সম্পাদকবৃন্দ সমীপেষু
দৈনিক কালের কণ্ঠ, দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন, বাংলানিউজ ২৪.কম, ডেইলি সান, নিউজ ২৪
দেশে এতবড় একটা চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটে গেল অথচ আপনাদের কাগজে কিংবা পোর্টালে কিংবা চ্যানেলে এ নিয়ে একটা খবরও চোখে পড়ল না, বিষয়টি আমার মত পাঠককে যারপরনাই স্তম্ভিত, ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত করেছে।
আমার মত অনেক পাঠকের কাছে মনে হয়েছে কর্পোরেট মিডিয়া মোগলক রক্ষা করতে আপনাদের এ অপচেষ্টা সাংবাদিকতা নামক এই মহান পেশার গায়ে একেবারে কালিমা লেপন করে দিয়েছে। কালের কণ্ঠ, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ডেইলি সান, বাংলানিউজ২৪ ডট কম এবং নিউজ টুয়েন্টি ফোর এদেশের সাংবদিকতার ইতিহাসে এক ন্যাক্কারজনক অধ্যায় রচনা করল।
একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে আপনাদের কাছে আমার বিনীত জিজ্ঞাসা – আপনারা কি নিজেদেরকে প্রশ্ন করেছেন বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার দাবীতে আপনারা আবার কলম ধরবেন কিভাবে? সুশাসন, আইনের শাসন, ন্যায়বিচারের দাবীতে বড় বড় সম্পাদকীয় লিখতে আপনাদের কি এতটুকু লজ্জা করবে না?
আপনারা কি একটিবারের জন্য ভেবেছেন যে, আপনাদের এরকম ইচ্ছাকৃত নিস্পৃহতার মাধ্যমে কার্যত আপনারা নীতিগতভাবে এ মহান পেশায় থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন।
প্রজন্ম আপনাদেরকে এখন আর সাংবাদিক হিসেবে সম্মান করবেনা; করুণা করবে বিবেকবর্জিত প্রভুভক্ত গোলাম হিসেবে।করুণা করবে আজ্ঞাবাহক দাস হিসেবে।
সত্য বলার সাহস হারিয়ে আপনারা আজ বোধান্ধ বধিরে পরিণত হয়েছেন। জাতি আপনাদের নিক্ষেপ করল আস্তাকুঁড়ে। আপনারা জাতির বিবেকের নামে কলঙ্ক।
কী দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন আপনারা? অত্যন্ত দু:খভারাক্রান্ত হৃদয়ে জাতি আজ দেখল কিভাবে অর্থ, বিত্ত ও ক্ষমতার কাছে মাথা নত করে সাংবাদিকেরা।
আপনারা যারা আমাদেরকে হাজার হাজার শব্দের কলাম, সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় লিখে সততা, সত্যবাদীতা, নীতিনিষ্ঠ ও সৎ সাংবাদিকতার সবক দিয়েছেন এতদিন, তাদের আজ ধীক্কার জানানোর ভাষা জানা নেই আমাদের । ফেসবুকে, চায়ের টেবিলে, সামাজিক আড্ডায় আজ ঘুরে ফিরে কয়েকজন সম্পাদকের নাম উচ্চারিত হচ্ছে, যাদেরকে এতদিন নিশর্ত ভালবাসা দিয়েছে মানুষ। মহান সাংবাদিক হিসেবে শ্রদ্ধা জানিয়েছে তাদের প্রতি। অথচ আজ সে তাদেরকেই আপনাদের প্রতি ছুঁড়ে দিতে হল নিন্দা ও ঘৃণা।
আপনারা বাকীটা জীবন বসুন্ধরার গোলামী করুন। খবরদার জাতিকে ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনের সবক দেয়ার স্পর্ধা দেখাবেন না। তস্করদের মুখে আর যাই হোক বস্তুনিষ্ঠতা ও আইনের শাসনের দাবী শোভা পায়ন।
আপনাদের প্রতি অনুরোধ, নিজেকে একবার স্বীয় বিবেকের মুখেমুখি দাঁড় করান। তারপর জিজ্ঞেস করুন এই মুনিয়া যদি আপনার মেয়ে হত তাহলে কি আপনি আজ এভাবে রহস্যজনকভাবে মুখে কলুপ এঁটে থাকতে পারতেন?
মুনিয়া যদি আপনার বোন হত তাহলে কি আপনারা পারতেন তাঁর হত্যার বিচার না চেয়ে শুধুমাত্র চাকরী রক্ষার জন্য নিশ্চুপ থাকতে?
মনে রাখবেন, যে দেশে আজ আপনারা দেশবরেণ্য সাংবাদিক হিসেবে লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করছেন, সে দেশটি মুনিয়ার মুক্তিযোদ্ধা বাবার রক্তের বিনিময়ে অর্জিত।
একজন মুক্তিযোদ্ধা পরলোকে থেকে চেয়ে চেয়ে দেখল তাঁর যুদ্ধের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশে পঞ্চাশ বছরের ব্যবধানে এই মহান পেশাটিকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করিয়েছে কয়েকজন স্বার্থান্বেষী সাংবাদিক।
কিছুদিন আগে আপনাদের দেয়া ফেসবুক স্ট্যাটাস চোখে পড়েছে। অনেকেই শেয়ার করছেন ফেসবুকে। আপনাদের স্ট্যাটাস আপনাদেরকেই যেন করুণা করছে আজ। আপনাদের সেসব স্ট্যাটাসের কথা অনুকরণ করে বলতে চাই, মুনিয়ার অপমৃত্যুর ঘটনা আজ প্রমাণ করে দিল আপনারা একেকজন মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত প্রভুভক্ত গোলাম।
হৃদয়ে হিমালয় সমান গোলামীর বাসনা লালন করতে আপনাদের এতটুকু লজ্জা নেই।আপনারা প্রমাণ করলেন মিথ্যার সঙ্গে আপোষ না করলে কিছুতেই আপনাদের চাকরী টিকবে না।
আপনাদের কাছে এই ক্ষুদ্র পাঠকের প্রশ্ন- ঠিক যে মুহূর্তে আপনাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা এল যে এই অতি গুরুত্বপূর্ণ খবরটি আপনারা প্রকাশ করতে পারবেন না, ঠিক সে মুহূর্তে আপনারা কয়েকজন সম্পাদক এবং আপনাদের সহকর্মীরা সত্য প্রকাশের বৃহত্তর স্বার্থে, নীতিনিষ্ঠ সাংবাদিকতা চর্চার বৃহত্তর প্রয়োজনে কি একযোগে কর্মবিরতির ঘোষণা করতে পারতেন না?
আপনারা কি মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ঝান্ডা উর্ধ্বে তুলে ধরে সমুন্নত রাখতে পারতেন না এই মহান পেশার মর্যাদা? আপনাদেরকে কী বেশী আপোষ করতে বাধ্য করেছে— চাকরী হারানোর ভয় না আপনাদের চাটুকার বিবেক? আপনারা পরাজিত আসলে কোথায়? স্বার্থের কাছে না বিবেকের কাছে?
জাতি আজ এই প্রশ্নগুলোর উত্তর চায়। একজন জনপ্রতিনিধির যদি বাধ্যবাধকতা থাকে আইন ও সুশাসন প্রশ্নে আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দেয়ার তাহলে
আপনাদেরও বাধ্যবাধকতা রয়েছে পাঠকের কাছে এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়ার। এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেয়ার আগ পর্যন্ত দয়া করে পবিত্র কলম ধরবেন না। এটা হবে রীতিমত অপরাধ। আপনারা আজ পাঠকের আদালতে দন্ডপ্রাপ্ত আসামী।
পরিশেষে আপনাদের বিবেকের কাছে আরো কয়েকটি প্রশ্ন রেখে শেষ করছি:
১. অতিরিক্ত মুনাফার লোভে যে ব্যবসায়ী খাদ্যে ভেজাল মিশিয়ে ভোক্তাদের ঠকায় তাদের সঙ্গে আপনাদের পার্থক্য কোথায়, আপনারা যারা মিথ্যার সাথে আপোষ করতে গিয়ে সত্য প্রকাশ না করে পাঠককে ঠকিয়েছেন?
২. দুর্নীতিবাজ পুলিশ কর্মকর্তা যারা ঘুষের লোভে মিথ্যা তদন্ত প্রতিবেদন দিয়ে ন্যায় বিচার থেকে মানুষকে বঞ্চিত করে, তাদের সাথে আপনাদের পার্থক্য কোথায়, আপনারা যারা সত্য খবর থেকে পাঠককে বঞ্চিত করেছেন?
৩. ঘুষখোর আমলা যারা ফাইল আটকিয়ে ব্যক্তি স্বার্থ হাসিল করে তাদের সাথে আপনাদের নীতিগত পার্থক্য কোথায় আপনারা যারা সত্য খবরকে মাটি চাপা দিয়েছেন নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করেছেন?
৪. পিস্তল উঁচিয়ে যেসব সন্ত্রাসী মোটা অংকের মুক্তিপনের জন্য নিরপরাধ মানুষকে জিম্মি করে, তাদের সঙ্গে আপনাদের পার্থক্য কোথায় আপনারা যারা কলম উঁচিয়ে পাঠক ও দর্শকদের জিম্মি করছেন?
জাতি আপনাদের কাছে আজ এসব প্রশ্নের উত্তর আশা করে।
আপনাদের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক!
ইতি—
বিক্ষুব্ধ পাঠক
লণ্ডন,
২৮ এপ্রিল ২০২১