মওদুদ আহমেদকে বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনীতির পাঠশালায় শিক্ষানবীশ হিসেবে ভর্তি করে নিয়েছিলেন। আইন-শাস্ত্রটা ঠিক ঠাক জানে; একটা নির্ভুল ড্রাফট লিখতে পারে বাংলা ও ইংরেজিতে সমান দক্ষতায়; সুতরাং বঙ্গবন্ধুর ট্যালেন্ট হান্টিং প্রকল্পে মওদুদকে নেয়া হবে এতো জানা কথা।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ব্যারিস্টার মওদুদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১-এ ইয়াহিয়া খানের ডাকা গোলটেবিল বৈঠকে তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন।
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মান পাশ করে বৃটেনের লন্ডনস্থ লিঙ্কন্স ইন থেকে ব্যারিস্টার-এ্যাট-ল’ ডিগ্রি অর্জন করেন। লন্ডনে পড়াশুনা করে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং হাইকোর্টে ওকালতি শুরু করেন। তিনি ব্লান্ড ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলেন।
মওদুদ আহমেদ জার্মানির হাইডেল বার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে গবেষক হিসেবে যুক্ত থেকেছেন। রাজনীতির মাঠে পায়ে বল না পেলে; তাকে সাইড বেঞ্চে বসিয়ে রাখা হবে এমন আঁচ পেলেই; আহাজারি না করে, পড়ালেখা, শিক্ষকতা আর গবেষণা গ্রন্থ প্রণয়নের কাজে চলে যেতেন উনি। বাংলাদেশের অসাড় রাজনীতির মাঠে চরে বেড়ানো ধর্মের ষাঁড় ও জাতীয়তাবাদের ষাঁড়ের লড়াইয়ের দৃশ্য থেকে মওদুদ এটুকু বুঝে গিয়েছিলেন; এ মাঠ হচ্ছে ম্যাটাডোরের ষাঁড়ের লড়াই-এর মাঠ। কিন্তু মওদুদের শরীরে রাজনীতির বাহুবলিদের শক্তি তো ছিলো না; ছিলো কৌটিল্যের মস্তিষ্ক তার।
সুতরাং “সাঁঝের মায়ায় বসে” সুনীল খুশিজলে তৃতীয় চুমুক দিতে দিতে মওদুদ আসলে রাজনীতির এক, সাতরঞ্জ কী খিলাড়ি ছিলেন; এমন দক্ষ এক দাবাড়ু; মন্ত্রীর চাকরিটা তিনি করেছেন সরকারি চাকরি করার মৌতাতে। মন্ত্রীর চাকরিতে সাময়িক বিরতি হলে, তখন হয় প্রজ্ঞার যেখানে মূল্য আছে, সেরকম বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি হিসেবে রাজনীতির ক্লাস নেয়া; কিংবা বাংলাদেশ রাজনীতির প্রামাণিক গ্রন্থ লেখা।
মওদুদ আহমেদ ফ্রান্সিস বেকন, বার্ট্রান্ড রাসেল, নিটশে, ম্যাকিয়াভেলি; এদের এনলাইটেনমেন্টের যুগের দর্শন পড়েছেন; সেগুলোকে রাজনীতির দাবা খেলায় কাজে লাগিয়েছেন। ফলে
তার রাজনৈতিক আদর্শের মাঝে আমিত্ব বা ইনডিভিজুয়ালিজমের দেখা পাওয়া যায় বেশি। বিতর্কিত জার্মান তথ্য মন্ত্রী গোয়েবলসকেও মওদুদ নিরীক্ষণ করেছেন পাঠে; ও জার্মানিতে মাঝে মধ্যে বসবাসের সুযোগে।
বঙ্গবন্ধু, জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়া; প্রত্যেকের নেতৃত্বে রাজনীতি করেছেন। অনেকটা যেন বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের সদস্যদের মতো জীবন তার। ক্ষমতায় যেই থাকুক; মওদুদ স্যার সেখানে থাকবেনই। আর শেখ হাসিনা তাকে ওএসডি করে রাখায়; সে সময়গুলোতে বাংলাদেশ রাজনীতি নিয়ে গবেষণামূলক পর্যবেক্ষণ গ্রন্থ লিখেছেন; অত্যন্ত নৈর্ব্যক্তিকভাবে। তার লেখার মাঝে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টির বিন্দুমাত্র সংশ্লেষ নেই। এইখানে কেবলি একজন নৈর্ব্যক্তিক লেখক। রাজনীতিতে তাকে সত-অসতের প্রচলিত তুলাদণ্ডে মাপার অবকাশ থাকলেও; লেখক মওদুদ আহমদ, তার গ্রন্থ, তার টেক্সট; এগুলো সৎ বয়ানের নৈবেদ্য হিসেবে জ্ঞানজগতে রয়ে গেলো।
এই মেধাবী মওদুদ পল্লীকবি জসিমউদ্দিনেরও চোখে পড়েছিলেন। ফলে একজন কবির মেয়েকে সহধর্মিনী হিসেবে পেয়ে যাওয়ায়; গার্হস্থ্য জীবনে খুঁটিনাটি নিয়ে তাকে আর ভাবতে হয়নি। রাজনীতিক আর লেখকের দুটি সত্তা নিয়ে দীর্ঘ এক ইনিংস খেলে গেলেন তিনি।
খ্রিস্টোফার মার্লোর ড ফস্টাস যেমন নিজেকে তার অর্জিত প্রজ্ঞার কারণে ইনডিসপেনসিবল ভাবতেন; মওদুদের ভাবনাটাও কতকটা তেমনই যেন ছিলো। ক্ষমতার মেফিস্টোফিলিসের প্ররোচনায়; গুড এঞ্জেলের লেখালেখির আহবান ফেলে ব্যাড এঞ্জেলের মন্ত্রীগিরি করার আমন্ত্রণে সাড়া দিয়েছেন।
একজন স্যুটেড ব্যুটেড ব্যারিস্টার; একটা বিলেতি কেতার জীবন; একটু ফর্মাল, একটু দুষ্টু খেলোয়াড় যে; পলিটিকসের টি -টোয়েন্টি লীগে জার্সিবদল করতে পছন্দ করে। ঝানু আইনবেত্তা; ফলে রাজনীতির পান্ডাদের টোকায়, বা পুলিশ-গোয়েন্দা বাহিনীর হয়রানিকে মওদুদ আইনি পথে মোকাবেলা করেছেন। রাজনীতির সোনার ছেলেদের বে-আইনি অবৈধ উপার্জনের; নানা চাঁদাবাজির তথ্য উপাত্ত এক-এগারো কালের অন ক্যামেরা জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এলেও; মওদুদের বাড়িতে একটি শূন্য ব্ল্যাক লেভেলের বোতল পাওয়া গেছে।
মওদুদ যখন দেখেছেন, একটি দেশের রাজনীতিকদের লক্ষ্য হচ্ছে ক্ষমতার ক্যাসিনো দখল করে ছলেবলেকৌশলে ক্যাশকাউ মোটাতাজা করা ; তখন মওদুদ এটা বুঝে গেছেন, বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী হিসেবে উনিই সেরা। আর্থিক দুর্নীতি করেনি যে লোক; তার রাজনৈতিক আদর্শের সোনার বাছুর কেন নানা-দলের গোয়ালে বেঁধে মন্ত্রীত্বের চাকরি করে গেলেন? এই প্রশ্ন করার মুখ বাংলাদেশের ঠিক কোন রাজনীতিকের আর আছে বলে মনে হয়না। শতছিদ্রের ঝাঁঝর কী করে বলে যে, সূচের একটি ছিদ্র আছে!
মওদুদের লাইফ স্টাইল সব আমলে একইরকম ছিলো। ক্ষমতায় এসে হালুয়া খেয়ে সুইস ব্যাংকে টাকা জমানো; বা নিও এলিট জীবনের স্বাদ নেয়ার তার দরকার পড়েনি। ফলে মওদুদের জন্য বাংলাদেশের রাজনীতি-মন্ত্রীত্ব এসবই ছিলো একজন দক্ষ গলফারের গলফ খেলতে যাওয়ার মতো। নিজদলের ঋণখেলাপি, ব্যাংক, শেয়ার বাজার, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, ভূমি খেকো, শিক্ষা-স্বাস্থ্য বাজেট খাওয়া, শ্রমিক ঠকানো শিল্পপতি, উন্নয়ন প্রকল্প পুকুর চুরি করা তাবড় আকর্ষণহীন সহমত ভাইদের চেয়ে শ্রেয় এই প্রতিপক্ষের মওদুদ আহমদ; যিনি সোনালি যুগের রাজনীতির শেষ চিহ্নদের একজন; ভেটেরান পার্লামেন্টেরিয়ান। তিনি তার কৌশলি পলিটিক্যাল রেটোরিকের বাক-চাতুর্যে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা যুক্তি-তর্কের আইনজীবী ও রাজনীতিক হিসেবে, পলিটিক্যাল শোবিজ তারকা ছিলেন; এটা স্বীকার করতে বাধ্য গ্যালারির পপকর্নখেকো দর্শকেরা; যারা বাংলাদেশ রাজনীতির ম্যাটাডোরের ষাঁড়ের লড়াই দেখে বিনোদিত হন।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, মওদুদ ম্যাটাডোরের এই ষাঁড়ের লড়াইয়ে টিকে ছিলেন; তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে পারেননি নিজ দলের বা প্রতিপক্ষের বাহুবলিরা; যাদের কালো টাকা-পেশীশক্তি-হিংস্র শিং আছে।
বঙ্গবন্ধুর পলিটিক্যাল রিক্রুটমেন্টের সেই রাজনীতির পাঠশালার ছাত্রদের মাঝে কারো চলে যাওয়া মানে; বাংলাদেশ আকাশ থেকে একটি তারা ঝরে পড়া যেন; যার কথা শুনে; লেখা পড়ে নতুন কিছু শেখা যেতো এমন একজন প্রজ্ঞাবান মানুষের চলে যাওয়া।
–মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার শিক্ষক
প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া