প্রথম পর্ব
ফেব্রুয়ারি ২০২১। ভাষা আন্দোলনের উনসত্তর বছর পূর্তির মাস। বিগত উনসত্তর বছরের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অনেক অর্জনের পেছনে ভাষা আন্দোলনের অবদান ও প্রেরণা অনেকখানি। আমাদের ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ভ্রূণও ভাষা আন্দোলনের গর্ভেই তার বিকাশের সূচনা করেছিল। শিক্ষিত মধ্যবিত্তের ইতিহাস চর্চায় এ মতবাদ অনেকটা সর্বজনগ্রাহ্যতা অর্জন করেছে। অন্যদিকে ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক অবস্থান থেকে তুমুল তর্কবিতর্ক আজও চলছে। কিন্তু জনগণের ভূমিকার গুরুত্ব নিয়ে এ ধরনের বিতর্ক খুব একটা চোখে পড়ে না। কারণ সবাই এ বিষয়ে একমত যে, ‘জনগণের ভূমিকা তো’ রাজনৈতিক দল আর রাজনৈতিক নেতৃত্বের নির্দেশাবলি অনুসরণ করা। এতে আবার বিতর্কের অবকাশ কোথায়? বিতর্ক হতে পারে আন্দোলনের কোন নেতার কী ভূমিকা, কোন দলের কতখানি কৃতিত্ব এই সব প্রসঙ্গ নিয়ে। আমাদের ইতহাস চর্চায় এ বিতর্ক তেমন অবদান রা রাখলেও এ বিতর্কের ফলে ভাষা সৈনিকের তালিকা অন্তত বড় হয়েছে। এ সৈনিকরা আমাদের অত্যন্ত পরিচিত। এরা মধ্যবিত্ত, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষিত, কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের প্রকাশ্য বা গোপন সদস্য। ইতিহাসের বাটখারাতে বসিয়ে এদের ওজন নেয়ার কাজ ১৯৫২ সাল থেকেই শুরু হয়েছে। কেউ কেউ সজ্ঞানে ওজনে কারচুপিও করেছেন।
আমি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস চর্চার একটি অবহেলিত দিক নিয়ে আলোচনা করতে চাচ্ছি। যেমন ভাষা আন্দোলনে সাধারণ মানুষ, যাদেরকে আমরা সচরাচর জনগণ আখ্যা দিয়ে থাকি, তাদের ভূমিকা কী ছিল? আর কেনই বা তারা এ আন্দোলনে ব্যাপকভাবে অংশ নিল? যদি ‘৫২ সাল থেকেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের উম্মেষের দিনক্ষণ নির্ধারণ করতে হয় তাহলে সেই জাতীয়তাবাদের প্রাথমিক অবয়ব কেমন ছিল? এসব প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা খুব একটা চোখে পড়েনি বলেই উনসত্তর বছর পর এ দিকগুলি নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করতে চাচ্ছি।
প্রথমেই ধরা যাক জনগণের অংশগ্রহণের প্রশ্নটি। ১৯৪৭ এর আগস্ট মাসে জনগণের কাঙ্ক্ষিত পাকিস্তান এসেছে। বছর পার হওয়ার আগেই ‘৪৭-এর ১২ ডিসেম্বর ভাষা প্রশ্ন নিয়ে প্রথম সংঘর্ষ সংঘটিত হয় ঢাকা শহরের পলাশী ব্যারাকের সামনে বেলা এগারোটার পর। ‘মুকুল’ নামের একটি বাসে চড়ে প্রায় চল্লিশ জন লোক দুটো মাইকে রাষ্ট্রভাষা উর্দুর পক্ষে শ্লোগান দিতে থাকলে পলাশী ব্যারাক ও আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সামনে জড়ো হওয়া জনতার ভেতর থেকে একজন বাংলা ভাষার পক্ষে শ্লোগান দেয়। এতে উত্তেজিত হয়ে বাসের যাত্রীরা জনতাকে লাঠিসেঁটা দিয়ে আক্রমণ করে। এদেরকে অবশ্য সরকারি প্রতিবেদনে গুণ্ডা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে, সরকারি মহাফেজ খানায় রক্ষিত দলিলে আহতদের তালিকায় যাদের নাম পাওয়া যায় তারাই ভাষা আন্দোলনের নির্যাতনের প্রথম শিকার। তার মধ্যে একজন দারোয়ান, চারজন বাবুর্চি, দু’জন ছাত্র আর বাকি সবাই বিভিন্ন সরকারি অফিসের কেরানি। প্রতিবাদকারী ও নির্যাতিতদের সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থান সম্বন্ধে একটি ধারণা পাওয়া যায় এ বিবরণ থেকে।
তারপর ‘৫২-এর ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারির সংঘর্ষ। উল্লিখিত সংঘর্ষে শহীদদের তালিকাটা দেখা যাক; আবুল বরকত, ছাত্র; রফিকউদ্দিন, বাবার ছাপাখানায় কাজ করতেন; আবুল জব্বার, ছোট দোকান মালিক; শফিকুর রহমান, ঢাকা হাইকোর্টের কর্মচারী; ওয়াহিদুল্লাহ, রাজমিস্ত্রির ছেলে ও আবদুল আওয়াল রিকশাচালক (মোটর দুর্ঘটনায় শেষোক্ত দু’জনের মৃত্যু হয়েছিল বলে সরকারি দলিলে উল্লেখ করা হয়েছে, যদিও ওয়াহিদুল্লাহর মৃত্যুর কারণ সম্বন্ধে ‘বুলেটাঘাত’ উল্লিখিত আছে)। এছাড়াও তাজউদ্দিন আহমদের ১৯৫২-এর ফেব্রুয়ারি ২২, ২৩, ২৪, ২৫ তারিখে লেখা ডায়েরিতে উল্লেখ আছে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘটের কথা। অর্থাৎ কোনো সংগঠন ও নেতা-নেত্রীর নির্দেশ ছাড়াই ঢাকায় ও অন্যান্য স্থানে ধর্মঘট পালিত হয়। এই ধর্মঘটে নগর, বন্দর, গ্রামগঞ্জে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জনতার অংশগ্রহণ পরিলক্ষিত হয়। ফেব্রুয়ারির ২৩ তারিখে রাতে শহীদ মিনার তৈরি হয়। এই মিনারের নকশা প্রণয়নকারী মেডিকেল কলেজের তৎকালীন ছাত্র সাঈদ হায়দার উল্লেখ করেছেন মিনার তৈরি সম্পন্ন করতে দু’জন রাজমিস্ত্রি ছাড়াও ছিল অনেক ‘বয়-বেয়ারা’। এরাই ছিল সেদিনকার বড় কর্মী।
আর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে ২৯ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জের মর্গান হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষয়িত্রী মমতাজ বেগম ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করার জন্য ঐ দিন গ্রেফতার হন। গ্রেফতারের পর তাঁকে ঢাকায় স্থানান্তরের সময় বিপুল সংখ্যক জনতা চাষাড়া স্টেশনের কাছে পুলিশ ভ্যানের গতিরোধ করে। বদরুদ্দীন উমর লিখেছেন পুলিশ ভ্যান ঘেরাওকারীদের মধ্যে এক বিরাট অংশ ছিল ‘সাধারণ মানুষ’ যাদের সন্তানদের মর্গান হাই স্কুলে পড়ার সাধ্য নেই। তারা এত বিপুল সংখ্যায় মমতাজ বেগমের গ্রেফতারে বাধা দিল কেন?
দ্বিতীয় পর্ব
২১ পরবর্তী দিনগুলিতে সরকারের সাথে জনগণের সংঘর্ষ এতটা ব্যাপকতা লাভ করল যে সরকার একরকম বাধ্য হলো ভাষার দাবিকে স্বীকার করে নিতে। যে সময়ে পূর্ব বাংলার শতকরা ৮৫ জন লোক অক্ষরজ্ঞানহীন, সে সময় ভাষার দাবিতে সাধারণ মানুষ এ আন্দোলনে শরিক হলো কেন? শিক্ষিত মধ্যবিত্ত আর অক্ষরজ্ঞানহীন জনগণের ঐক্যের সূত্রটাই বা কি? আন্দোলনে জনগণের অংশগ্রহণের মাত্রাটাই বা কি? এটাই আমার আলোচ্য বিষয়। ভাষা আন্দোলন কি এতটাই খাঁটি সোনা যে তাতে কোনো খাদ ছিল না? শিক্ষিত মধ্যবিত্তের ভূমিকার ডঙ্কার শব্দে সাধারণ মানুষের কীর্তির দু’একটা ঢোলের বাড়িও কি শোনা যাবে না? ভাষা আন্দোলনে যে সমাবেশটা ঘটলো তাতে কি আরো কোনো প্রশ্ন ছিল? সমাবেশের যে আখ্যান তৈরি হয়েছে, বিশেষ করে বাংলাদেশ জাতি-রাষ্ট্র তৈরি হওয়ার পর, সে আখ্যানে ধস নামানোর মতো কোনো অভিজ্ঞতা কি আমাদের জাতীয় মহাফেজখানায় বা জীবিতদের অভিজ্ঞতায় রক্ষিত আছে? এ প্রশ্নগুলি অনুসরণ করলেই ‘জনগণ’ নামক ‘অশিক্ষিত’, ‘মূর্খ’, কুসংস্কারাচ্ছন্ন’দের কর্মকাণ্ড এবং তার অন্তর্নিহিত অর্থ ও সর্বোপরি তাদের চেতনার জগতটার কিছু পরিচয় পাওয়া যেতে পারে। বদরুদ্দীন উমর, যিনি ভাষা আন্দোলনের ওপর প্রামাণ্য তিন খণ্ড গ্রন্থ রচনা করেছেন, মনে করেন, ঢাকার বাইরে ব্যাপক গ্রামাঞ্চলে আন্দোলনের বিস্তার যেভাবে ঘটেছিল, তার থেকে প্রমাণিত হয় যে, ১৯৫২ সালে জনগণের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে বিভিন্ন মৌলিক সমস্যাগুলির সাথে ভাষা আন্দোলনের একটা গভীর ঐক্যসূত্র ইতিপূর্বেই স্থাপিত হয়েছিল। সেই ঐক্যসূত্র কিভাবে স্থাপিত হলো তার যৌক্তিক ব্যাখ্যা আমাদের ইতিহাস চর্চায় এখনো অনুপস্থিত। আমি শুধু শিক্ষিত মধ্যবিত্ত আর অশিক্ষিত কৃষক-শ্রমিকের প্রতিবাদের বিনুনীটি কিভাবে তৈরি হয়েছিল তার সম্বন্ধে একটা প্রাথমিক ব্যাখ্যার চেষ্টা করবো।
জাতীয়তাবাদ নিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, প্রাক-পুঁজিবাদী সমাজে জাতীয়তাবাদ তৈরিতে কৃষকের সাথে রাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব উচ্চবর্গের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের লড়াইতে কৃষকের সাথে ঐক্যের পরিসর তৈরি করে। ভাষা আন্দোলনের ব্যাপক জনগণের অংশগ্রহণের প্রশ্নটি গভীরে অনুসন্ধান করতে হলে উল্লিখিত বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা দরকার।
জনগণের ক্ষোভের পেছনে নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের খাদ্যনীতি, কৃষিপণ্যের বাজারদর, আমলা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে পুলিশের আচরণ আমাদের আলোচনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাত্ত। আমরা জানি যে, ‘৪৭ পরবর্তী সময়ে সারা পূর্ব বাংলায় খাদ্যভাবের জন্য কর্ডন-প্রথা, লেভি-প্রথা কৃষকদের জীবন বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। তার সাথে যোগ হয়েছিল পুলিশি ও আমলাদের জুলুম। একটা ছোট্ট পরিসংখ্যান থেকে পুলিশি জুলুমের চেহারাটা বোধগম্য হবে। ১৯৪৮ সালে ৯০ বার, ১৯৫০ সালে ১১০ বার আর ১৯৫১ সালে ৫০ বার, এ সময়ের সরকারি দলিলপত্রে পুলিশ-জনতা সংঘর্ষের নানা বিবরণ পাওয়া যায়। সামান্য কারণেই জনতা-পুলিশ সংঘর্ষেরও অনেক খবর আছে। ১৯৪৭ সালের ১৬ অক্টোবর দৈনিক আজাদ’র খবরে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জের কাছে মদনগঞ্জে প্রায় তিন হাজার লোক পুলিশের কাছ থেকে কর্ডন আইন ভঙ্গকারী প্রায় ২০০ নৌকা ছাড়িয়ে নেয়। এ সময়ের সরকারি দলিলপত্রে এ ধরনের অনেক ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়।
১৯৫২ সালে জনগণের কাছে আইন-শৃঙ্খলার কাজে নিয়োজিত পুলিশের কর্মকাণ্ড প্রায় বৈধতা হারিয়ে ফেলেছিল। অন্যদিকে ছিল কৃষি অর্থনীতির বিপর্যস্ত অবস্থা। ১৯৫২ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি তাজউদ্দিন আহমদ তাঁর ডায়েরিতে উল্লেখ করেছেন- [উল্লেখ্য যে, তাজউদ্দিন আহমদ ডায়েরিটি ইংরেজিতে লিখেছেন] Jute price unusually went down since middle of February, from an average of 40/- P.M. top and 28/- P.M. bottom to 25/-P. md top and 15-P. md bottom. Last year in these days any kind of jute was about 50 per maund, upto 65/- highest in village markets. (ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে পাটের মূল্য সাধারণভাবে মণপ্রতি গড়ে সর্বোচ্চ ৪০ টাকা ও সর্বনিম্নে ২৮ টাকা মণপ্রতি ২৫ টাকা ও ১৫ টাকায় নেমে এসেছিল। গত বছর এ সময় যে কোনো ধরনের পাটের মূল্য গ্রামের বাজারে মণপ্রতি প্রায় ৫০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৬৫ টাকা পর্যন্ত ছিল।) অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময় থেকেই পূর্ব বাংলার একমাত্র অর্থকরী ফসল পাটের দাম অস্বাভাবিকভাবে কমে যায়। তাজউদ্দিন আহমদ আরো উল্লেখ করেছেন যে, ভ্রান্ত সরকারি নীতির কারণে মধ্য কৃষক আর নিম্নমধ্য কৃষক ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে কৃষকের মনে এক বিরাট হতাশা বিরাজ করছিল। অন্যদিকে চালের দাম ছিল আগের বছরের মতো চড়া। ১৫ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছিল চাল। তাজউদ্দিন আহমদ লিখেছেন অর্থনীতির অবস্থা ছিল ভয়াবহ।
এই দলিল থেকে অর্থনীতি আর সমসাময়িক সরকারি ও বেসরকারি দলিলপত্র থেকে পুলিশের কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে অবহিত হলে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের ভাষার অধিকারের জন্য আন্দোলনে কৃষক-শ্রমিকের স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রণের যুক্তিটি আরো একটু স্পষ্ট হতে পারে। তখন বুঝতে অসুবিধা হবে না কেন শিক্ষিত মধ্যবিত্তের ভাষা আন্দোলনের মিছিলে কৃষক-জনতা শরিক হয়েছিল। তবে এই দুই শ্রেণির মধ্যে ঐক্যের সূত্রগুলি বুঝতে হলে আন্দোলনের ভাষা রূপক, চিত্রকল্প, ঐতিহ্যকে অনুধাবন করতে হবে। সর্বোপরি জনগণের চৈতন্যের স্বরূপকে বুঝতে হবে। ভাষা আন্দোলনের উনসত্তর বছর পূর্তিতে এই আলোচনার সূত্রপাত হবে বলে আশা করি।
– অধ্যাপক আহমেদ কামাল, ইতিহাসবিদ