গত একদশকের অসংখ্য ঘটনা রয়েছে; যেখানে নির্যাতিত হয়েছেন একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা পরিবারগুলো। আওমি ও কওমি উন্নয়ন যুগে; মুক্তিযুদ্ধের ‘চেতনা’ ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তীর প্রয়োজনে লিপসার্ভিস মাত্র। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মতো বুকের গভীরে লালন করা দেশের প্রতি ভালোবাসার পবিত্রতাকে; পাপিয়ামাণ্ডির ভোগ্যপণ্য হিসেবে বিক্রি করার এইসব মুনতাসির ফ্যান্টাসির উপনিবেশে ‘থাগস অফ বেঙ্গলে’রা গত দশবছরে নতুন রুলিং এলিট হয়েছে; ‘এলোমেলো করে দে মা; লুটেপুটে খাই’ দুর্নীতিতে।
ফেসবুকে মুক্তিযুদ্ধকালের সঙ্গে বিন্দুমাত্র সম্পর্কহীন শিয়ালেরা চেতনার দক্ষিণীয় পরে; মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সার্টিফিকেট বিতরণের নাতসি হয়ে ঘোরে; ভিন্নমতের জন্য মুক্তিযুদ্ধে ছিন্নভিন্ন-লুট হয়ে যাওয়া রিক্ত পরিবারের মানুষকে ‘রাজাকার’, ‘ছাগু’ পাকিস্তান চইলা যা; ইত্যাদি ট্যাগিং ছুঁড়ে দেয় অবিরত। এরা গালাগালের বিনিময়ে খাদ্য (গাবিখা) ও তেলের বিনিময়ে খাদ্য (তেবিখা) প্রকল্পের ভিক্ষুক; ভিক্ষুকের মানদণ্ডকে রাজদণ্ড বানিয়ে কায়েম করেছে স্বদেশী উপনিবেশ। বাংলাদেশকে বিভাজিত করেছে দুই বাংলাদেশে। ডিভাইড এন্ড রুলের আলেয়ায় ব্যাংক-শেয়ার বাজার-রাষ্ট্রিক প্রণোদনা খেয়ে এখন মানুষ খেকো ফ্রাংকেন্সটাইন।
শাহবাগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের একটি মহৎ উদ্দেশ্যের জাগরণের সঙ্গে মিশে যাওয়া থাগস বেঙ্গলেরা; এরা সেই সিক্সটিন্থ ডিভিশনের জীনগত আশ্লেষ; যারা ১৬ ডিসেম্বরের আগে পর্যন্ত; ‘যুদ্ধে যে জেতে ঐ পক্ষে যাবো’র দলে ঘাপটি মেরে থেকে; চকির তলায় পরিখা খুঁড়ে শিয়ালের মতো অপেক্ষা করেছে সময় ও সুযোগের গর্তে। ১৬ ডিসেম্বর গর্ত থেকে বেরিয়ে নিজেদের হোলিয়ার দ্যান দাও মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে দেশলুন্ঠন করেছে। ‘রাজা যায় রাজা আসে’ কিন্তু সেইসব রাজভোঁদড়েরা থেকে যায় রাষ্ট্রকাঠামোর গিঁটে গিঁটে। দেশের শিক্ষা-স্বাস্থ্য-মানবাধিকার ব্যবস্থায় ধস এনে; দেশলুটের টাকা পাচার করে উন্নত দেশে সেকেন্ড হোম গড়েছে এই নব্য দেশের মালিক; দখলদার থাগস অফ বেঙ্গলেরা।
আর নিভৃতে দেশের আনাচে কানাচে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা, নয় মাসের যুদ্ধে রিক্ত হয়ে যাওয়া, শরণার্থী উন্মূল হয়ে যাওয়া পরিবারগুলো; থাগস অফ বেঙ্গলের রুমাল বাহিনীর একের পর একের হামলার মুখে পড়েছে। নব্য মুক্তিযোদ্ধার কস্টিউম পরা থাগস অফ বেঙ্গলেরা সেই হোয়াইট টাইগার; যারা গেম থ্রোনসে হাজার হাজার কোটি লুট করে ভাগ্য বদলের রাণীর আস্থাভাজন হয়ে বসে আছে রঙ্গ প্রাসাদের বিভিন্ন কোণায়।’ এরা ভারতপন্থী নয়; পাকিস্তানপন্থী নয়; বাংলাদেশপন্থী তো নয়ই। এরা হচ্ছে টেকাটুকাপন্থী; মাংসের কারবার পন্থী; দখল পন্থী, উচ্ছেদ পন্থী। এরা গরিবের ছেলে তবু নতুন টাকায় রাক্ষস হয়ে ওঠার দল; যারা ‘ওয়ার অন টেররের’ বুশীয় নাটক মঞ্চস্থ করে মাদ্রাসার অনাথকে মৃত্যু মিছিলে এগিয়ে দেয়; কাকতাড়ুয়া বানিয়ে জঙ্গি নিধনের খেলা খেলে। এরা গলা ফাটিয়ে চেঁচায়, আপনি হয় আমাদের পক্ষে অথবা আমাদের বিরুদ্ধে।
এরা মুখে অসাম্প্রদায়িকতার গীত গেয়ে হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান-আদিবাসী নির্যাতন ও লুন্ঠনের মধ্যরাতের অশ্বারোহী। এরা শ্রমিক হত্যার টোটাবাহিনী। এরা ভয়ংকর নরভোজি যারা ভিন্নমতকে দমন করে ৫৭ ধারার ঘোড়ায় চড়ে; ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের রুমাল দিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে লেখক হত্যা করে। এরাই ব্লগার হত্যা করে সে দায় অজ্ঞাতনামার ওপর চাপিয়ে জঙ্গি জঙ্গি খেলে; এরা ক্ষমতা মদিরার প্রদীপ হয়ে ক্রসফায়ারে মানুষ মারে পাখির মতো করে।
চকচকে ব্লেডে দাড়ি কামিয়ে মানবতার মায়ের সঙ্গে ছবি তুলে; দেশের মালিক ও দেশপ্রেমের সার্টিফিকেট বিতরণের স্বপ্রণোদিত সুচিন্তক সেজে; শাকা ক্লাবে উঠতি জমিদারের লাস্যে দেশটাকে ভাগ-বাটোয়ারার আসর বসায়। এরা সেই প্রজাতি; যারা বৃটিশের রঙ্গক্লাবে জুড়ি গাড়ি করে নিয়ে গেছে অবোধ কিশোরীকে; যারা পাকিস্তানের খুনানিবাসে তুলে নিয়ে গেছে দীঘল চোখের তনুকে; যারা বাংলাদেশের ভাওয়ালপিন্ডিতে গড়ে তুলেছে পাপিয়ার বাইজিখানা; মুনিয়ার লাশ ঝুলিয়ে দিয়েছে উন্নয়নের লাখ টাকার এপার্টমেন্টে।
আর আমরা উপায়হীনতার ম্লানকন্ঠে বলেছি বারবার, “ঝিনুক নীরবে সহো” কিংবা এই তিল তিল মৃত্যু যন্ত্রণা সহ্যের হীরণ্ময় সুখের বিকল্প দেখান। পাঞ্জাবের খান গেছে; এখন বেঙ্গলের সহমত খান আছে; ঔপনিবেশিক প্রচ্ছায়া কিংবা কলোনিয়াল হ্যাং ওভার হয়ে; অন্ধ-অক্ষম-লোমওঠা ক্ষমতার নেকড়ে হয়ে।
– মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার শিক্ষক
প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া