকে সে সুরাহাই যেন সে করতে পারছিল না। কিডনি রোগে ক্রিয়েটিনিন বাড়ে না কমে যেটা একটা চলমান হাসপাতালের ওয়ার্ড বয়েরও ও জানার কথা সেটাও যদি একজন হবু ডাক্তারের কাছে জটিল প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায় তাহলে তো পরীক্ষকের কান্না পাওয়া ছাড়া আর কিছু থাকেনা। আমিও তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি দুতিনটা মানসম্পন্ন প্রাইভেট মেডিকেল ছাড়া আমি আর কোন প্রাইভেট মেডিকেলে কাস্মিনকালেও পরীক্ষক হিসেবে যাব না। আগে নিজের মানসিক সুস্থতা, তারপর চাকুরীর দায়িত্ব পালন।
Long case এ স্টুডেন্ট বলছে রোগীর সমস্যা জ্বর। আমি অবাক হয়ে বললাম এই করোনার সময়ে জ্বরের রোগী দেয়া হয়েছে? পরে জানলাম সে আসলে মেডিকেলের staff, রোগী নয়। জ্বর যেন বলে সেটা তাকে শিখিয়ে দেয়া হয়েছে কেননা তাঁর ডায়াগনসিস বানাতে হবে প্রস্রাবের ইনফেকশন (UTI)। Long case পরীক্ষার জন্য সময় রাখা হয়েছে আবার মাত্র তিন মিনিট।
Short কেইসে প্রতি পরীক্ষার্থীর জন্য ৩ জন রোগী থাকার কথা। কিন্তু রাখা হয়েছে একজন এবং তার উপরেই বলা হচ্ছে Chest examine করো, Heart examine করো বা Liver দেখাও ইত্যাদি। অর্থাৎ একজনের মধ্যেই তিনজনের কাজ চালাতে হবে। আমার আসলেই রোগীটির জন্য খারাপ লাগছিল। পরে জানলাম সে ও রোগী নয়, ফোর্থ ইয়ার স্টুডেন্ট। রোগী বানিয়ে শুইয়ে দেয়া হয়েছে।
সেই তরুণ বিমর্ষ ছাত্রদের ওপর আমার প্রচন্ড মায়া হলো, একবিন্দু অভিযোগ তাদের প্রতি আমি মন থেকে করিনি। তারা আসলে প্রতারণা ও লালসার শিকার । অভিভাবকদের ভুল সিদ্ধান্তের শিকার। সবচেয়ে ট্রেজেডি হল যারা ফেল করবে তাদের প্রস্তুতি একবিন্দুও improved হবে না আগামী পরীক্ষায়ও। মেডিকেল কলেজটির কাজ শুধু বাণিজ্য করা, তাদেরকে নিয়ে ব্যবসা করা, তাদের ভালো-মন্দ দেখার ন্যূনতম দায় তারা নিচ্ছে না। এই মানের ডাক্তার তৈরি করতে থাকলে এ জাতির, এদেশের রোগীদের কি অবস্থা হবে ততটুকু ভাবনার বিবেক কোন পর্যায়েই নেই।
আমি বিভাগীয় প্রধান প্লাস ইন্টারনাল স্যারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ওরা এতবার পরীক্ষা দেয় তারপরও পারফরম্যান্স এমন কেন? স্যারের সোজা জবাব ঠিকঠাক বেতন না পেলে ভাল শিক্ষক কেন থাকবে?
অথচ মালিকপক্ষ কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য তো কম করছেনা।
মনে মনে বলি এসব দেখে কিভাবে আপনি সুস্থ থাকেন, কিভাবে প্রতি রাতে ঘুমান, কেন আপনি চাকরি ছাড়ছেন না? মুখে তো আর সরাসরি বলে দেয়া যায় না।
OSPE নামের যে পরীক্ষা হয় সেটা কলেজ কর্তৃপক্ষ আগেই নিয়ে নেয়, এক্সটার্নালদের কাজ পরে গিয়ে সেটা দেখা। সেটা যে একটা পাতানো খেলা সবার একই রকম উত্তরের pattern দেখে বলেই দেয়া যায়।
তাহলে মুক্তি কোথায়। আমি এতটাই বিব্রত ও ভারাক্রান্ত হয়ে গিয়েছিলাম যে আসার সময় সবাইকে ডেকে বলে এসেছি যে তোমরা অফিস টাইমের পরে আমাদের বিভাগে চলে আসবা, আমি তোমাদেরকে পড়াবো। তাদের চোখে মুখে হাসির ঝিলিক দেখে টের পেয়েছি তারা একটু শিক্ষার জন্য, একটু শেখার জন্য কতটা ক্ষুধার্ত, কতটা তৃষ্ণার্ত। তাদের প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই, শুধু মায়া ।
আর যে সীমার এই মেডিকেল শিক্ষাব্যবস্থাটাকেও বাণিজ্য ও অর্থ উপার্জনের উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছে, তাদের চেয়ে বড় চামার আর কে হতে পারে আমাকে বলে দিবেন?
এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন দায়িত্বশীল স্যারের সঙ্গে কথা বললে তিনি শ্লেষের সুরে বলেন তারা তো আরো seat বাড়ানোর জন্য আমার কাছে তদবির করতেছে।
যে সব অভিভাবকরা তাদের সন্তানদেরকে এইসব মেডিকেল কলেজগুলোতে ভর্তি করিয়ে দিচ্ছেন বা দিবেন তাদের প্রতি অভিসম্পাত। মেডিকেল শিক্ষার্থী এ সন্তানদের সব বঞ্চনা, বিষন্নতা, বনসাই হয়ে বেঁচে থাকা, রোগীদের ওপর অবিচার- এর সব দায় এই অভিভাবকদেরও নিতে হবে।
দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় সম্মুখে ঘনঘোর অন্ধকার, যার ছায়া ইতিমধ্যে পড়া শুরু হয়ে গেছে। নতুন নতুন গজিয়ে ওঠা জেলায় জেলায় কিছু সরকারি মেডিকেলের মান এখন অনেকটা এসব প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ গুলোর মতোই। শিক্ষক নেই, শিক্ষা নেই আছে শুধু হাহাকার ছাত্র-ছাত্রীদের মনে।
শিক্ষা বিশেষ করে চিকিৎসা শিক্ষা নিয়ে যে জাতি বাণিজ্য করার মানসিকতা পোষণ করে সেটা একটা অভিশপ্ত জাতি।
– ডা: আমিনুল ইসলাম, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, শিক্ষক
ছবি: অনলাইন হতে সংগৃহিত