ফ্রান্সে গিয়ে দাগেস্তানের এক সাংবাদিক শুনতে পায়; দাগেস্তানেরই এক চিত্রকর প্যারিসে বেশ সুনাম কুড়িয়েছে। সাংবাদিক তার সঙ্গে যোগাযোগের আগ্রহ প্রকাশ করলে; চিত্রকরের সঙ্গে দেখা হয়; কথা হয়। চিত্রকর অনুরোধ করে, দাগেস্তানে ফিরে গিয়ে তার মাকে জানাতে; তাঁর সন্তান বেঁচে আছে!
ঐ চিত্রকর যুবক দাগেস্তানের সমাজে-শাসনব্যবস্থায় পদে পদে পরাধীনতার শেকলে পা আটকে যেতে যেতে খুব অল্প বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলো। ছোট বেলা থেকেই ছবি আঁকার শখ থাকায়; সে নিবিষ্টমনে ছবি আঁকতো। কেউ বলতো, মানুষের ছবি এঁকোনা; শুধু প্রকৃতি আঁকো; আমাদের ধর্মে মানুষের ছবি আঁকা হারাম। কেউ বা আদিম কারাগার আইন বা হত্যা আইনের ভয় দেখিয়ে বলতো, খল শাসকের ব্যাঙ্গ-চিত্র এঁকোনা; খল প্রভাশালীদের নিয়ে হাসাহাসি করো না। এখানে হাসতে মানা। সে দাগেস্তানের এই অবরুদ্ধ চিন্তার সমাজ দেখে টের পেয়েছিলো; এই পুরো দাগেস্তানই এক রুদ্র কারাগার; চিন্তার এই জেলখানায় থাকলে; মুক্তির স্বাদ কখনোই মিলবে না।
কিশোরটি হারিয়ে গেলে, তার পরিবারের সবাই ধরে নেয়, সে মারা গেছে; শুধু তার মায়ের মনে আশার কুহক ছিলো; হয়তো বেঁচে আছে আমার সন্তান।
দাগেস্তানে ফিরে সাংবাদিক ঐ প্যারিসে স্বেচ্ছা নির্বাসনে থাকা চিত্রকরের মায়ের সঙ্গে দেখা করে জানায়; তার ছেলে প্যারিসে বেঁচে আছে। সে এখন একজন বিখ্যাত চিত্রকর।
মা অত্যন্ত খুশী হন। আনন্দের অশ্রুতে তিনি সন্তানকে শুধু এক নজর দেখার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন। তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করেন, তার ছেলের সঙ্গে কী কী কথা হলো।
সে দাগেস্তানের গোলাপি রোদ, শীতল জল- হাওয়া, ফেলে যাওয়া ঘর; সেই ঘরের জানালা দিয়ে দেখতে পাওয়া স্মৃতির মিনার; আর মায়ের কোলের উষ্ণতার কথাই বললো ঘুরে ফিরে।
মা জিজ্ঞেস করেন, ও কী তোমার সঙ্গে আভার ভাষায় কথা বললো? দাগেস্তানের যে মায়ের ভাষা আমি ওকে মুখে মুখে শিখিয়েছিলাম।
ওর শিশুকালের তন্দ্রাহীন রাতে ঘুম পাড়াতে যে আভারি গান গেয়েছিলাম; সেসব কথা কী মনে আছে ওর!
সাংবাদিক উত্তর দেয়, সেই কিশোর বেলায় সে ঘর ছেড়েছে; নানা বাধার পাহাড়-প্রাচীর ঠেলে সে প্যারিসে পৌঁছেছে। সেখানে তো আভারি ভাষায় কথা বলার কাউকে পায়নি। তাই তো শুরুতে সে ছবি এঁকে ফ্রেঞ্চদের কাছে মনের ভাব প্রকাশ করতো। সেই থেকে ছবি আঁকাই ওর আসল ভাষা। আর ধীরে ধীরে ফ্রেঞ্চ ভাষাটা শিখেছে। আভারি ভাষা ওর স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেছে। তাই একজন অনুবাদকের সাহায্য নিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলেছি খালাম্মা।
মা’র মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। তার মুখে বেদনার কালো মেঘ জমা হয়। মাথা থেকে কালো কাপড় নিয়ে উনি মুখ ঢাকেন।
সাংবাদিক জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে খালাম্মা!
মা’র মুখ কালো ঘোমটায় লুকিয়ে গেছে, মায়ের ভাষা যে সন্তান ভুলে গেছে; সে তো মায়ের কাছে মৃতই। মা কান্নাভেজা গলায় বলেন, তুমি তো জানো, দাগেস্তানে সন্তান মারা গেলে মা চল্লিশদিন কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে রেখে শোক পালন করে।
– মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার শিক্ষক
প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া