করোনাভাইরাসের টিকা নিয়ে ভূ-রাজনীতির খেলা হবে এটা সকলেরই জানা ছিলো, অন্তত জানা থাকার কথা ছিলো; বৈশ্বিকভাবেই তা হবার কথা এবং হচ্ছে। করোনার শিক্ষা হচ্ছে মানবিক পৃথিবী কিংবা জনস্বাস্থ্য গুরুত্ব পাবে – এমন আশা করা হয়েছিলো। কিন্ত সেটা হয়নি। দুর্ভাগ্য বলি কিংবা যেভাবেই ব্যাখ্যা করি বৈশ্বিক ক্ষমতা ও সম্পদের ক্ষেত্রে এই মহামারী কোনো রকমের পরিবর্তনের সূচনা করেনি। যে সমস্ত দেশ বিশ্বে প্রভাব বিস্তারের জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছিলো সেই সব দেশ টিকাকে তাঁদের কূটনীতির হাতিয়ারে পরিণত করেছে। অন্যদিকে যারা আগে ক্ষমতাশালী ছিলো তাঁরা তাঁদের প্রভাব টিকিয়ে রাখতে সচেষ্ট হয়েছে।
টিকা নিয়ে ভূ-রাজনীতির খেলায় প্রথম দিক হচ্ছে নিজের ঘর সামলানো – একেই বলে টিকা জাতীয়তাবাদ। এটা প্রত্যাশিত কিনা সেই প্রশ্ন ভিন্ন, নৈতিকতার বিবেচনায় অবশ্যই অগ্রহণযোগ্য। কিন্ত বাস্তবতা তাই। ধনী দেশগুলো এই পথই বেছে নিয়েছে। ফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, টিকা দেয়ার ক্ষেত্রে ধনী দেশগুলো এগিয়ে আছে। ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে টিকা দেয়া হয়েছে ৯০০ মিলিয়ন; কিন্ত এর ৮১ শতাংশ হচ্ছে ধনী এবং উচ্চ-মধ্য আয়ের দেশে; আর দরিদ্র দেশে দেয়া হয়েছে মাত্র ০.৩% (শুন্য দশমিক তিন শতাংশ)। যুক্তরাষ্ট্রে কমপক্ষে ২৭ শতাংশ মানুষ এখন সম্পূর্নভাবে টিকা পেয়েছেন, ব্রিটেনে ১৭.১২%। কোভেক্সের আওতায় টিকা বণ্টনের বৈষম্য সুস্পষ্ট। ধনী এবং মধ্য-আয়ের দেশগুলো যতটা পেরেছে তাঁরা এই জাতীয়তাবাদের অনুসরণ করেছে। ফলে ধণী দেশের হাতে জমে উঠেছে টিকা কিন্ত গরিব দেশগুলোতে মানুষ টিকা পাচ্ছেনা না। কোভিক্সের আওতায় ১১৯টি দেশে ৪৩.৪ মিলিয়ন টিকা পাঠানো হয়েছে, সব টিকা মানুষকে দেয়া যাবে তার নিশ্চয়তা নেই – টিকা দেবার জন্যে যে অর্থ দরকার তাও অনেকের নেই।
এই অবস্থা যে হবে তা আগেই অনুমান করা গেছে। যারা অনুমান না করে অন্যভাবে আশা করেছেন তাঁদের বিষয়ে কিছু বলার নেই। টিকা বন্টন ইত্যাদিকে যারা কেবলমাত্র মানবতা, বন্ধুত্বের হিসেবে বিবেচনা করেছেন তাঁদের অপরিপক্কতা সহজেই বোধগম্য। কিন্ত এর ভিত্তিতে একটি রাষ্ট্র তাঁর নিজের পরিকল্পনা করতে পারে কিনা সেটা নিশ্চয় বুঝিয়ে বলার দরকার নেই। টিকা কূটনীতি অন্য কূটনীতি থেকে ভিন্ন কিছু বিষয় নয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তাঁর অন্যথা হয়নি। ভারত যে ‘টিকা মৈত্রী’ সূচনা করেছিলো – এই অঞ্চলে এবং অন্যত্র – তাঁর উদ্দেশ্য মহানুভবতা নয়। তার উদ্দেশ্য সহজ । একই বিবেচনায় থেকেই চারজাতি কোয়াডে – যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান এবং ভারত – টিকা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। ভারতের এই কূটনীতির লক্ষ্য চীনকে প্রভাব বিস্তার করতে না দেয়া। ভারত-বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভারতের আগ্রহ এবং উৎসাহের কারণ হচ্ছে বাংলাদেশের ওপরে তাঁর প্রভাবকে কোনো রকমের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মূখে না ফেলা। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের ভিত্তিই হচ্ছে এটি। এই কারনেই যে বিবেচনা দিয়ে টিকা সংগ্রহের সিদ্ধান্ত হয়েছে সেটা ‘জনস্বাস্থ্য’ এবং ‘জাতীয়তাবাদী’ নয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের ভেতরকার বানিজ্যিক বিবেচনা। পররাষ্ট্র মন্ত্রী মোমেন বলেছেন যে বেক্সিমকোর চাপে বাংলাদেশ বিকল্প উৎসের বিবেচনা করতে পারেনি। (নিউ এজ পত্রিকায় তাঁকে উদ্ধৃত করে যা বলা হয়েছে তা উদ্ধৃত করা দরকার – ‘It was because of Beximco’s pressure in their business interest that the government could not have alternative vaccine sources though both Russia and China had approached Bangladesh to sign deals,’ Momen went on.) কোনও প্রতিষ্ঠান ক্ষমতাসীনদের আনুকূল্য না পেলে এতটা শক্তিশালী হয়? বেক্সিমকোর বিষয়ে এর চেয়ে বেশি বলার দরকার নেই।
একদিকে ভারতের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্কের বিবেচনা, এই অঞ্চলে ভারতের প্রভাব রক্ষা ও বিস্তার এবং একটি বিশেষ কোম্পানীর ‘চাপ’ বাংলাদেশের টিকা সংগ্রহের সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপাদান। ফলে এখন সংকটে পড়ার পরে বাংলাদেশ বিকল্পের সন্ধানে বেড়িয়েছে। সেটার সাফল্যের সম্ভাবনা কতটুকূ? আর মনে রাখা দরকার যে যারা এখন টিকা সরবরাহ করবে তাঁরাও করবে কূটনীতির বিবেচনায়। ফলে টিকা সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আগের বিবেচনাগুলো থেকে বেরুচ্ছে কীনা সেটা মনে রাখা দরকার। আগের বিবেচনাগুলো বহাল থাকলে কথা যতটা হবে তাঁর চেয়ে কম হবে কাজ। একটা উদারহণ দিলে বুঝতে সহজ হবে। ইতিমধ্যে রাশিয়ার সঙ্গে যে আলোচনা শুরু হয়েছে তাঁর মধ্যে একটি বিকল্প হচ্ছে বাংলাদেশে টিকা উৎপাদন। একই সময়ে একটি সূত্র জানাচ্ছে যে, “ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে যৌথ উদ্যোগে ‘কোভ্যাক্সিন’ উৎপাদনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। শনিবার (২৪ এপ্রিল) ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এ সংক্রান্ত এই ‘নোট ভারবাল’ বা কূটনৈতিক বার্তা পাঠায়। কোভ্যাক্সিন ভারতীয় বায়োটেকনোলজি প্রতিষ্ঠান ভারত বায়োটেক উদ্ভাবিত করোনার টিকা। ভারতে এই টিকার ‘ফেজ থ্রি ট্রায়াল’ চলছে”।
বাংলাদেশে এখন টিকা নিয়ে যে অনিশ্চয়তার সূচনা হয়েছে সেই আলোচনায় এই বিষয়গুলো বিবেচনায় না নিলে আগামীতে কি হতে যাচ্ছে তা বোঝা যাবে বলে মনে হয়না। ভারতের একটি কোম্পানী টাকা নিয়ে কেনো টিকা দিচ্ছে না সেটা নিয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভ, কাকুতি-মিনতি যারা করছেন সেটা তাঁদের সিদ্ধান্ত, কিন্ত প্রশ্ন হচ্ছে যখন বিকল্পের সুযোগ ছিল তখন বাংলাদেশ কেন এককভাবে ভারত-নির্ভর হল? এই প্রশ্নের উত্তরের মধ্যে কেবল টিকার রাজনীতি বোঝা যাবে তা নয়, তাঁর চেয়েও অনেক বেশি কিছু স্পষ্ট হবে।
– ড. আলী রীয়াজ, ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, রাজনীতি ও সরকার বিভাগ, ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি, ইউএসএ