বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ হবার প্রাক্কালে এই প্রশ্নটা খুব স্বাভাবিকভাবেই ভাবায়। প্রশমনবাদীরা বলেন, ৫০ বছর এমন কোন লম্বা সময় নয়। সভ্যতা গড়তে শত শত বছর লাগে। প্রশমনবাদীরা প্রবোধ দিতে এরকম অনেক মিথ্যা কথা বলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া রাষ্ট্র কাঠামো থেকে মাত্র তিনদশকে জার্মানি ও জাপান যেভাবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে; তাতে এইসব প্রবোধ দেয়া মিথ্যা ধরা পড়ে যায়।
জার্মানি ও জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন দেশ গড়ার যাত্রা শুরু করে; প্রায় একই সময় যাত্রা শুরু করে ব্যর্থ হয়েছে ভারত ও পাকিস্তান। দক্ষিণ এশিয়ার এই ব্যর্থ রাশিফলের পেছনের কারণ কে? রাষ্ট্র নাকি সমাজ? এর উত্তর; অবশ্যই রাষ্ট্র।
কিছু স্কুলের এসএসসি পরীক্ষার ফল ভালো হয়; কিছু স্কুলের ফল খারাপ হয়। ছাত্র কিন্তু একই সমাজ থেকে আসা। পার্থক্য গড়ে দেয় বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা আর এর শিক্ষকেরা। জার্মানি ও জাপানের সাফল্য আর দক্ষিণ এশিয়ার ব্যর্থতার পেছনের কারণও একই। জনগণ একই পৃথিবী গ্রহের; উন্নয়ন-অনুন্নয়ন, সুশাসন-অপশাসনের এই পার্থক্য গড়েছে রাষ্ট্রব্যবস্থাপনা ও নীতি নির্ধারকেরা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধাহত জার্মানি-জাপান প্রথম মনোযোগ দেয়; শিক্ষা ব্যবস্থায়। কারণ সুশৃংখল সমাজ গড়তে সুশিক্ষার কোন বিকল্প নেই। ভারত-পাকিস্তান ও বাংলাদেশে তাদের স্ব স্ব স্বাধীনতার পর সবচেয়ে অবহেলা করা হয়েছে শিক্ষা ব্যবস্থাকে। জার্মানি ও জাপানের নীতি নির্ধারকদের ছেলেমেয়েরা সেসব দেশের স্কুলে পড়তো; সেসব দেশের হাসপাতালে স্বাস্থ্য সেবার জন্য যেতো।
আর ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা উপনিবেশকে বিদায় করেই; নব্য ঔপনিবেশিকের রূপ নিয়ে এক একজন জমিদার হয়ে উঠলেন। তাদের ছেলেমেয়ে বিলেতে পড়তে যেতে লাগলো; তারা ছোট খাট হাইড্রোসিল অপারেশানে বিলেতের হাসপাতালে যেতে শুরু করলেন।
জার্মানি বেশ শিখে গিয়েছিলো; নেতাকে ঈশ্বরের মতো পূজা করলে সে “হিটলার” হয়। তার আশে পাশে জুটে যায় সহমত ভাই গোয়েবলস; মিথ্যার বেসাতি যার নিত্যকর্ম। তাই তারা আর নেতাকে দেবতা না বানিয়ে জনগণকে ক্ষমতায়িত করে। রাষ্ট্রের কাজ জনগণের সেবা করা; এই অনুশীলন স্থায়ী হলো রাষ্ট্রব্যবস্থাপনায়।
অন্যদিকে ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের জনগণের জীবন সেই তিমিরেই রয়ে গেলো। সরকারি অফিসে সরকারি সেবা নিতে গিয়ে তারা দেখলো; সাদা সাহেব বিদায় হয়েছে; কিন্তু কালা সাহেবেরা “স্যার ডাক শোনার আকুতি” নিয়ে বসে আছে। ঘুষ দিয়ে এই কালা দেবতাগুলোকে তৃপ্ত না করলে; জনগণের প্রাধিকার যে সেবা; তা পাবার জো নেই।
এই সব কালাদেবতা বেশ স্বাধীনতার সুফল চেবাতে চেবাতে বলতে থাকলো, দেশ স্বাধীন না হলে কী আমি কৃষকের ছেলে সাহেব হতে পারতাম। ও আমার স্বাধীনতা বলে ডুকরে কেঁদে উঠতে উঠতে মেট্রোপলিটানগুলোর প্লট বরাদ্দ নিতে থাকলো। সামরিক ও বেসামরিক কালা সাহেবেরা রাষ্ট্রের কোলে বসে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অপব্যবহার করে বেশ একটা এলিট সমাজের কেল্লাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলো।
রাজনীতিকেরা; নব্য জমিদারেরা যখন দেখলো; তাদের দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের আফিম জনগণ আর খায়না; তখন তারা ধর্মীয় নেতাদের ডেকে আনলো ধর্মের আফিম দিয়ে আদি ও অকৃত্রিম ভোট ব্যাংক তৈরি করতে। তাতেও কাজ না হলে; নির্বাচন প্রকৌশল করতে সামরিক ও বেসামরিক কালো সাহেবের বুলেট দেখিয়ে ব্যালট নিশ্চিত করতে; একটা কালা-এলিট চক্র গড়ে; গণতন্ত্রের এপিটাফ লিখে ফেললো; সাফল্যের শ্বেত পাথরে।
ব্যবসায়ীরা যারা রাজনীতিকদের ও আমলাদের ঘুষ দিয়ে ব্যবসার সুযোগ নিতো; তারা আবার ফিরে গেলো যেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যুগে। ব্যবসায়ীরা নিজেরাই আইন প্রণেতা হয়ে; বণিকের মানদণ্ডকে; রাজদণ্ডে রূপান্তর করলো।
এই যে বুলেট দেখিয়ে ব্যালট বাক্স ভরার গণতন্ত্র; সেইখানে দরকার বেসামরিক ফুট সোলজার। রাজনীতিকেরা শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোকে সেই ফুট সোলজারদের ব্যারাকে পরিণত করলো।
কেউ যদি প্রশ্ন করে, ছাত্র রাজনীতির নামে রাজনীতির ফুট সোলজার বানিয়ে তাদের বলি দিচ্ছেন কেন! অমনি রাজনীতিকদের পোষা প্রশমনবাদী ভিক্ষুক বুদ্ধিজীবীরা এসে বলতে শুরু করলো, আই হেইট পলিটিকস শেখাচ্ছেন কেন! রাজনীতি ছাড়া জীবন হয় কেমন করে!
এই পোষ্য বুদ্ধিজীবীদের নিজেদের ছেলেমেয়েরা বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে; ফলে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়কে পলিটিক্যাল ক্যাডার আর বিসিএস ক্যাডার তৈরির অচলায়তন করে রাখলে তাদের কোন ব্যক্তিগত ক্ষতি তো নেই।
স্বজনপ্রীতি ছাড়া যেখানে একটি পদায়নও হয় না; সেখানে যোগ্যতা শব্দটা সোনার পাথর বাটি। রাজনীতির ঈশ্বর হিটলারের আশীর্বাদ ছাড়া; রাজনীতির সহমত ভাই গোয়েবলসের রিকমেন্ডেশান ছাড়া; গবেষকও নিয়োগ হয়না যেখানে; সেখানে সভ্যতায় অবদান রাখার মতো কোন গবেষণা আর রইলো না। শুধু রইলো ইতিহাস ও স্তুতি গবেষণা। ‘গণদেবতা’র সম্মান প্রতিষ্ঠার স্তবসংকীর্তনই তখন শিক্ষা-সংস্কৃতি-সংগীত-চলচ্চিত্র।
“তৈলশিল্প”র বিকাশে তেলতেলে একটি অকর্ষিত মননের জনপদ গড়ে উঠলো; খর্বচিন্তার গণদেবতারা উন্নয়নকে তখন দেখতে ও দেখাতে শুরু করলো মুঘলাকৃতির কেল্লা নির্মাণের মাঝে। মানব সম্পদ উন্নয়ন হয়ে দাঁড়ালো; নগদ ও বিকাশের টেকাটুকার সুখন মিয়া সংস্কৃতি।
দক্ষিণ এশিয়ার স্বাধীনতার ৭০ বছরে কিংবা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরে; স্বাধীনতার আগে যে স্বদেশী; স্বাধীনতার পরে সে গোয়েবলস রাজাকার; স্বাধীনতার আগে যে মুক্তিযোদ্ধা; স্বাধীনতার পরে সে গোয়েবলস রাজবদর। অর্থাৎ ক্ষমতা কাঠামোর অংকশায়িনী হবার স্বপ্নই স্বাধীনতার এতোগুলো বছরে বিকশিত একমাত্র স্বপ্ন।
কাজেই অধুনা রাজবদর গোয়েবলসরা নানা অজুহাতে “সমাজ ব্যর্থ হয়েছে”-এই প্রপঞ্চ নিয়ে হাজির হয়; “রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়েছে”-এই নিষ্ঠুর সত্যকে লুকিয়ে রাখতে। এই কাজে খয়ের খাঁ ইতিহাসবিদেরা আছেন। আজকের মানবাধিকার লংঘন, দুর্নীতি, লুন্ঠনের সংকটের কথা হাজির করলেই; খয়ের খাঁ টাইম মেশিনে করে নিয়ে যায় ঔপনিবেশিক অন্ধকারের যুগের কল্প-গল্পে। “যন্ত্র ঐ একটাই-ষড়যন্ত্রসূত্রে”-র জীর্ণ বস্ত্র পরে রাজবদরদের ভাবখানা এমন; যেন এখন বিরাট “আমার মুক্তি আলোয় আলোয়” চলছে।
– মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার শিক্ষক
এডিটর ইন চীফ, ই-সাউথ এশিয়া