“কুমির জীবনের ৮০ শতাংশ সময় ঘুমিয়ে কাটায়। মুখ হাঁ করে চোখ খোলা রেখেও ঘুমাতে পারে। মা কুমির বাসা বানায় পেছনের পা দিয়ে। জন্মের সময় কুমিরছানার ওজন ৬০ থেকে ৭০ গ্রাম হলেও ৩০ বছর বয়সে ওই কুমিরের ওজন হয় এক টন। দৈর্ঘ্যে ৫ থেকে ৬ মিটার লম্বা হয়।”
মুশতাক একদিন কুমির চাষের কথাটা তুলতেই; সবাই ভাবে লোকটা পাগল হয়ে গেছে। কেউ কেউ মুখ টিপে হাসে।
মামা বলেন, তোমাকে এককালে জিনিয়াস ভাবতাম; এখন দেখছি তুমি বদ্ধ ‘উন্মাদ’। বিলেতে থেকে গেলেই পারতে; দেশে ফিরে দিন দিন তুমি উদ্ভট হয়ে যাচ্ছো।
মুশতাক বিমর্ষ হয়, মামা আপনি কী জানেন; ১০০ বছর পর্যন্ত বাঁচে কুমির। চায়না, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে কুমিরের মাংসের বিশাল চাহিদা আছে। চামড়ার চাহিদা তো আরও বেশি।
ব্যাংক খেয়ে অবসরপ্রাপ্ত আরেক কংস মামা বলেন, ওসব কুমির-টুমির কিছু না, ব্যাংকের টাকা মারার ফন্দি এটি।
মামা তির্যকভাবে বলেন, কুমির বাঁচবে না, বাঁচলেও ডিম পাড়বে না। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হলেও এগুলো বিক্রি হবে না।
এইভাবে মুশতাকের আটবছর কেটে যায় এ সমাজকে বোঝাতে, আমি পাগল নই; আমি গবেষক।
চলতে থাকে কুমির চাষ; আর লিখতে থাকে “‘কুমির চাষির ডায়েরি”।
পাড়ার হিতাকাংক্ষী বলেন, লন্ডনে স্কলারশিপ নিয়া পড়তে গিয়া এই কুমির চাষ শিইখা ফিরলা ভাতিজা। তোমারে নিয়া স্বপ্ন ছিলো; তুমি বড় পজিশনে যাইবা; অনেক পাওয়ার হইবো; আমরা কমু মুশতাক আমাগো মহল্লার গর্ব।
সরকারি আপিসের ৩২ টি টেবিলে পিং পং বলের মতো ঘুরে ঘুরে; অবশেষে অনুমতি মিললে; কুমির চাষ করে বিদেশে ৬৭টি কুমির রপ্তানির পর; ‘পাগল’ তকমা ঘুঁচে গেলে; তখন কুমির চাষির ডায়েরির ভক্ত-রসিক পাঠকেরা তার নাম দেয়, “কুমির ভাই”।
নামটা ভালোই লাগে। কারণ ততদিনে কুমিরদের সঙ্গে মিশে কুমির ভাই বুঝে গেছেন, কুমির নিতান্ত নিরীহ প্রাণী; আসল কুমির বসবাস করে মেট্রোপলিটানের রঙ্গভবনগুলোতে। এরা ক্ষমতার কুমির, টাকার কুমির, মিথ্যার কুমির, প্রতারণার কুমির, লুন্ঠনের কুমির; প্রবঞ্চনার কুমির, লিপ সার্ভিস দেয়া ঝুম ঝুম বাজনদার কুমির। জনপদের সমস্ত স্বপ্ন গিলে খাওয়ার পর; রাত ঝুম ঝুম বাজনদার কুমিরেরা আসে; দেশপ্রেমের কুমিরের বাচ্চা কোলে নিয়ে। একই কুমির দেখিয়ে বলে; এটা জাতীয়তাবাদের কুমির, ধর্মপ্রাণতার কুমির, অসাম্প্রদায়িকতার কুমির, উন্নয়নের কুমির। লুন্ঠন কুমিরের সম্পদ পাচারের প্রতিবাদ করলে রাজবদর কুমির বলে, এসব মিছে অভিযোগ; সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে “যন্ত্র ঐ একটা ষড়যন্ত্র”।
পাওয়ার কাপল কুমিরেরা কেঁদে কেঁদে কুম্ভীরাশ্রু বর্জন করলে সহমত কুমির টিস্যু এগিয়ে দিয়ে বলে; নিশ্চিন্ত থাকুন; খাল কেটে কুমির আনার যুগ শেষ। এখন এক্যুরিয়ামে অতন্দ্র জেগে থাকে সাইবদর কুমির।
কুমির ভাই এইসব প্রতারক কুমিরের কুম্ভীরাশ্রু দেখে বিক্ষুব্ধ হয়। ফেসবুকে এইসব রং-বেরং-এর কুমিরদের ক্ষমতার একুরিয়ামে হাকালুকি করতে দেখে আর্তনাদ করে, এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়। আমার খামারের কুমিরেরা আজকাল ভয় পায়; সাদা পোশাকের কুমির দেখে; কালো পোশাকের কুমির দেখে, সাইবদর কুমির দেখে; যারা একটি “গুম-কুমির” চক্র বানিয়েছে। এইভাবে ভিক্ষুক থেকে টাকার কুমির হয়েছে। এখন সেইসব টাকা পাচার করে বিলেতের বেগম পাড়ায় কুমিরের বাচ্চা ফোটাতে যায়। সেইসব বাচ্চা কুমির ফিরে জমিদার রত্ন কুমির হবে। তখন আর কেউ চিনতে পারবে না; এরা আসলে সেই ফকিন্নি কুমির; যারা কুড়াল দিয়ে সবুজ বৃক্ষ কেটে নৌকা বানিয়ে গর্বভরে বলে, “উই আর ক্রোকোডাইল’স মেন।”
কুড়াল হাতে নৌকার ওপর দাঁড়িয়ে পায়ে নুপুর বেঁধে ঝুম ঝুম করে নেচে সঙ্গী বাজনদারদের বলে, এইসব হত্যা; এইসব গুম ক্রোকোডাইল ফার্মের আরেক মুক্তির যুদ্ধ। ষড়যন্ত্রের বিষ দাঁত ভেঙ্গে পৃথিবীর সেরা ক্রোকোডাইল ফার্ম গড়তে; কিছু রক্ত-কিছু নরমুন্ডু চাই। ক্রোকোডাইল সিভিলাইজেশানের বিকাশে এমনটা পৃথিবীর সব জায়গায় ঘটেছে।
এসবের প্রতিবাদে কুমির ভাই “উই আর ক্রোকোডাইলস” নামের একটি পেজ চালাতে শুরু করে ফেসবুকে। সাইবদর কুমিরেরা তখন ক্রোকোডাইল এক্ট দেখিয়ে কালো পোশাকে তিনটি তারা আঁকা কুমিরকে অভিযোগ করে বলে, গ্রেফতার করুন কুমির ভাইকে; সে ক্রোকোডাইল ফার্মের ট্রেইটর।
অমনি কুমির ভাইকে গ্রেফতার করে তার ইলেকট্রনিক ডিভাইস জব্দ করা হয়। অভিযোগ উত্থাপিত হয়, কুমির ভাই বাহুবলি ও হনুমানদের সঙ্গে চ্যাটিং করেছে। এতে আশংকা জাগে, ক্রোকোডাইল ফার্মটাকে গন্ধমাদন পর্বতের মতো তুলে নিয়ে যাবে তারা। “যন্ত্র ঐ একটাই; ষড়যন্ত্র”; সুতরাং কুমির ভাই নিক্ষিপ্ত হয় যন্তর মন্তর ঘরে।
সাদা পোশাক, নীল পোশাক, কালো পোশাকের কুমিরেরা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে, সেকুলাঙ্গার কুমিরেরা এসাইলাম নিয়া বিলেত যাইতেছে; আর আপনি বিলেত থাইকা ফিরে কুমির চাষ করছেন! দেখলেই তো বোঝা যায়; মিশন ক্রোকোডাইলে আসছেন। আপনের কুমির দিয়া আমগো ক্রোকোডাইল সোসাইটিটারে খাওয়াইয়া দেওয়ার বন্দোবস্ত করতেছেন।
ফেসবুক মেসেঞ্জারের চ্যাটের আলাপের ওপর নির্ভর করে চার্জশিট দাখিল করে সাইবদর কুমিরেরা। সাব্যস্ত হয়; কুমির ভাই ক্রোকোডাইল ফার্মদ্রোহী। কুমির ভাই তেমন কোন সেলিব্রেটি নন যে; তার মুক্তির জন্য বড় কোন আন্দোলন হবে। আর সংস্কৃতি কুমিরেরা রঙ্গভবনের পিঠা ভাগাভাগির আসরে বুঁদ থাকায়; যন্তর মন্তর ঘরে যে যায়; সে যায়।
কুমির ভাইয়ের অসহায় স্ত্রী কল্পনাও করতে পারেননি; জনপদে এতো কুমির কিলবিল করছে! তাহলে আর কুমিরের খামার করে কুমির চাষের কোন প্রয়োজন পড়তো না। যন্তর মন্তর ঘরে কুমির ভাইয়ের সঙ্গে বার বার দেখা করতে গিয়ে ফিরে আসেন। কালো পোশাকের কুমিরেরা ধমক দেয়। সাদা শাড়ি পরার প্রস্তুতি নিতে বলে।
এইভাবে কুমির ভাইয়ের স্ত্রী মানসিক ভারসাম্য হারালে; কুমির ভাই স্বগতোক্তির মত বলেন, “ভাই পলায়নে যাবে বোন তার বাসনা হারাবে আমি জানতাম
ফুল ফুটবে না, ফুল ফুটবে না, ফুল আর ফুটবে না, ফুল আর কখনো
ফুটবে না!
বকুল-বৃক্ষদের এইভাবে খুন করা হবে সব গীতিকার পাখিদের
এইভাবে গলা, ডানা স্বরলিপি শব্দের পালকগুলি
ভেঙে দেওয়া হবে আমি জানতাম
তিতির ও ঈগল গোত্রের সব শিশুদের এইভাবে ভিক্ষুক পাগল
আর উন্মাদ বানানো হবে”।
ক্রোকোডাইল ফার্মের রাজবদর কুমিরেরা কবিতাকে ঘৃণা করে। কবিতা শুনলে তাদের মাথায় রক্ত উঠে যায়।
আদালত কুমিরেরা হাজার হাজার কোটির লুটেরা কুমিরদের জামিন দিলেও; এই সাইবদরদের কল্পনার ক্রোকোডাইল ফার্ম দ্রোহীর জামিন দেয় না কিছুতেই। সাইবদর কুমির, রাজবদর কুমির, সাদা-কালো পোশাকের কুমির, আদালত কুমির সবাই একই বাজনদার; ক্রোকোডাইল ফার্মের চৌকিদার।
কুমির ভাইয়ের মৃতদেহটি যখন নিথর স্ট্রেচারে পড়ে থাকে; তখন তার সেই উত্তর ফ্রান্সে দেখা জীবনদায়ী ফার্মের শ্যামল স্বপ্নেরা কিংবা প্রতিবাদহীন-সুরহীন মানুষ নয়; প্রতিবাদী সুরের পাখিদের চিড়িয়াখানা তৈরির স্বপ্ন এসে তাকে জাগায়।
ক্রোকোডাইল ফার্মের ডোম কুমির তাচ্ছিল্য করে বলে, ময়নাতদন্তের ময়না পাখি যখন খাঁচায়; তখন উনি আইছে সুরের পাখির চিড়িয়াখানা বানাইতে। ময়না তদন্তের ময়না পাখীরা তাচ্ছিল্য করে নিথর দেহটিকে বলে, ভুয়া ভুয়া।
কুমির ভাইয়ের মৃতদেহ তখন উঠে বসে বলে, হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণার জন্য আমার খামারের কুমির নিয়েছে; তবুও তোমরা আমাকে ভুয়া বলছো ভাই!
ডোম কুমির হাসে; তার পাশে দাঁড়িয়ে সাদা পোশাক কুমির কাশে; হঠাত তার মোবাইল রিঙ্গার টোনে বড় কুমিরের ফোন আসে। রিঙ্গার টোনে বাজতে থাকে “বি কেয়ার ফুল বি কেয়ারফুল; ক্রোকোডাইল ফার্মের উন্নয়ন; আমাদের দুই নয়ন।”
– মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার শিক্ষক
এডিটর-ইন-চীফ, ই-সাউথ এশিয়া