বৃটিশ ও পাকিস্তানের উপনিবেশের কর্কশ বৈষম্যের সমাজের বিরুদ্ধে দ্রোহ-অযুত অনাম্নী প্রাণের বিনিময়ে আমরা একটি স্বাধীন ভূখণ্ড মানচিত্র পতাকা জিতেছিলাম। বহু ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বদেশের একমাত্র অঙ্গীকার ছিলো অসাম্য-সামাজিক সুবিচার।
স্বাধীনতা ৫০ বছর পেরোনোর পর আমরা দেখি বৈষম্যের দুই বাংলাদেশ। এক বাংলাদেশ নব্য অভিজাত প্রাসাদে ফুলসজ্জার মধুচন্দ্রিমায় বুঁদ; আরেক বাংলাদেশ দারিদ্র্যের অগমে-দুর্গমে অধিকারহীন জীবনে বিলীন। এক বাংলাদেশ জুড়ে নতুন রাজপুত্র ও রাজকন্যাদের মোহরের অভিসার; শোষণ-লুন্ঠনের মৃগয়া। আরেক বাংলাদেশ জুড়ে শোক-তাপ-মৃত্যু-অপমানে কুঁকড়ে যাওয়া বিষাদ সিন্ধু।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আয়নায় দুই বাংলাদেশের সম্পদের পার্থক্যের আর জীবনমানের কয়েক সমুদ্র ব্যবধান স্পষ্ট। ক্ষমতা কাঠামোর নতুন রুলিং এলিটেরা বৃটিশ-পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক প্রেতায়িত আত্মারা ভাওয়ালপিণ্ডির সোনার কেল্লা গড়েছে। কেল্লার নব্য রাজন্যরা ফুলের মাঝে ঘুমিয়ে পড়ে ফুলের মধু খেয়ে। কেল্লার রাণী মৌমাছির চারপাশ ঘিরে গুঞ্জনে দোলে যে ভ্রমর সুখ চলেছে উড়ে উড়ে। আর কেল্লার বাইরের শ্রমিক মৌমাছিরা রাজকেল্লার জন্য মধু আহরণে প্রাণপাত করে। সেই মধু জমা হলে নতুন রাজকুমার ও রাজকুমারীরা তা নিয়ে যায় পশ্চিমের সেকেন্ড হোমের কেল্লায়। এতো মধু বৃটিশ কিংবা পাকিস্তানী শাসকেরাও পাচার করতে পারেনি; যা করেছে বাংলাদেশের শাসকেরা।
করোনাকালে ভি আই পি হাসপাতালে অক্সিজেন আর ভেন্টিলেটর মুখে সেঁটে নতুন শাসকেরা গান গেয়েছে, আমার সোনার বাংলা; আমি তোমায় ভালোবাসি। অন্যদিকে শাসিতেরা অসুস্থ মাকে নিয়ে একটু অক্সিজেনের জন্য হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরে জীবনের সোনার তরীতে ঠাঁই না পেয়ে সেই বাংলাদেশ মা মারা গেলে; ও মা আমি নয়ন জলে ভাসি।
এই ৫০ বছর ধরে ‘দেশপ্রেম’-এর সঞ্জীবনী সুধা বিক্রি করে বসে খাওয়া নতুন শাসক পুত্র শাসক করোনাকালে অক্সিজেন চেম্বার আর রাজবৈদ্য পেয়েছে চারপাশে। এই ৫০ বছর আলোর বাংলাদেশ গড়তে একাগ্রচিত্তে শিক্ষকতা করে দেশপ্রেমিক নাগরিক কোন বৈদ্য পায়নি রাজশাহী কেল্লার বাইরে; তার স্ত্রী বেহুলার মতো লখিন্দর বাংলাদেশকে নিয়ে অনিশ্চয়তার ভেলায় ভেসেছে। ও মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি।
করোনাকালে নিম্নমানের স্বাস্থ্য সামগ্রী সরকারের কাছে বিক্রি করে কারাগারে গেছে কেল্লার জীবনে প্রবেশ করতে চাওয়া হোয়াইট টাইগার গরিব ঘরের ছেলেরা। তারা যখন জেলে তখন তাদেরই গুদামের নিম্নমানের স্বাস্থ্যসামগ্রী সরকারের কাছে বিক্রি করেছে কেল্লার বড় দরবেশ; আর কেল্লায় ঢুকে পড়া হোয়াইট টাইগার ছোট দরবেশ। এমনকী ভ্যাকসিনের ব্যবসাটারও মনোপলি পেয়েছে কোম্পানি। অন্যদেশে বিজনেস কোম্পানি থাকে; আর বিজনেস কোম্পানির একটি দেশ আছে।
বিজনেস কোম্পানি তার বিদ্যুৎ কোম্পানির কয়লা খনির ময়লা শ্রমিককে কেল্লার পুলিশ দিয়ে হত্যা করে আবার রাজকোষে মোহর জমা দিলে ‘সাত খুন মাফ’ হয়ে গেছে এই মহামারীকালেই।
মোহরের নেশায় করোনাকালে রাজদর্জিরা খুলে রেখেছে সেলাইকলগুলো। লাখ লাখ শ্রমিককে ১০০ কিলোমিটার হাঁটিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে; এই দেশ কেল্লার রাজদুলারির; কেল্লার বাইরের সেলাইবুবুর নয়।
৫০ বছর ধরে অসাম্য শাসন ত্রাসন সংহারের ভাইরাসে মরতে মরতে মৃত্যুভয় আর স্পর্শ করে না কেল্লার বাইরের বাংলাদেশকে। যত মৃত্যু ভয় সোশ্যালাইটসদের; সহমত ভাঁড়দের; তারা স্বাস্থ্যবিধির ফর্দ নিয়ে কেল্লার বাইরের রোজ এনে রোজ খাওয়া ছোট খাট মানুষকে ছাগু ও বলদ বলে ডেকেছে। এইসব একপ্রজন্মের স্লামডগ মিলিওনিয়ারস প্রাডো হাঁকিয়ে, প্রাইভেট জেটে; হেলিকপ্টারে সমুদ্র সৈকতে যাচ্ছে ঈদ করতে। আর মঙ্গার গ্রামের সেলাই মা ঈদের বেতনটুকু তুলে ভাওয়ালপিণ্ডি থেকে বিষাদ যমুনা পেরিয়ে সন্তান ও স্বজনের মুখে জুঁই ফুলের মতো সাদাভাত তুলে দেবার স্বপ্নটুকু নিয়ে নৌকায় উঠতে গেলে; রাষ্ট্রের স্বাস্থ্য সচেতন নৌকা পুলিশেরা তাকে হিঁচড়ে নামিয়েছে। এই সেই দুই বাংলাদেশ; বিভেদের-ব্যবধানের নিষ্ঠুর এক বেদনাগাথা।
বিশ্ব মা দিবসে বিশএকুশের মা। এক বাংলাদেশ কী এক আদিখ্যেতায় ‘হ্যাপি মাদার’স ডে’ উদ্যাপন করেছে। এই জাদু ব-দ্বীপে মায়ার খেলায় জীবন চলে ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’-র মতো করে। মাত্র ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলে পনের কোটি মানুষের বাস। আরেক বাংলাদেশে দারিদ্র্যে বিশীর্ণ মা; তার বদনখানি মলিন; এক থালা জুঁই ফুলের সাদা ভাতের জন্য তার সন্তান ইউরোপগামী নৌকায় ভাসে-জীবন মৃত্যুর উপাখ্যানে। মঙ্গার দেশের মা সেলাই মা হয়ে মহানগরীতে আসেন; সন্তানের মুখে জুঁই ফুলের মতো সাদা ভাত তুলে দিতে। মহামারীর লকডাউনে মা ঈদের বেতনটুকু তুলে মঙ্গার গ্রামে ফিরে যেতে চান স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে। স্বজনের মায়া; মৃত্যুভয়কে অন্তর্হিত করে যেন। ক্ষুধার মতো অকুতোভয় তো আর কিছু নেই।
কেল্লার প্রণোদনা প্যাকেজ খেয়ে বলিবর্দ রাজদর্জি ন্যান্সি পেলোসি আপার মতো যারা বিশ্রামে হত; কভিড নাইনটিনের এস ও পি নিয়ে ওসিডি’র প্যানিকে; এইসব অসচেতন মায়া দ্বীপের মাকে বকাঝকা করে। কেল্লায় ঢুকে পড়া হোয়াইট টাইগার রাজন্য ঠিকই উন্নয়নের হেলিকপ্টারে পৌঁছে যায় রাজধানী থেকে এক উড়ালে মঙ্গা গ্রামের নতুন জমিদার বাড়িতে; মাতৃভক্ত বিদ্যাসাগরের মতো তাকে আর উত্তাল নদী সাঁতরাতে হয় না।
কিন্তু নৌকা কিংবা যন্ত্রের নৌকা আগলে দাঁড়িয়ে থাকে জীবন বাঁচানোর রাষ্ট্র। রাষ্ট্র মঙ্গার মা’কে হিঁচড়ে নামায়; গ্রামে অপেক্ষারত সন্তানের মুখ-স্বজনের পথ চেয়ে থাকা জানে না; আর দেখা হবে কীনা! একদিকে স্বাস্থ্য সচেতনতা; অন্যদিকে প্রয়োজন আর মায়ার মিশেলে; এইদিন প্রতিদিন; কবেই বা অসাম্যের ভাইরাস; অনিশ্চয়তার মহামারী ছিলো না এ সবুজ দ্বীপে। “আমি অপার হয়ে বসে আছি ওহে দয়াময়; পারে লয়ে যাও আমায়।”
– মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার শিক্ষক
প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া