দীর্ঘায়িত করোনা অব্দে জিম-বিউটি পার্লার বন্ধ। তাই কুলসুম উন্নয়না ভাবী; বাসায় তালা দিয়ে চাবি নিয়ে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে প্রাতঃহন্টনে যান। বসুন্ধরার ইক্ষুকলের চিনির কারবার নিয়ে স্ক্যান্ডাল সামাজিক উৎপাত মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যাবার পর; ভাবী খপ করে চেপে ধরেন তার হাবিকে। দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদে ভাবী সপ্তমী রাগে পাড়া মাথায় তুললেও বাতেন উন্নয়ন ভাই অস্বীকার করেন। উনি জানিয়ে দেন, সুগার এসোসিয়েশান অফ ড্যাড (স্যাড)-এর মোটেই সক্রিয় সদস্য নন। তবে চিনির আইবুড়ো রাজপুত্রদের সঙ্গে একটি নিষ্ক্রিয় ব্যবসা সম্পর্ক আছে; এতোটুকু স্বীকার করেন উন্নয়ন ভাই। ভাবী তাই ভাইয়ের স্মার্ট ফোন কেড়ে নিয়ে তাকে হাউজ এরেস্ট করে রাখেন। ভাই ঘরে বসে গান করেন, ভেঙ্গে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে!
ভাবী সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে হাঁটার সময় কে যেন পেছন থেকে ডাকে, ভাবী একটু শুইনা যান। ভাবী পেছনে তাকিয়ে দেখেন, কোথাও কেউ নেই। ভাবীর সামনে ওয়াকিটকি নিয়ে হাঁটছে দুই বডি গার্ড। ক্যানাডার বেগম পাড়া থেকে দেশে এসে করোনার কারণে আটকে গেছেন ভাবী।
কিন্তু ঢাকায় নিরাপদ বোধ করেন না টরেন্টোর মতো। উন্নয়ন ভাই তাই তার ইক্ষু কলের দুই নৈশপ্রহরীকে ভাবীর বডিগার্ড হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন।
ভাবী আবার শুনতে পান সেই ডাক, একটু শুইনা যান ভাবী; খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। ভাবী ঘুরে তাকিয়ে দেখেন কোথাও কেউ নেই। সামনের এক বেঞ্চিতে গোয়েন্দা চেহারার এক লোক বসে পকেট থেকে চিরুনি বের করে তার মাথার স্টেডিয়ামের চারপাশের দুর্বাঘাসে চিরুনি তল্লাশি চালাচ্ছে।
খুব মলিন অথচ একটি অতীব সুন্দরী মেয়ে পাতা কুড়াচ্ছে; মাথায় তার আফ্রোদিতির চুলের কাঁটা। ভাবী বিস্মিত হন; এই চুলের কাঁটাটি খুব পরিচিত তার। উনি মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করেন, ঐ পাতাকুড়ুনি এতো দামি চুলের কাঁটা কই পাইলি! মেয়েটি দৌড় দিয়ে পালায়।
সামনেই এক গোল চশমা পরা ভদ্র লোক একটা গাছের সঙ্গে গল্প করছেন। আকলিমা উন্নয়ন ভাবী টরেন্টো যাবার পর থেকেই অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী। মুখে যা আসে; তাই বলেন। ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করেন, ও ভাই আপনি গাছের সঙ্গে গল্প করছেন কেন! আপনার মাথায় কী গোলমাল আছে।
ভদ্রলোক হেসে বলেন, তা মাথায় একটু গোলমাল আছে বৈকি। ঐ মাথায় গোলমালওয়ালা লোকেরা যেমন অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি মাপে; আমিও তেমনি গাছের প্রবৃদ্ধি মাপি। আজকাল উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি মাপার জন্য অনেক পাগল মেলে; কিন্তু গাছের প্রবৃদ্ধি মাপার পাগল খুঁজে পাওয়া যায় না।
আকলিমা ভাবী নিশ্চিত হয়ে পড়েন; এই লোকের মাথায় গোলমাল আছে। তাই সহানুভূতি নিয়ে কাছে যান।
–ভাই আমার দুলাভাই ড বলাইও আপনার মতো পাগল উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ছিলো। তার শেষ জীবনে ট্রিটমেন্ট করানোর পয়সা ছিলো না। আপনি এইসব বাদ দেন সময় থাকতে। বরং চেহারা ছবি তো বুদ্ধিজীবীর মতো; আপনি বাতাবি লেবু টিভিতে গিয়া উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি মাপলে; নগদ হাজার দুয়েক টাকা পাবেন; প্রত্যেকটা শো’র জন্য। আবার বছরে একবার রঙ্গভবনে পিঠাপুলির দাওয়াত পাবেন। ভাগ্যে থাকলে দেশপ্রেমের পদকও পাইয়া যাইতে পারেন।
কে যেন বলে ওঠে, পদক উনি অনেক পেয়েছেন; উনার নাম জগদীশ চন্দ্র বসু।
ভাবী এবার আগ্রহী হয়ে জিজ্ঞেস করেন, বিপাশা বসু কী আপনার মেয়ে নাকি!
ভদ্রলোক পালটা করেন, বিপাশা বসুটা আবার কে!
ভাবী রসিকতা করে বলেন, বিপাশারে চেনেন না; যে বাসায় লাইটার না থাকলে পড়শির লাইটার দিয়ে বিড়ি জ্বালাতে বলে সবাইরে। গান শোনেন নাই, বিড়ি জ্বালাইলে!
কে যেন বলে, আপনার হাবি তাই বুঝি বিড়ি ধরাতে এই উদ্যানে লাইটার খুঁজতে আসেন!
ভাবী অস্থির হয়ে বলেন, কে কথা বলে; সকাল থেকে কারা কারা যেন কথা বলছে; অথচ আমি বুঝতে পারছি না।
জগদীশ চন্দ্র বসু বলেন, আপনি কী জানেন না, গাছেরও প্রাণ আছে। এই যে দেখুন এই ক্রেস্কোগ্রাফ যন্ত্রে তারা সাড়া দেয়; আমি তখন তাদের প্রবৃদ্ধি মাপতে পারি।
ভাবী মরিয়া হয়ে বলেন, স্যার কোন গাছটা যেন বললো, আমার স্বামী বিড়ি জ্বালাইতে এই উদ্যানে লাইটার খুঁজতে আসে!
জগদীশ স্যার মুচকি হেসে বলেন, কিছু কথা থাকনা গোপন।
ভাবী হন হন করে হাঁটতে থাকেন; আবার কে যেন বলে, ভাবী পাতা কুড়ানির মাথার আফ্রোদিতির খোপার কাঁটা আপনার। আপনি যখন সেকেন্ড হোমে ছিলেন; তখন আপনার স্বামী আমাদের সবার প্রিয় উন্নয়ন ভাই, বিড়ি ধরাতে লাইটার খুঁজতে এসে; আপনার ফার্স্ট হোমে নিয়ে গিয়েছিলো ঐ পাতা কুড়ুনিকে। তাকে চিনির মতো মিষ্টি করে বলেছিলো, আমার সঙ্গে চল; তোকে রাজরাণীর জীবন দেখাবো।
পরদিন থেকেই পাতা কুড়ুনির খোপায় এই আফ্রোদিতির চুলের কাঁটা। উন্নয়ন ভাই তো বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই উন্নয়নের ভাগ-বাটোয়ারা করতে এই উদ্যানে আসতো; আর বিড়ি ধরাইতে লাইটার খুঁজতো। মাছের রাজা ইলিশ; আর বিড়ির রাজা আপনার হাবি; কিছু মনে কইরেন না ভাবী।
ভাবী আর্তনাদ করে ওঠেন, আজ আমি ওকে খুন করে ফেলবো।
–সুগার এসোসিয়েশান অফ ড্যাড (স্যাড)-এর সদস্যকে মেরে ফেললে উন্নয়নের ইক্ষুকলের ক্ষতি হবে ভাবী। কী হয় বিড়ি ধরাইতে লাইটার খুঁজলে! এতো ছ্যাঁত ছ্যাঁত করেন ক্যান! কোনোদিন কী তারে টেন্ডার বানিজ্য কিংবা দুর্নীতির বিড়ি ধরাইতে নিষেধ করছেন! ঐটা কী এমন ভালো কাজ! আর স্যাড হইয়া বিড়ি ধরাইলে যত দোষ! এ কেমন বিচার।
ভাবী বডি গার্ডের হাত থেকে রিভলবার নিয়ে গাছের গায়ে গুলি করেন, চুপ কর বেয়াদব গাছ কোথাকার।
গাছ গুলি খেয়ে হাসতে হাসতে বলে, করেন আরও গুলি করেন; এইখানে শাকা ইউনিভার্সিটির গুলিগালাজ খাইয়া বড় হইছি; এইগুলি গায়ে লাগে না।
ভাবি রেগে টং হয়ে বাড়িতে ফিরে উন্নয়ন ভাইকে গুলি করার জন্য খুঁজতে থাকেন। ভাইকে ওয়াকি টকিতে জানিয়ে দিয়েছে বডি গার্ড, ম্যাডাম রিভলবার রাণী হইয়া পড়ছেন; বস শিগরিরই পালান; উদ্যানের গাছেরা আপনার ব্যাবাক সিক্রেট ফাঁস কইরা দিছে। যেদিকে পারেন পালান স্যার।
উন্নয়ন ভাই করাত কলের দিকে অগ্রসর হোন। উন্নয়ন মন্ত্রীর অনুমতি নেন। বুঝিয়ে বলেন, উন্নয়নের শুভ্র বরফ কুমারীর জন্য সাতটি বামন রেস্তোরা প্রয়োজন ভাই। একটু ঠান্ডা মাথায় উন্নয়ন ভাগাভাগি করা যাবে; উন্নয়ন অংশীদারদের মাঝে। আবার চাইলে বিড়ি ধরানোর জন্য নানা রঙ -এর লাইটারও রাখা যাবে সেখানে। কিন্তু এরজন্য কিছু বেয়াদব গাছ কাটা দরকার। এরা উন্নয়নের পথে বাধা।
মন্ত্রী বলেন, ঠিক আছে যাও; উন্নয়নের পথের বাধা সরিয়ে নাও।
– মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার শিক্ষক
প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া