সৈয়দ আবুল মকসুদের কলাম পড়ে মুগ্ধ হতাম; এতো রেফারেন্স, এতো উইট, হিউমার তাঁর লেখায় থাকতো যে; মনে হতো বসার ঘরে সাদা চাদর পরে গল্প করছেন একজন পণ্ডিত। আবদুল গাফফার চৌধুরী আর সৈয়দ আবুল মকসুদের লেখা পড়ে জ্ঞানের জগতে নিজেকে ফাঁপা আর ফাঁকিবাজ প্রজন্মের কষ্টকল্পিত লেখক মনে হতো।
সিভিল সার্ভিসে যোগদানের পর জাতীয় বেতার ভবনে পোস্টিং হলে; সেখানে সৈয়দ আবুল মকসুদের মতো কিংবদন্তীর লেখকদের সঙ্গে দেখা হওয়ার সহজ সুযোগ হলো।
উনি বেতারে কথিকা পাঠে আসতেন। পত্রিকার মতোই একটা কলাম লিখে এনে পড়ে যেতেন। উনার সমবয়েসী বেতার আধিকারিকদের কারো কক্ষে বসে একটু চা-সিঙ্গাড়া খেতেন; আড্ডা দিতেন। তারপর ফিরে যেতেন।
উনি বেতারে এসে একবার তার বন্ধু বেতার আধিকারিক আলফাজ তরফদারের কক্ষে বসে আমাকে ডেকে পাঠালেন। আলফাজ স্যার বললেন, উনি আপনার কক্ষে গিয়েছিলেন; আপনি বোধ হয় খেয়াল করেননি।
আমি বুঝিয়ে যা সত্যি সেটাই বললাম, একসঙ্গে অনেক লেখক, কথক, শিল্পী এসে পড়ায়
উনার সঙ্গে সংক্ষিপ্ত সৌজন্য বিনিময় করেছি। আমি জানি উনি আপনার এখানে আড্ডা দিতে আসবেন; তাই উনার সময় নষ্ট করিনি।
সৈয়দ আবুল মকসুদ বাঁকা হাসি হেসে বললেন, রেডিওতে আমলা ঢুকানোর সিদ্ধান্ত যেদিন এসেছে; সেদিন থেকেই বুঝে গেছি; আলফাজদের অবসরের পর আর এখানে আসা যাবে না।
এরপর আলফাজ তরফদার চা ও সিঙ্গাড়া খাইয়ে আমাদের প্রজন্মের এই অতিরিক্ত ব্যস্ততা, দৌড়ে চলা, আর গো-গেটার স্বভাবের ওপর নাতিদীর্ঘ আলোকপাত করলেন।
সৈয়দ আবুল মকসুদ বললেন, আপনার লেখা ‘তির্যক রচনা’ প্রথম আলোতে পড়ি। নতুনদের মাঝে কে কেমন লিখছে; আমরা খেয়াল করি। আপনারা প্রবীনদের লেখা পড়ার সময় নিশ্চয়ই পাননা।
আমি নিশ্চিত করলাম, প্রথম আলোর উপসম্পাদকীয় পাতায় আপনার লেখা না পড়ে উপায় নেই। নতুন কী লিখলেন এটা জানার আগ্রহ আমরা পাঠকমাত্রই বোধ করি। ওটাই প্রধান আকর্ষণ।
উনি বললেন, আপনার তির্যক রচনা পড়লে বোঝা যায় রসটা আছে; কিন্তু বড্ড তাড়াহুড়ার মাঝে লেখা; এটাও ধরা পড়ে ; অফিসে বসেই লেখালেখি করেন হয়তো; একেবারে হাটের মধ্যে বসে।
এরপর আমি ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র শুনে; এটা পড়েছি ওটা পড়েছি কীনা; ওটা পড়ে থাকলে তা থেকে কী বুঝেছি; জিজ্ঞেস করলেন। প্রশ্ন করলেন, নাগরিক সমাজে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা আমার কাছে কেমন লাগে!
উত্তর দিলাম, ড ফস্টাসের মতো। এরপর গাম্ভীর্যের চাদর সরিয়ে হেসে ফেললেন তিনি।
আলফাজ তরফদার সমালোচনা করলেন, আমি এক্টিভিজম আর জার্নালিজমের পার্থক্য বুঝিনা। লিবেরেলিজমের ঝান্ডা নিয়ে দৌড়াতে গিয়ে অন্যান্য গীতিকারদের বাদ দিয়ে প্রতিদিন রবীন্দ্র সংগীত বাজাই; তা বাংলা অনুষ্ঠানই হোক আর ইংরেজি অনুষ্ঠানই হোক। শেষে একটা রবীন্দ্র সংগীত মাস্ট।
সৈয়দ আবুল মকসুদ বললেন, নৈর্ব্যক্তিকতা খুবই জরুরি। রবীন্দ্র-নজরুল- লালন-আব্বাসউদ্দীন সবার গানই বাজাতে হবে। এতে অনুষ্ঠানের মেজাজে পরিবর্তন আসবে।
“রবীন্দ্র অনুভূতি” আহত হলো আমার। আর আলফাজ তরফদার যতবার আমাকে বললেন সেকুলার; ততবার শোনা গেলো যেন ‘সেকুলাঙ্গার’। আমি অভিমান নিয়ে ফিরে এলাম।
এরপর যতবার দেখা হয়েছে সৈয়দ আবুল মকসুদ ততবার চলতি পথে মজার দু’একটি কথা বলতেনই। আর নিয়মিত উনার কলাম পড়তাম। গোগ্রাসে গিলতাম বলা যায়।
এরপর ইন্টারনেট মাধ্যম বিকাশের পর সেকুলারিজমের সোল এজেন্টদের কাছ থেকে জানলাম, সৈয়দ আবুল মকসুদ একজন বামাতি; উনি অসাম্প্রদায়িক নন। তখন সৈয়দ আবুল মকসুদকে আরো পড়তে শুরু করলাম; উনাকে বামাতি ধরে নিয়ে। একটা আলট্রা লিবেরেল অনুসিদ্ধান্ত নিয়ে।
একটা লোক ঠোঁট কাটা হলে দলীয় লোকেরা কেউ তাকে পছন্দ করেনা। সৈয়দ মুজতবা আলীকে যেমন, শান্তি নিকেতনে পড়ানোর কালে উনাকে পাকিস্তানের দালাল বলতো চুলকানি রায়েরা; আবার বগুড়া আজিজুল হক কলেজে পড়ানোর সময় একই সৈয়দ মুজতবা আলীকে ভারতের দালাল বলতো চুলকানিউদ্দিনেরা।
রম্য রচনার সমসাময়িক আরেক বরেণ্য লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদের ঠোঁট কাটা স্বভাবের কারণে অনেক আওয়ামী লীগের সমর্থক তাকে “বামাতি” ভাবতো। আর অনেক বিএনপির সমর্থক তাকে “গান্ধীবাদী” ভাবতো। জীবনাচরণে উনি গান্ধীর অনুসারী ছিলেন; এটা স্পষ্ট। সাদাসিধে পোশাক; অহিংস মনোভাব এদুটো জীবনব্যাপী চর্চা করেছেন তিনি।
নাগরিক আন্দোলনে ভারতের “আন্না হাজারের” মতো উপস্থিত হয়েছেন। আবার হিন্দু -বৌদ্ধদের ওপর হামলায় ছুটে গেছেন ঘটনাস্থলে। গান্ধীজী যেমন দাঙ্গা থামাতে নোয়াখালীতে এসেছিলেন; সৈয়দ আবুল মকসুদও ঠিক যেন তেমনি।
নিরাপোষ পণ্ডিত বলতে যা বোঝায়; তার ধ্রুপদী উদাহরণ তিনি। সহমত ভাইয়ের ঢোল বাজিয়ে উনাকে সারারাত ঘুমাতে না দিলেও; নির্ঘুম সৈয়দ আবুল মকসুদ তার ভিন্নমতের কথাটি বলেই ছাড়তেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বঙ্গভবনের একটি অনুষ্ঠানে দেখা হলে, প্রধানমন্ত্রী হাসতে হাসতে উনাকে বলেছিলেন, আমাদের মন্দটার কথা লিখুন; কিন্তু ভালোও যেন চোখে পড়ে। সৈয়দ আবুল মকসুদ শুধু হেসেছিলেন। যেভাবে খুশওয়ান্ত সিং ইন্দিরা গান্ধীর সামনে হাসতেন।
এরপর রঙ্গভবনের পিঠাপুলির আসরে আল-বাতাবি সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী থেকে ভাঁড় শাহেদদের কোলাহল; সেলফির সার্কাস বেড়ে গেলে উনি বোধ হয় আর যাননি। যেরকম বলেছিলেন, রেডিও’র শিল্পমনা আধিকারিকেরা অবসরে গেলে উনি আর যাবেন না সেখানে।
আমাদের মিডিয়া-রাষ্ট্রীয় সভাগুলোতে খরগোসদের হুটোপুটিতে; কচ্ছপেরা আর এসব জায়গায় যায় না। এতো দ্রুতগমনের উন্মাদনার যুগে একটা খাদি পাঞ্জাবি পরে; ওপরে একটা সুতির চাদর জড়িয়ে সৈয়দ আবুল মকসুদ বরং বইয়ের জগতে একটা স্থৈর্য্যের শান্তি খুঁজে নিয়েছেন।
সাহিত্য সভায় খলবল করা নক্সী পাঞ্জাবী পরা সভাকবি আর লাস্যময়ী শিল্পলতার প্রগলভ রেড কার্পেটে; আর কী সৈয়দ আবুল মকসুদ হাঁটেন!
তিনি তো সত্যজিৎ রায়ের “জলসাঘর” চলচ্চিত্রের ক্ষয়িঞ্চু জমিদার চরিত্রটির মতো; প্রজ্ঞার হাজার বিঘা জমিনের মালিক ছিলেন তিনি; তিনি তো বেগম আখতার শুনবেনই পঞ্চাশ-ষাট-সত্তরের সোনালী যুগের স্মৃতিদের সঙ্গে নিয়ে। সমবয়েসীরা একে একে চলে গেলে; নব্য সংস্কৃতি ঠিকাদারদের জমিদার হয়ে ওঠার যুগে একা হয়ে পড়েন সৈয়দ আবুল মকসুদের মতো মানুষেরা। যারা ডায়োজিনেসের মতো অহম বোধ নিয়ে বেড়ে উঠেছেন । দরকার হলে শাক দিয়ে রুটি খাবেন; তবুও সত্য কথাটি বলবেনই।
আর প্রতিদিন বিরিয়ানি খেতে “দেশপ্রেমের শাক দিয়ে নৈরাজ্যের মাছ ঢাকা” রাজবদর সভাকবি হবার জন্য তো আছেই প্রজ্ঞার জগতের ভিক্ষুকেরা; যারা গিয়ে থালা পেতে বসে পড়েন; গণতন্ত্রের রায় চৌধুরাণীদের বারান্দায়। রাজার বাড়ির জিয়াফতের লোভে; অমরত্বের আয়োজনের জিয়াফত মিস করবেন কেন সৈয়দ মকসুদের মতো এমন কাগজ-কলমের জাদুকর।
সৈয়দ আবুল মকসুদ এমন এক জাদুকর; যিনি কাগজ-কলমের জাদুতে আলো জ্বেলে দিতে পারতেন পাঠকের মনে।বাংলাদেশ মনীষার একে একে নিভিছে দেউটি; সৈয়দ আবুল মকসুদকে আমরা যেন মৃত জোনাকির থমথমে চোখের মতো দেখতে পাই; আমাদের স্বদেশ ও মানুষ ভাবনার ঊষর ও প্রায় অন্ধকার সময়ে। সে স্নিগ্ধ আলোয় পথ দেখা যায় এখনো।
– মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার শিক্ষক
এডিটর-ইন-চীফ, ই-সাউথ এশিয়া