স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ৫০ বছরের দুর্নীতির ছোবলে করোনাকালে মৃতপ্রায় বাংলাদেশ। হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরে অক্সিজেন না পেয়ে রাস্তায় মরে পড়ে থেকেছে বাংলা মা কিংবা তার সন্তান নরোত্তম। করোনাকালেও স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের বিবেক এতোটুকু জাগেনি; বরং করোনাকে দুর্নীতির বসন্ত হিসেবে উদযাপন করেছে তারা।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জগতে ঋজু একটি নাম রোজিনা। পত্রিকায় প্রকাশিত অসংখ্য প্রতিবেদনে রোজিনা উন্মোচন করেছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি রাক্ষসদের লুন্ঠনের চিত্র।
রাজা যায় রাজা আসে; কিন্তু সরকারি কর্মকর্তারা রয়ে যায়; দুর্নীতির চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নিয়ে। এর ওপরে ‘ভোটসমনিয়া’-র পাহারাদার হয়ে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা ক্ষমতায়িত হয়; সেই পাকিস্তান কালের স্বৈর-সরকারি কর্মচারিদের মতো।
তাই তো রোজিনা প্রতিবেদন তৈরির প্রয়োজনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গেলে;
দুর্নীতির ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশে আক্রোশ-অন্ধ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নারী কর্মচারি তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে জংলি ও জঙ্গিনেসা হয়ে। এইসব লোকজম্যান ও নেসাদের ভাগ্য বদলেছে বাংলাদেশ লুন্ঠন করে। এক স্বৈরাচারের আমলে নির্মিত মন্ত্রণালয়ের খাস কামরা আরেক স্বৈরাচারের আমলে টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহৃত হলো। রোজিনাকে পাঁচ ঘন্টা আটকে রেখে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের টুটি চেপে ধরে হাল-ফ্যাশনের হেয়ারডুতে দম্ভময়ী আদিম নেসা। গোলি থেকে রাজপথে উঠে আসা এইসব ফ্যাসিজমের ফুটসোলজার রাক্ষস; পান্তা থেকে পাস্তা খাওয়া ‘ফইন্নির ঘরের ফইন্নি’; থাগস অফ বেঙ্গলের জীনগত আশ্লেষ যেন।
পুলিশ-আইন আদালত এইসব দুর্নীতির লোকজ ম্যান ও নেসাদের গ্রেফতার না করে; গ্রেফতার করেছে দুর্নীতির তথ্য জনগণকে জানিয়ে দেয়া এক সংবাদযোদ্ধাকে। পুরো দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে কোন সাংবাদিককে মন্ত্রণালয়ের খাস কামরায় আটকে নির্যাতনের ঘটনা এই প্রথম। থাগস অফ বেঙ্গলেরা এতোটাই ক্ষমতাধর হয়েছে; যে ধরাকে সরা জ্ঞান করে; দুর্নীতির আত্মবিশ্বাসে গোরুড়ের ক্ষিদে নিয়ে দুর্নীতির দুষ্টচক্রকে টিকিয়ে রাখতে সাংবাদিক রোজিনার বিরুদ্ধে মামলা করেছে; ১৯২৩ সালে বৃটিশ লুন্ঠকদের প্রণীত আজকের তথ্যযুগে অচল এক ‘দাপ্তরিক গোপনীয়তা আইনে’।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা যেখানে জনস্বার্থে নিশ্চিত করার কথা; জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য জানার অধিকার যেখানে জনগণের ও সাংবাদিকের প্রাধিকার বা এনটাইটেলমেন্ট; সেইখানে রোজিনা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অবৈধভাগে সংগ্রহ করেছেন; এই স্বৈর-অবাস্তব অভিযোগে সারারাত থানায় আটক রইলেন; তাকে আদালতে নিয়ে গিয়ে রিমান্ডের আবেদন করেছে স্বাস্থ্য-খাতের ডাকাত-পক্ষ।
ডিজিটাল বাংলাদেশে; স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের আয়-ব্যয়ের হিসাব যেখানে প্রতিদিন উন্মুক্ত করার কথা সরকারি ওয়েব সাইটে; মন্ত্রণালয়ের তথ্য কর্মকর্তার যেখানে প্রতিদিন সাংবাদিকদের কাছে সরকারি-আয় ব্যয়ের তথ্য প্রদান করা দায়িত্ব; সেইখানে উলটো নরভোজি ক্রোধে রোজিনার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছে দুর্নীতিনেসা।
এই যদি ৫০ বছরে বাংলাদেশের হীন চিত্র হয়; তাহলে জনগণের জীবনের চেয়ে সরকারের গোপনীয়তা বড়; এমন একটি অলীক নরভোজিতার আদিম উপত্যকার গ্লানি; স্বাধীনতা শব্দটিকে মূল্যহীন করে। অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধের নতুন এই উপনিবেশে লুন্ঠনবাদের যে রিরংসা; তা দ্রোহের আগুন প্রজ্জ্বলিত করে; করোনাকালে স্বাস্থ্য-খাতের অবহেলায় মৃতের চিতার আগুন হয়; দুর্নীতিকে চাপা দেয়ার সরকারি অপকৌশল করোনায় স্বাস্থ্য-খাতের নিষ্ঠুরতায় মৃতের লাশ চাপা দেয়ার অকথ্য এক বিষাদসিন্ধু রচনা করে। দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ করার জনযুদ্ধের সাহসিকা রোজিনা আর কিছুই চায়নি; সে চেয়েছে দুর্নীতির দোজখ থেকে জনমানুষকে মুক্তি দিতে।