৭ মার্চে বাংলাদেশের দুটি জায়গায় নির্ধারিত অনুষ্ঠানের পর রাতের ভক্ত পুলিশ, সাংবাদিক, সহমত ভাইদের দুটি নৃত্যানুষ্ঠান চোখে পড়লো। পুলিশ নিয়ে জনগণের অনেক অভিযোগ; সুশীল সমাজ সুযোগ পেলেই বলেন, পুলিশ আজো জনগণের বন্ধু হতে পারলো না। পুলিশ প্রধান এরকম পুলিশ সমালোচকদের মুখে ছাই পড়ুক এমন বক্তব্য দেয়ার ক’দিন পরেই; পুলিশ-জনতা ভাই ভাই হয়ে; “দিস ইজ দ্য ট্রিবিউট টু তালাইভাহ; বা বড় ভাইয়ের জন্য শ্রদ্ধা” শীর্ষক নৃত্য করেছেন অল দ্য রজনী ফ্যানস নিয়ে।
বড় ভাই বা তালাইভা ব্যাপারটা আমাদের জাতীয় জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। ফেসবুকে “বড় ভাই”-এর সঙ্গে সহমত ভাইয়ের সেলফি; কিংবা আল-জাজিরার ‘সামান্যচিত্রে’ ভাইয়ের জন্য ভাইয়ের যে সুগভীর টান নিয়ে মরমী সংগীত বেজেছে; তাতে ক্ষিপ্ত হয়ে আল-বাতাবির ‘অসামান্য চিত্রে’ সাংবাদিকতার তালাইভাহ “ভাইরে এ এ এ এ এ; ভাইয়ের সঙ্গে ভাইয়ের সম্পর্ক কী কখনো অস্বীকার করা যায়;” বলে কতনা অশ্রুজলে ভেসেছেন।
অথচ রজনী ভক্ত পুলিশ-জনতা-সহমত ভাইয়ের এই যে নেচে নেচে তালাইওয়াহ’র প্রতি এই গভীর প্রণতি মাখানো নৃত্যানুষ্ঠান; তা নিয়ে ‘অনুভূতি’ প্রবণ সংস্কৃতি- তালাইভাহ ও ধর্ম-তালাইভাহরা ভীষণ সমালোচনা করেছেন। ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে বিবেচিত হয়েছে এই লুঙ্গি ডান্স।
লুঙ্গি বাংলাদেশের জাতীয় পোশাক; দক্ষিণ এশিয়ার সর্বত্র সবচেয়ে জনপ্রিয় ও আরামদায়ক পোশাক এই লুঙ্গি। ইন্দোনেশিয়ার তালাইভারা লুঙ্গি পরে জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দেয়। অথচ বাংলাদেশের তালাইভারা সেখানে যান বৃটিশ পোশাক স্যুট-কোট-টাই পরে। অনার্যদের পোশাক ভেবে বড্ড অবহেলিত দক্ষিণ এশিয়ার সাংস্কৃতিক যোগসূত্রের পোশাক লুঙ্গি। রজনী বা রাত ভক্তদের লুঙ্গি ডান্স; হয়তো শেকড় সঞ্জাত সাংস্কৃতিক টানাপোড়েন। সংস্কৃতির তালাইভারা তা বুঝতে পারেন না। মনে করেন, নক্সী পাঞ্জাবী পরে হারমোনিয়াম বাজিয়ে পিঁ পিঁ করে নজরুল-রবীন্দ্রনাথ-দেশের গান গাওয়াটাই বিশুদ্ধ সংস্কৃতির প্রতীক; স্বদেশ চেতনার মূর্ত প্রতীক। আর ঐসব সাংস্কৃতিক জলসায় চেতনাহীন লোকেদের “পাকি বলে ফতোয়া দেয়াটাই” আজকের “পাকি ফ্যাক্টরি”। ওদিকে ধর্মের তালাইভাহ-রা মনে করেন, পাঞ্জাবির শেরওয়ানি পরে হেলিকপ্টার থেকে নেমে গিয়ে ওয়াজিটিউবারদের মতো রেগে রেগে ফতোয়া দেয়া; একে ওকে নাশতেকের উপাধি দেয়ার এই “নাস্তিক ফ্যাক্টরিটিই বাংলাদেশ”। আরেকদল ভাষা তালাইভা বাংলাভাষার প্রতি অবহেলা করে হিন্দি ভাষার গানে মজে যাওয়া লুঙ্গি-ডান্সারদের “ভারতের দালাল” বলে কষে ফতোয়া দেবার “ভারত-ফ্যাক্টরি”-ই আজকের বাংলাদেশ।
অথচ “চেন্নাই এক্সপ্রেস” ছবির লুঙ্গি ডান্স আর এই “উন্নয়ন এক্সপ্রেসের” মঞ্চে দাঁড়িয়ে ৭ মার্চের লুঙ্গি ডান্স কতটা প্রতীকী তা অনুধাবনে ব্যর্থ রক্ষণশীল বিশুদ্ধতাবাদী তালাইভারা; যারা বাস করেন শূচিতার ইউটোপিয়া আর ভ্রান্ত অধ্যাসের মাঝে। ৭ মার্চের এই দেশজ লুঙ্গিডান্সে; বড় ভাইদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে, “মুছোকো থোড়া রাউন্ড ঘুমাকে; আন্নাকে য্যায়সা চশমা লাগাকে; কোকোনাটমে লাচ্ছি মিলাকে; আ যা ও সারে মুড বানাকে; অল দ্য রজনী ফ্যান্স; ডোন্ট মিস দ্য চান্স;” এটা যে রজনীর গণতন্ত্রের কী সুগভীর উদযাপন; তা বুঝতে অনাগ্রহী বিশুদ্ধতাবাদ তালাইভারা; যারা পিউ-পাপিয়ার ওয়ানটন জলসাঘরে যান; জিডিপির হিপ থ্রো বডি থ্রো দেখেন; অথচ প্রান্তিক মঞ্চে, রজনীর গণতন্ত্র ভক্তদের হিপ থ্রো বডি থ্রো দেখে তারা ছ্যা ছ্যা করছেন। নিওএলিট তালাইভা’রা বড্ড বিরক্ত হচ্ছেন; তাদেরই ফুটসোলজাররা বিশ্বকে তাক লাগানো উন্নয়ন প্রসঙ্গে যখন বলছে; “ডিসকো মে যাব এ গানা বাজেগা; অন দ্য ফ্লোর আনা পড়েনা; লুঙ্গিকো উঠানো পড়েগা; স্টেপল করকে দেখানা পড়েগা।” সত্য একদিন উন্মোচিত হবেই; লুঙ্গি উঠানো যেন তারই প্রতীক। তবে পিউ পাপিয়ার সত্য স্টেপল করে দেখাতে হবে; যাতে তালাইভা বা বড় ভাইদের বেইজ্জতি না হয়। কত ভালো এই ছোট খাট সহমত ভাইয়েরা; তালাইভা’র লুঙ্গি তুললেও স্টেপল করে ইজ্জত ঢেকে রাখার দায়িত্বশীলতা তাদের আছে; এমনকী উন্নয়নের এতো নারিকেল আর লাচ্ছি মিশিয়ে খেয়েও।
রাতের ভোটার এরা; গণতন্ত্রের কবরকে দুই নয়নের জলে ভিজিয়ে রেখেছে; উন্নয়নের প্রতিটি স্প্যান পুঁতার সময় ফেসবুক ভাসিয়েছে কতনা অশ্রুজলে; দিবসগুলোতে মঞ্চ সাজানো; ব্যানার ও মাইক লাগানো; তালাইভা-দের সিংহাসন তুলে এনে বসানো; ফুলেল সম্বর্ধনা দেয়া; তালাইভা’র বক্তব্যে্র লাইনে লাইনে হাত ব্যথা করা হাততালি দিয়ে; হেলমেট পরে-হাতুড়ি দিয়ে তালাইভা’র শত্রুদের সাইজ করে দেয়া; তালাইভার সঙ্গে ভিন্নমত প্রদানকারীদের গুম করে দেয়া; কারাগারে হত্যা করা; এইসব ছোট খাট মানুষের ঈশ্বরেরা তালাইভাহ ঈশ্বরের আধিপত্য ও রাজত্ব-জমিদারি টিকিয়ে রাখতে জীবনবাজি রেখে চলেছে; অথচ দিনশেষে রাতের বেলায় সেই তালাইভা’র উন্নয়ন এক্সপ্রেসে একটু হিপ থ্রো বডি থ্রো করে; লুঙ্গি ডান্স করার অধিকারও যেন তাদের নেই।
এরকম তীব্র সমালোচনা হবে তা জানে এই রজনী ভক্তরা; মনিব কখনো চাকরের সুখ সহ্য করতে পারেনা; এ যে শ্বাশ্বত সত্য। তালাইভাহরা মনে করে ‘লিবিডো’ বা ‘পাপিয়া’ যেন শুধু তার একান্ত অধিকার। কেষ্টা বেটা কেন লুঙ্গি ডান্স করবে; তার পাপিয়াকে সঙ্গে নিয়ে! ব্রান্মণ্যবাদ আর আশরাফবাদের কলোনিয়াল হ্যাঙ-ওভার খুব স্পষ্ট নিও এলিট তালাইভাদের মাঝে। রাতে ভোট দেয়া যাবে; কিন্তু রাতে নাচলেই; যত দোষ নন্দ ঘোষ।
তাই রজনীভক্ত ভোটার-পুলিশ-সাংবাদিক-উন্নয়নের সহমত ভাইয়েরা গানে গানে বলেছে, “নাইট কেলাবমে আয়া ম্যায়তো; মুঝকো রোখেগা কোন অর ক্যায়কো; মেরা মুড মে ডান্স করেগা; কিসিকা ড্যাডিসে নেহি ডরেগা; যিসকো যোভি হায় করনা ও কারলো; ইধার হি মে হু খাড়া পাকাড়লো; ঘর পে যাকে তুম গুগল করলো; মেরে বারেমে উইকিপিডিয়ামে পাড়লো।”
সত্যিই তো গুগল আর উইকিপিডিয়ার পাতায় পুলিশ-সহমত ভাই-হাতুড়ি ভাই-রাতের ভোটার, আল-বাতাবি সাংবাদিকের তালাইভার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে; তাকে খুশী রাখতে গণতন্ত্র ও উন্নয়ন পরিষেবার অযুত কথা লেখা; চর দখলের লড়াইয়ে কতনা রক্ত-কতনা অশ্রুজল এই বীর ফুটসোলজারদের। তালাইভাতো সিংহাসনে বসে শুধু হুকুম দেয়; জীবন পানি করে তালাইভার জমিদারির সূচাগ্র মেদিনী ধরে রাখতে হয় এই রজনীভক্ত লুঙ্গিডান্সারদের।
তালাইভা নিজেদের ছেলেমেয়েদের কেল্লার আদরে টেডি বিয়ারের অপত্য স্নেহে গড়ে তোলে; তারা তালাইভার দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের চাঁদা তুলে আনা সম্পদে বিদেশে পড়ে; ডিসকোতে গিয়ে নাচে; ক্যাসিনোতে জুয়া খেলে। আর জমিদারির জিজিয়া কর আদায়কারী “কেল্লার বাইরে পড়ালেখার সুযোগ না পেয়ে অনাদরে বেড়ে ওঠা” ফুটসোলজার একটু নারকেলের পানির সঙ্গে লাচ্ছি মিশিয়ে খেয়ে উন্নয়ন এক্সপ্রেসের মঞ্চে দাঁড়িয়ে লুঙ্গিডান্স করলেই মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় যেন।
বঙ্গবন্ধুর ছবি দেয়ালে টাঙ্গিয়ে; বঙ্গবন্ধু প্রেমের বিশুদ্ধ কীর্তন গেয়ে শেয়ার বাজার-ব্যাংক গিলে খেলে দোষ নেই; এক দশকে হাজার কোটি টাকার মালিক হলে দোষ নেই। দেশের ওই ছোট খাট মানুষের ঈশ্বর কৃষক-শ্রমিকের অর্জিত টাকা শুধু ক্ষমতার কলমের খোঁচায় হাওয়া করে দেওয়া; বিদেশে টাকা পাচার করা ঈশ্বর তালাইভা’র ফেসবুক কাভারে বঙ্গবন্ধুর ছবি শোভা পায়। তাতে যেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বুক বিদীর্ণ হয়না; তাঁর স্বপ্নের অমর্যাদা হয়না। আর বঙ্গবন্ধুর ছবি টাঙ্গানো মঞ্চে অনাদরে বেড়ে ওঠা অনাথ পলিটিক্যাল ফুটসোলজার দলিত শিশুরা লুঙ্গিডান্স করলে; আর তালাইভা’র মতোই স্লামডগ মিলিওনিয়ার হবার স্বপ্ন দেখলেই বুঝি শুধু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর অবমাননা হয়!
– মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার শিক্ষক
প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া