নিজস্ব প্রতিবেদক ঢাকা থেকে
রাষ্ট্রীয় বাজেটে প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের জন্য বরাদ্দ বাস্তবসম্মত ও যথেষ্ট নয় এবং যে বরাদ্দ দেওয়া হয় তাও নানা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে যথাযথভাবে প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছায় না। নীতিগত ও আইনগতভাবে গুরুত্ব দেওয়া সত্ত্বেও বাস্তবে প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের কল্যাণে বিদ্যমান কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে এবং তা অন্তর্ভুক্তিমূলক নয় বলে মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এছাড়া, সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের ওপর নিয়মিত তদারকি ও নিরীক্ষা না হওয়ায় সেবা প্রদান কার্যক্রমে অনিয়ম-দুর্নীতি অব্যাহত রয়েছে। প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে ঘাটতি থাকায় অধিকাংশ প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তি মৌলিক মানবধিকার ও রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবর্গের অধিকার সনদ এবং টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের বিভিন্ন লক্ষ্য অনুসারে প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের কল্যাণ ও উন্নয়নে অন্তর্ভুক্তিতে যথাযথ পরিকল্পনা প্রণয়নে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের সংগঠনসমূহের মধ্যে সমন্বয় ও অংশগ্রহণের ঘাটতি রয়েছে। ‘উন্নয়নে অন্তর্ভুক্তি এবং প্রতিবন্ধিতা : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে উল্লিখিত মন্তব্য করেছে টিআইবি। অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, কর্মসংস্থান, পরিবহন, সার্বিক অবকাঠামো, সম্পদের ওপর সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা ও ন্যায়বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কার্যকর উদ্যোগের ঘাটতির কারণে উন্নয়নে প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তির প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে বলেও মনে করে সংস্থাটি।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান এবং গবেষণা তত্ত্ববধায়ক শাহজাদা এম আকরাম, সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার, গবেষণা ও পলিসি বিভাগ। প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ফারহানা রহমান। এছাড়া গবেষণা দলের অপর সদস্য ছিলেন গবেষণা ও পলিসি বিভাগের প্রাক্তন প্রোগ্রাম ম্যানেজার দিপু রায় এবং ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার নিহার রঞ্জন রায়। সংবাদ সম্মেলনটি সঞ্চালনা করেন টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মনজুর-ই-আলম।
প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের উন্নয়নে অন্তর্ভুক্তিতে সুশাসনের চ্যালেঞ্জসমূহ চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যে ডিসেম্বর ২০১৯ থেকে নভেম্বর ২০২০ গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে। মূলত গুণগত পদ্ধতি ব্যবহার করে তথ্য সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণ করা হয়েছে, তবে প্রয়োজন অনুযায়ী ক্ষেত্রবিশেষে সংখ্যাগত তথ্যও সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য সুশাসনের সাতটি নির্দেশক আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, সমন্বয়, অংশগ্রহণ, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, সংবেদনশীলতা ও অনিয়ম-দুর্নীতিসহ সংশ্লিষ্ট উপ-নির্দেশকের ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা যাচ্ছে যে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩, নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন ২০১৩, এবং সংশ্লিষ্ট বিধিমালা প্রণয়ন করা হলেও এগুলোর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যেমন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩ আইনটি কোন কোন আইনের ওপর প্রাধান্য পাবে তা সুনির্দিষ্ট করা হয়নি। এর ফলে ‘লুনেসি’ আইনে মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তিরা উত্তরাধিকারসূত্রে সম্পদ পাবে না উল্লেখ থাকায় বুদ্ধি-প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের উত্তরাধিকার সম্পদ থেকে বঞ্চিত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি থাকায় ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩’ বাস্তবায়নে প্রণীত কর্মপরিকল্পনা অগ্রসরে ধীর গতি দেখা যাচ্ছে। জাতীয় বাজেটে সংশ্লিষ্ট খাতের জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে আলাদাভাবে বরাদ্দ রাখা হয়নি, বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে ব্যয় হলেও সেটা এ খাতের প্রকৃত বরাদ্দ কী-না তা স্পষ্ট নয়। সামাজিক সুরক্ষার আওতায় মাসে ৭৫০ টাকা করে ১৮ লাখ প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিকে ভাতা দেওয়া হচ্ছে, যা জীবনধারণের চাহিদা পূরণে এবং প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তির সংখ্যা বিবেচনায় অনেক কম। অধিকাংশ সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিবন্ধীবান্ধব পরিবেশ ও বিশেষায়িত সেবা প্রদানের ব্যবস্থা নেই। প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তির সংখ্যা নিয়ে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সূত্রে ভিন্নতা রয়েছে। সরকারি পর্যায়ে প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের সঠিক পরিসংখ্যান নির্ধারণে বাস্তবসম্মত উদ্যোগ না থাকায় তাদের কল্যাণে কার্যকর উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আবার প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের জন্য আইন প্রণয়ন, কর্মপরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন পরিকল্পনা ও উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণে সকল ধরনের প্রতিবন্ধিতার বিষয়টিকে সমভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়না। অটিজম সর্ম্পকিত কার্যক্রমে তুলনামূলকভাবে অধিক গুরুত্বারোপ করা হয়।
প্রাপ্ত তথ্য মতে সমাজসেবার কার্যালয়সমূহে এবং বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক বিদ্যালয়ে জনবলের ঘাটতি সবচেয়ে বেশি। দৃষ্টি, বাক্-শ্রবণ প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে জনবল এবং সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে তত্ত্বাবধায়ক পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া দীর্ঘ সময় বন্ধ রয়েছে। এছাড়া বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকসহ অন্যান্য জনবলের চাকরি নিয়মিতকরণের অনুমোদনে ফাউন্ডেশন ও মন্ত্রণালয় কর্তৃক দীর্ঘসূত্রতা দেখা যায়। ফলে প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের নিয়মিত পাঠদান কম গুরুত্ব পাচ্ছে। প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রে থেরাপিস্ট এবং থেরাপিস্ট সহকারীদের একাংশের থেরাপি সংক্রান্ত বিশেষায়িত প্রশিক্ষণের ও প্রযুক্তিগত উপকরণ ব্যবহারে দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক বিদ্যালয়ে অনেকক্ষেত্রে পরিত্যক্ত জরাজীর্ণ টিনসেড ভবনে পাঠদান কার্যক্রম হয়। অনেক বিদ্যালয়ে সংলগ্ন মাঠ নেই, এবং থেরাপির জন্য ব্যবহৃত অধিকাংশ মেশিন অকেজো। প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় প্রতিবন্ধিতার ধরন অনুযায়ী বিদ্যালয় নেই, সরকারি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় পাঁচটি, সরকরি বাক-শ্রবণ প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় আটটি, এমপিওভুক্ত বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক বিদ্যালয় জেলার সদর উপজেলাকেন্দ্রিক।
প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের কল্যাণে বরাদ্দ নির্ধারণে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তি ও সংগঠনের মতামত গ্রহণে উদ্যোগের ঘাটতি বিদ্যমান। ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩’ বাস্তবায়নে প্রণীত কর্মপরিকল্পনায় উল্লেখিত বিভিন্ন উদ্যোগ ও প্রকল্প সংক্রান্ত তথ্যের ঘাটতি রয়েছে এবং প্রকাশিত তথ্য হালনাগাদ নয়। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে কমিটি সংক্রান্ত এবং সমাজসেবা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে বিগত ছয় বছরের বার্ষিক প্রতিবেদন না থাকায় প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কিত তথ্যের ঘাটতি রয়েছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে উপজেলা/শহর সমাজসেবা কার্যালয় এবং প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রে হালনাগাদ নাগরিক সনদ ও তথ্যবোর্ডে প্রয়োজনীয় তথ্যের ঘাটতি রয়েছে। অধিকাংশ শহর/উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ দায়েরের সুযোগ থাকলেও নির্ধারিত ফর্ম ও অভিযোগ গ্রহণের রেজিস্টার নেই এবং অধিকাংশ কার্যালয়ে অভিযোগ বাক্স নেই। ১৯৯৬-২০১৯ সালের মধ্যে প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের সেবা প্রদান কার্যক্রমের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত অধিকাংশ উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ে কোনো নিরীক্ষা হয়নি। এছাড়া সমাজসেবা মন্ত্রণালয়ের কোনো কার্যালয়ে ২০১৬ এর পরে নিরীক্ষা হয়নি। সমাজসেবা অফিসে গিয়ে আবেদন না করলে প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তি শনাক্তকরণের আওতায় আসে না এবং বাড়ি বাড়ি যেয়ে শনাক্তকরণ কার্যক্রম কয়েকবছর ধরে বন্ধ রয়েছে। সরকারি হাসপাতালসমূহের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডাক্তারদের একাংশ প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের চিকিৎসা দেওয়ার বিষয়ে সহমর্মী নন এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ডাক্তাররা বিরক্তি প্রকাশ করে থাকেন। প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের জন্য কোটা থাকলেও তা চাকরির বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশ করা হয় না এবং অনেক ক্ষেত্রে পাবলিক সার্ভিস কমিশনে দৃষ্টি প্রতিবন্ধিতাসহ প্রার্থীরা নানা ধরনের বৈষম্যের শিকার হন। আদালতে শারীরিক প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের প্রবেশগম্যতা তৈরির ক্ষেত্রে উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে।
গবেষণা অনুযায়ী গণপরিবহনে অনেক সময় নির্দিষ্ট সিটে প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের বসতে দেওয়া হয় না। প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তি ও তার অভিভাবক গণপরিবহনে চলার সময় খারাপ আচরণের সম্মুখীন হন। কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে দরিদ্র প্রতিবন্ধিতাসহ শিক্ষার্থীদের স্মার্ট ফোন না থাকায় অনলাইন পাঠদান কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারেনা। দীর্ঘদিন স্কুলের বাইরে থাকার কারণে যারা নিয়মিত বিশেষ বিদ্যালয়ে আসতো পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর তাদের স্কুল থেকে ঝরে পড়ার ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। সরকারিভাবে ২,৫০০ টাকার অর্থ সহায়তার কর্মসূচিতে তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তথ্যানুযায়ী, কোনো কোনো সরকারি হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডাক্তার ও তার সহকারীদের একাংশের বিরুদ্ধে প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণ কার্যক্রমে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫ শত টাকা নিয়মবহির্ভূত অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। উপজেলা/শহর সমাজসেবা কার্যালয়ে তথ্যভান্ডারে নাম অন্তর্ভুক্তকরণে ক্ষেত্রবিশেষে প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তি বা তার নিকট আত্মীয়ের কাছ থেকে ১০০-২০০ টাকা নিয়মবহির্ভূত অর্থ আদায় করা হয়। স্থানীয় সংসদ সদস্য, সচিবালয়, জেলা প্রশাসন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশ কর্তৃক তাদের আত্মীয়স্বজন ও পরিচিত জন প্রকৃত প্রতিবন্ধিতাসহব্যক্তি না হওয়া সত্ত্বেও সুবর্ণকার্ড প্রদানের জন্য সমাজসেবা কার্যালয়ে তদবির করে। যাদের সুবর্ণকার্ড দেওয়ার কথা নয় তাদেরও কার্ড দেওয়া হচ্ছে। ফলে প্রকৃত প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিরা সুবর্ণকার্ড পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিদের একাংশের বিরুদ্ধে সুবর্ণকার্ডের জন্য ১ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা নিয়মবহির্ভূতভাবে আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। মাঠপর্যায়ে প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের ভাতা পাওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে জনপ্রতিনিধিদের সদিচ্ছার ওপর। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ রয়েছে।
২০১৯-২০২০ অর্থবছরে যে নতুন ২ লক্ষ ব্যক্তি ভাতার আওতায় এসেছে ক্ষেত্রবিশেষে তাদের ভাতার অর্থের অংশবিশেষ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। প্রথমবার ভাতার বইয়ে সমাজসেবা কর্মকর্তার স্বাক্ষর লাগে বিধায় উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের কর্মকর্তা, সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তা এবং ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধিদের একাংশ অর্থ আত্মসাতের সাথে জড়িত থাকে। এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ভাতা প্রাপ্তির প্রথম কিস্তি পেতে ২৪ শতাংশ থেকে ৬৭ শতাংশ অর্থ আত্মসাৎ হয়ে থাকে। জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন কর্তৃক ক্রয়কৃত বিভিন্ন থেরাপি মেশিন এবং প্রতিবন্ধী শিশু ও ব্যক্তিদের জন্য সহায়ক উপকরণ নিম্নমানের, যদিও এ ধরনের ক্রয়ের জন্য যথাযথ আর্থিক বরাদ্দ থাকে। প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন শর্তসাপেক্ষে এনজিওদের আর্থিক সাহায্য দিয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে নিয়মবহির্ভূতভাবে ২০ হাজার থেকে ৭০ হাজার টাকা অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। সাহায্যপ্রাপ্ত অনেক এনজিও ফাউন্ডেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে যোগসাজশের মাধ্যমে অনুদান পেয়ে থাকে।
উন্নয়নে সকল নাগরিকের সমান অধিকার ও অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিতের ধারণা ও অঙ্গীকার প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে আমাদের প্রেক্ষাপটে যে প্রযোজ্য নয়, তার বাস্তব চিত্রটা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। আইন-নীতিগত ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ক্ষেত্রবিশেষে গুরুত্বপূর্ণ কিছু উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে, কিন্তু‘ বাস্তবে প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের কল্যাণে গৃহীত কর্মপরিকল্পনা ও বাস্তবায়নপ্রক্রিয়া যে অন্তর্ভুক্তিমূলক, তা বলা যাবে না উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “জাতীয় বাজেটে এ খাতের জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো বরাদ্দ নেই। বিচ্ছিন্নভাবে কোনো কোনো মন্ত্রণালয়ে কিছু ব্যয় করা হয়, কিন্তু সেটা পর্যাপ্ত ও সমন্বিত নয়। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওপর মূল দায়িত্ব, কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমরা দেখছি যে, মুদ্রাস্ফীতি ও প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের সংখ্যারবিচারে কিছু বরাদ্দ সাম্প্রতিককালে বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রয়োজনের তুলনায় তা পর্যাপ্ত ও অন্য মন্ত্রণালয়ের সাথে সমন্বিত নয়। জাতিসংঘ সনদের সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের সংগঠনসমূহ পরিচালনার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ বরাদ্দ থাকার কথা, সেটা আমাদের এখানে নেই। প্রতিবন্ধীভাতা যেটা দেওয়া হয়, সেটির পরিমাণ খুবই নগণ্য এবং তার আওতায় প্রায় ১৬ শতাংশ প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তি অন্তর্ভুক্ত নয়।”
প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের অধিকার সুরক্ষার কার্যক্রম মূলত সামাজিক সুরক্ষা ও কিছুটা অনুকম্পাসুলভ কার্যক্রমের মধ্যে সীমাবদ্ধ। প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিগণ আমাদের অনুকম্পা নয় বরং তাঁরা তাঁদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক সেটা চায়। তাঁদের অধিকারের ওপর ভিত্তি করে ন্যায্য অংশগ্রহণের মাধ্যমে উন্নয়ন কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হতে চায়। এই সুযোগটি করে দিতে হবে এবং আমাদের অনুকম্পানির্ভর মানসিকতার উত্তরণ ঘটিয়ে অংশগ্রহণমূলক কার্যক্রমের দিকে অগ্রসর হতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন ড. জামান। তিনি বলছেন, “আমাদের কাছে দুঃখজনক যে, প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণে সরকারি নীতি-নির্ধারণী থেকে কোনো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি, যার ফলে এ ক্ষেত্রে যারা রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধাসমূহ পাওয়ার কথা, অধিকার প্রাপ্তীর তাদের যে নিশ্চয়তা রয়েছে, সেটি যথাযথভাবে প্রতিপালিত হয় না। প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের পেশাগত উন্নয়ন ও সচেতনতামূলক কার্যক্রমের ক্ষেত্রে যারা কাজ করেন, তাদের প্রশিক্ষণ, কারিগরী দক্ষতার ভিত্তি অত্যন্ত দুর্বল, যা-ও হয় তা বাস্তবসম্মত ও পর্যাপ্ত নয় এবং প্রয়োজন ও চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। দক্ষতা ও যোগ্যতাসম্পন্ন জনবলের ঘাটতি রয়েছে। একদিকে দুর্বল অবকাঠামো ও লজিস্টিকস অন্যদিকে তা প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের জন্য অনুপযোগী, এবং সেখানেও তারা হয়রানির শিকার হন বলে অভিযোগ রয়েছে। বাজেট ও কর্মসূচী প্রণয়ন অংশগ্রহণমূলক নয়, একইভাবে রয়েছে তথ্যপ্রকাশে ঘাটতি।”
“প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসহ সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত ব্যক্তিদের সংবেদনশীলতার ঘাটতি অত্যন্ত বেদনাদায়ক বলে আমরা মনে করি। শুধু সংবেদনশীলতার ঘাটতিই নয় এমনকি বিরূপ আচরণের অভিযোগও রয়েছে। এমনকি আমরা দেখলাম যে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানে প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিগণ বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা ন্যায়বিচার প্রাপ্তী থেকে বঞ্চিত হন, বিশেষকরে নারী ও শিশুদের ক্ষেত্রে এই বৈষম্যের চিত্রগুলো আরো বেশি দৃশ্যমান। কোভিড-১৯ এর সেবাপ্রাপ্তীর ক্ষেত্রেও আমরা প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের বৈষম্যের শিকার হতে দেখেছি,” বলে মন্তব্য করেছেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক।
প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের ওপর নিয়মিত পর্যবেক্ষণ, তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ না থাকার ফলে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনা ঘটছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। সরকারি হাসপাতালে সেবা প্রাপ্তীর কার্যক্রম, তথ্যভাণ্ডারে অন্তর্ভুক্তি, সুবর্ণকার্ড প্রাপ্তী ও প্রতিবন্ধীভাতা প্রাপ্তীসহ বিভিন্ন প্রকার সেবাসমূহ, যেগুলো প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিগণ পাওয়ার কথা সেক্ষেত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার এবং নিয়মবহির্ভূতভাবে অর্থ প্রদানে বাধ্য হন বলে মনে করেন ড. জামান। তিনি বলেন, “অন্য যেকোনো খাতের ন্যায় এ খাতেও ক্রয়সংক্রান্ত কাজে যোগসাজশ ও দুর্নীতির দৃষ্টান্ত রয়েছে। এনজিওদের অনুদান প্রাপ্তীর ক্ষেত্রেও রয়েছে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ। সর্বোপরি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, অবকাঠামো এবং সম্পদের অধিকার ভোগ করার ক্ষেত্রে তাদের ন্যায্য প্রাপ্তী, ন্যায়বিচার ও অংশগ্রহণ নিশ্চিতের উল্লেখযোগ্য ঘাটতি বর্তমান, যার ফলে আমাদের যে উন্নয়ন প্রক্রিয়া তা প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্তিমূলক নয়।”
গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে ১৪ দফা সুপারিশ প্রস্তাব করছে টিআইবি– আইন ও বিধিমালার সময়োপযোগী সংস্কার এবং আইনের বাস্তবায়ন করতে হবে; জাতীয় বাজেটে প্রতিবন্ধিতা সংশ্লিষ্ট খাতের জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে আলাদাভাবে বরাদ্দ রাখতে হবে এবং চাহিদার নিরিখে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কিত বাজেট বৃদ্ধি করতে হবে; সকল ধরনের প্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট, ব্রীজ, গণশৌচাগারসহ সংশ্লিষ্ট সকল অবকাঠামো প্রতিবন্ধীবান্ধব করতে হবে; জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য পৃথক ইউনিট করতে হবে; প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় প্রতিবন্ধিতার ধরন অনুযায়ী বিশেষায়িত বিদ্যালয় এবং প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে; প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের সেবা প্রদানকারী সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ ও বিশেষায়িত প্রশিক্ষণের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে; প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণে স্বীকৃত আন্তর্জাতিক পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে; সকল ধরনের দুর্যোগকালীন সময়ে প্রতিবন্ধিতাসহ শিশু ও ব্যক্তিদের জীবনধারণের মৌলিকা চাহিদা পূরণে সরকারিভাবে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে; প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সমূহকে অন্তর্ভুক্ত করে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে; প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের উন্নয়নে অন্তর্ভুক্তিতে যথাযথ পরিকল্পনা প্রণয়নে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের সংঠনের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ ও সমন্বয় নিশ্চিত করতে হবে; সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট তথ্যবহুল করতে হবে ও তথ্যসমূহ নিয়মিত হালনাগাদ করতে হবে; প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের সেবা প্রদানকারী সকল কার্যালয়ে কার্যকর তদারকি এবং অনিয়ম-দুর্নীতি প্রতিরোধে জবাবদিহিমূলক নিয়মিত নিরীক্ষা নিশ্চিত এবং প্রতিবন্ধিতা সংশ্লিষ্ট সেবায় দুর্নীতির সাথে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।