একটা প্রবাদ আছে, যদি সবাইকে খুশী রাখতে চাও; তবে তোমাকে আইসক্রিম সেলার হতে হবে। এই প্রবাদ বাক্যটি খুব ছোট কালে আব্বা শুনিয়েছিলেন। ঈশ্বরদীতে বাবুপাড়ায় আমাদের বাসার পাশে একটা আইসক্রিম ফ্যাক্টরি ছিলো। এর উদ্যোক্তা ছিলেন আব্বার শিক্ষকতা জীবনের প্রথম ব্যাচের ছাত্র ও জাসদের একজন নেতা। স্কুল থেকে ফেরার সময় ঐ ফ্যাক্টরিতে গিয়ে অর্ধেক দামে আইসক্রিম পাওয়া যেতো। উদ্যোক্তা আংকেল বলেছিলেন, এতো বেশি আইসক্রিম খেলে দাঁত পড়ে যাবে। উনি সমাজতন্ত্রী ছিলেন; আর আমার নাম ছিলো পাভেল। ফলে ঐ বাবুপাড়ার আইসক্রিম ফ্যাক্টরি আমার জন্য প্রায় ফ্রি হয়ে গিয়েছিলো। আমি তাই প্রায় প্রতিদিনই ছেলে ও মেয়ে বন্ধুদের নিয়ে সেখানে আইসক্রিম খেতে যেতাম।
আইসক্রিম ফ্যাক্টরির উদ্যোক্তা সমাজতন্ত্রী ভদ্রলোক সব মানুষের সঙ্গে এতো ভালো ব্যবহার করতেন যে; উনি ঈশ্বরদীর মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। আব্বার সঙ্গে দেখা করতে এলে আব্বা হাসতে হাসতে বলেছিলেন, সবাইকে খুশি রাখতে গেলে আইসক্রিম সেল করতে হয়। তুমি এই থিওরি প্রমাণ করে দিলে যে। সমাজতন্ত্রী ছাত্রটি হাসতে হাসতে বলেন, আপনাদের দোয়া স্যার। উনি আমার এই টিফিন আওয়ারে অন্য কিছু না খেয়ে আইসক্রিম খাওয়ার ব্যাপারটা আব্বাকে জানিয়ে দিলেন আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে। উনি একবার উনার ফ্যাক্টরি সংলগ্ন বাড়িতে নিয়ে গিয়ে জোর করে দুপুরের খাবার খাইয়ে তারপর প্লেটে করে আইসক্রিম এনে দিয়েছিলেন।
আম্মা বুঝে যান, আইসক্রিমের নেশায় কোনদিন টিফিন বাক্স খুলে দেখার অবকাশ ছিলো না আমার। বাক্সটি কেবল স্কুলে যেতো আর আসতো।
আমার যে বন্ধুরা আইসক্রিম ফ্যাক্টরিতে যেতো; তাদের একজন আইসক্রিম ফ্যাক্টরি বানিয়েছে পাকশির এক লিচু বাগানের ছায়ায়। সেই বন্ধু এই তো কিছুকাল আগে সেখানে নিয়ে গিয়ে বললো, পাভেল আমাদের নিজেদের আইসক্রিম ফ্যাক্টরি হয়েছে; যত খুশি খাও। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের কথাটা মনে পড়েছিলো, মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় হতে পারে।
স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে আজ পর্যন্ত আইসক্রিম আমার সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু। আইসক্রিম ফ্যাক্টরি বানাইনি; কারণ আইসক্রিমওয়ালাদের সঙ্গে এতো বন্ধুত্ব হয়ে যায়; যে তারা এক পর্যায়ে এসে আর দাম নিতে চাননা। তবে আচার-আচরণে আইসক্রিম ফ্যাক্টরির একজন উদ্যোক্তা বসবাস করে সবসময়। সবাইকে খুশি রাখার সে কী প্রাণান্ত চেষ্টা আমার। প্রথমে আব্বা-আম্মাকে খুশি রাখা, এরপর বন্ধু ও ছোট ভাই-বোনদের খুশি রাখা, স্ত্রী ও নারী বন্ধুদের খুশি রাখা, সন্তান ও তার বন্ধুদের খুশি রাখা; এসবই মিথ অফ সিসিফাস হলেও; চেষ্টা অব্যাহত থাকে। হয়তো কিছুই নাহি পাবো; তবুও তোমায় আমি দূর থেকে ভালোবেসে যাবো; এরকম একটা গান সবসময়ই প্রধানমন্ত্রী-বিরোধীদলীয় নেত্রী; সহমত ভাই ও ভিন্নমত ভাইদের উদ্দেশ্য করে মনে মনে গুন গুন করি। শৈশবে পর্যাপ্ত আইসক্রিম খায়নি এমন স্বপ্ন ভেঙ্গে যাওয়া রাগী মানুষ আমাকে মুঠি পাকিয়ে বলে, আপনার অবস্থান পরিষ্কার করুন। নিরপেক্ষতা-নৈর্ব্যক্তিকতা বলে কিছু নেই। কিন্তু আমার কাছে আইসক্রিমের প্রতিশব্দই যে নিরপেক্ষতা ও নৈর্ব্যক্তিকতা।
স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, থিয়েটার ও বিতর্ক আয়োজনের ক্ষেত্রে নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ আইসক্রিম ফ্যাক্টরি উদ্যোক্তা মনে করেছি। ধর্ম ও জাতীয়তাবাদকে কাঁচামাল বানিয়ে খরখরে দোকানদারিতে, ঘৃণার ফ্যাক্টরি তৈরি করে যারা; আমি সেই স্বকালের জগদ্দল পাথরের বিপরীতে প্রমিথীয় প্রজন্মের বন্ধুত্ব ও আইসক্রিমের ব্যারিকেড দিতে চেয়েছি। পেশাজীবনেও দপ্তরের দারোয়ান থেকে সর্বোচ্চপদের লোকের সঙ্গে বসে আইসক্রিম খেয়েছি প্রতিদিনই প্রায়; আক্ষরিক অর্থেই। বয়স বাড়লে অনুজ প্রতিম সহকর্মীদের নিয়ে আইসক্রিম খেয়েছি ও খাই।
ঈশ্বরদীর সেই সমাজতন্ত্রী আইসক্রিম ফ্যাক্টরি উদ্যোক্তা বাবু আংকেলের মতো ঢাকায় পেলাম মুক্তিযোদ্ধা আক্কু চৌধুরীকে। এটা আর উল্লেখ করার দরকার নেই যে বাবু আংকেলও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। সবাইকে খুশি রাখতে না চাইলে কেউ কী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যেতে পারে নাকি!
আক্কু ভাই তখন ইতালি থেকে শিখে এসেছেন বিশ্বের সেরা আইসক্রিম কীভাবে বানানো হয়। উনি বনানীতে ডলচে ভিটা নামের একটি আইসক্রিম-আলয় খুলে বেশ কম দামে আইসক্রিম খাওয়াতে চেষ্টা করেন তারুণ্যকে। সবাইকে এতো মিষ্টি হেসে স্বাগত জানাতেন; যে আইসক্রিম খাওয়ার আনন্দ বেড়ে যেতো। বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে আমাদের ব্যাচে একশোজন ছাত্রের মধ্যে সত্তর জনই বালিকা। তাদের নিরাপত্তা বিধান একটি সামাজিক দায়িত্ব। তাই শাহবাগ থেকে বনানী নিয়ে যেতে হতো তাদের আক্কু ভাইয়ের আইসক্রিমের স্বপ্ন ঘরে। আমার বন্ধুরা জিজ্ঞেস করতো, আক্কু ভাই কী তোকে কমিশন দেন নাকি। কী করে বোঝাই যে উনার সঙ্গে পরিচয় নেই। উনি সব তরুণ-তরুণীর দিকেই স্নেহ ভরে হেসে তাকান; টুকটাক কথা বলেন। আর ইতালিতে থেকে বাংলাদেশের আতিথেয়তার গুনের সঙ্গে মিশিয়ে খুব প্লেয্যন্ট পারসোনালিটি ছিলেন তিনি।
আক্কু ভাই মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠার পর দেখতে গেলাম। লুভরে মিউজিয়ামের মতো সাজানো সে জাদুঘর। ইতিহাসের একটা নান্দনিক ভ্রমণ; যাতে সত্য আছে-সুন্দর আছে মঙ্গল আছে; আর আছে নৈর্ব্যক্তিকতা। উনি নিজ হাতে যত্ন করে বধ্যভূমি থেকে ট্রাংকে করে নিয়ে আসা শহীদদের দেহাবশেষ সংরক্ষণ করছিলেন। এ দৃশ্য দেখেই ঠিক করলাম, যেহেতু রেডিও-টিভিতে কাজ করি; তাই বধ্যভূমি ও বিধবাদের গ্রাম নিয়ে ছোট ছোট অডিও-ভিজুয়াল প্রামাণ্য চিত্র বানাবো। আক্কু ভাই মানেই নতুন আইডিয়া; বুঝতে আর বাকী রইলো না।
উনি বার বার আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন, চেনা চেনা লাগছে হয়তো। কিন্তু সঙ্গে যে নারী বন্ধু ছিলো; তার সামনে আক্কু ভাইয়ের সঙ্গে গিয়ে কথা বললে যদি উনি জিজ্ঞেস করেন, কই তোমার অন্য বন্ধুরা কই; সেই ভয়ে দূর থেকে ভালোবেসে গেলাম আক্কু ভাইকে। অবশেষে ফেসবুকে এসে আমার প্রিয় আক্কু ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলো; অক্ষরালাপ হলো। ভিডিও চ্যাটিং হতে পারেনি; কারণ উনি ঢাকার কাজ শেষ করে নেপালে গিয়েছেন। আনন্দগৃহ বানিয়েছেন আর কৃষিকাজ করছেন পোখারার গ্রামের তরুণদের নিয়ে। ওখানে ইন্টারনেটের গতি থেমে গেছে মিষ্টি লাজুক গ্রামে।
ফেসবুকে এই আক্কু ভাইয়ের নতুন স্বর্গের ছবি দেখে আবারও বুঝলাম; মানুষ তার স্বপ্নের সমান সুখি হতে পারে।
করাচিতে আমার স্ত্রীর বড় ভাইয়ের বাড়িতে প্রথম নিমন্ত্রণে যেতেই ভাবী এসে বললেন, আজ তোমাকে একজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবো। আমার বড় ভাই। মোস্তফা উনার নাম। সারাজীবন পশ্চিমে কাটিয়ে এখন দেশে ফিরেছেন স্বর্গের খোঁজে। অবাক লাগলো; পাকিস্তানের দোজখে ভদ্রলোক হেভেন খুঁজতে এসেছেন; আর জায়গা পান নাই। উনি এলেন, হাতে বাস্কিন রবিনসের আইসক্রিম কেক। ভাবী পরে বললেন, উনার বড় ভাই এইদেশে এই আইসক্রিম ফ্যাক্টরির উদ্যোক্তা। ভদ্রলোক কোন ভূমিকা না করে বললেন, আমি কাশ্মীর থেকে উচ্ছেদ হয়ে আসা পরিবারের ছেলে; আমি জানি মাতৃভূমিতে দখলদারের বুটের শব্দ কত মর্মান্তিক। একাত্তরে পাকিস্তানের দখলদার বাহিনী যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে; আমরা তার বিপক্ষে ছিলাম। ইংলিশ মিডিয়াম কনভেন্টে অনেক বাঙালি বন্ধু ছিলো আমার; মাঝে হলো ছাড়াছাড়ি গেলাম কে কোথায়! তোমার চেহারা দেখে আজ সেই বাঙালি চেহারার কোমলতার স্মৃতি স্পর্শ করলো। আমাদের মতো বন্ধুত্বের মানুষের প্রতিবাদী কন্ঠের তো মূল্য নেই; আমরা শক্তিহীন মানুষ; আজো দেখো সেই শত্রুতার সেনাবাহিনী স্বদেশের তরুণদের গুম করে; মিডিয়ার ও বাকস্বাধীনতার টুটি চেপে ধরে। তবে আমি আশাবাদী রাক্ষসের সঙ্গে মানুষের লড়াই-এ মানুষই জিতবে।
এরপর উনি উনার ফোনে একটি ভিডিও দেখালেন, উনি আজকাল গ্রামেই বেশি থাকেন; তরুণ কৃষকদের নিয়ে কৃষিকাজ করে সময় কাটান। অপরাহ্নে তাদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে নেচে গেয়ে আনন্দ করেন। পল্লীগান-সূফি গানের এই আনন্দ আসরের ভিডিও দেখে মনে হলো, আনন্দধারা বহিছে ভুবনে; কেবল তাকে খুঁজে নিতে জানতে হয়।
– মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার শিক্ষক
প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া