রংপুরের এক ব্যবসায়ী একবার ঢাকায় গিয়ে একটা প্রাইভেট কারের শো রুম দেখছিলেন। শো রুমের সেলস বয় তাকে মহানগরীর মেজাজে বলে, অযথা আমগো টাইম লস করাইতেছেন। এইসব গাড়ির অনেক দাম। আপনের ডেরেস দেইখা বুঝা যায়; এতো দামি গাড়ি কেনার সামর্থ্য আপনার নাই। ভদ্রলোক তার ব্যবসার মালপত্তর টানা ট্রাকে ঢাকায় এসেছিলেন। সেটা শো রুমের অদূরে দাঁড় করানো ছিলো। তিনি ঐ শো রুমের সবগুলো গাড়ি ট্রাকে তুলে নেন। দাম পরিশোধ করেন দ্রুত।
এই একটা দুর্বলতা ঢাকার শো রুম গুলোর সেলস বয়-গার্লদের তো আছেই। হু ইজ হু চেনার ক্ষমতা তাদের নেই। ব্যাংকের কাছে লোন নিয়ে একটা গাড়ি কোনমতে কিনবে এমন ঠাশ ঠাশ করে ভুল ইংরেজি বলা কাস্টমারকে সে কোক খাওয়ায়। আর পুরো শো রুম কিনে নিতে পারবে; এমন লোককে পোশাক-জুতা দেখে; আর হাঁইটা আসছে দেখে নিতান্ত অবহেলা করবে। শেখ সাদি একবার এক বাড়িতে ছেঁড়া কাপড় পরে গিয়ে অপদস্থ হয়েছিলেন। পরের বার দামী কাপড় পরে একই বাড়িতে গিয়ে অনেক আতিথেয়তা পেয়ে খাবার পকেটে ঢুকিয়ে বলেছিলেন, এই খানা আমার পোশাকেরই প্রাপ্য।
ঢাকায় জীবনের ১৪ বছর কাটিয়েছি। আমার অন্যতম অবসর বিনোদন ছিলো টয়লেটের চপ্পল পরে গুলশান মার্কেটের বিভিন্ন দোকানে গিয়ে তাদের সঙ্গে রসিকতা করা। আমার নানা বুদ্ধি দিয়েছিলেন, পকেটে যখন অনেক টাকা; তখন মলিন পোশাক পরে ঘুরবে। ছিনতাইকারী তোমার দিকে ফিরেও চাইবে না। এই প্রবীন ব্যবসায়ীর দোয়ায়, অর্ধশতকের জীবনে কোনদিন কোথাও ছিনতাইকারীর কবলে পড়িনি। ইতালিতে রোমের ট্রামে এক নারী পকেটমার পকেটে হাত ঢুকালে খপ করে চেপে ধরি; অন্য ইতালিয়রা তাকে পুলিশে দিতে চাইলে; আমি তাকে ছেড়ে দিই; কারণ মেয়েটি উইকএন্ডে একটু খুশিজল খাওয়ার জন্য ফান্ড জোগাড় করতে চেয়েছিলো। ইতালির দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকদের শাস্তি দেয়া যায় না; তাদের মাফিয়া চক্রের কারণে; কেন বেচারা তরুণীকে পুলিশে দেবো আমি; কোন দুঃখে।
গুলশান মার্কেটে গিয়েছিলাম একবার কিছু স্বদেশী কারুশিল্পপণ্য কিনতে। উদ্দেশ্য ছিলো বিদেশী অতিথিদের উপহার দেবো। বিশেষ করে নৌকা-রিক্সা-ঝুমকা; এরকম আইটেম; যা বাংলাদেশের স্বকীয় সৌন্দর্য্যের চিহ্ন। সেলসম্যানেরা ব্যস্ত ছিলো ঝকঝকে জুতা পরে এসে দামাদামি করা লোকেদের নিয়ে। আমার দিকে সন্দেহ নিয়ে তাকাচ্ছিলো; মলিন ওয়াশরুম চপ্পল পরা লোকটা আবার কোন কিছু চুরি করে চম্পট দেয় কীনা। অনেক পরে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, খালি দেখবেন না নিবেন কিছু! আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমি জিনিস নিচ্ছি; আপনি কী ইউরোতে পেমেন্ট নিতে পারবেন ভাই! ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে যায় সেলসম্যান। সে সরি বলে; কারণ আমি আগে ঢুকেছি; কিন্তু সে সময় নষ্ট করেছে সুন্দর জুতা-স্যান্ডেল পরে দামাদামি করতে আসা লোকেদের ভুল ইংরেজির খপ্পরে পড়ে। এতো ভালো ছিলো এই সেলসম্যান যে অনায়াসে স্বীকার করে; শিক্ষা পাইলাম আজ; স্যান্ডেলে কিছু নাই; সব কিছু থাকে পকেটে। যা দেখা যায় না।
আমি যে পাবনা-ঈশ্বরদী-আড়ানী-রাজশাহীর চলনবিল এলাকার লোক; সেইখানে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর একজন মোটিভেশনাল স্পিকার বা কনসেপ্ট সেলসম্যান তথ্য প্রযুক্তিমন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে গিয়েছিলেন, তারুণ্যকে স্মার্ট হইতে শেখাতে। মোটিভেশন ভাই বললেন, সিক্সডিজিটটাই আসল; গুল্লি মারো অন্যসব। গুগুল কইরা কিছু ইংরেজি শিখবা; আইটি এক্সপার্ট হইবা; সিক্স ডিজিট কামাইবা, সুন্দর পোশাক পরবা; সিঙ্গাপুরে গিয়া বাঞ্জি জাম্পিং করবা। আমারে দেইখা শিখো; মাত্র ৩৫ টাকা নিয়ে ঢাকায় আসছিলাম; আজ আমাকে মন্ত্রী মহোদয় হেলিকপ্টারে করে চলনবিলে নিয়ে এসেছেন তোমাদের অনুপ্রেরণা দিতে। কী বলো! পারবা তো আমার মতো সাকসেসফুল হইতে।
মন্ত্রী খুব ভালো ছাত্রনেতা ছিলেন। এলাকার সব মানুষ তাকে পছন্দ করে। ঢাকায় গিয়ে তিনি জিঞ্জিরা মেইড কিছু মোটিভেশনাল স্পিকারের পাল্লায় পড়ে গেছেন। এইটা হয়; সহজ-সরল এলাকা থেকে এসে আমরাও মানুষকে টাকা ধার দিয়ে দিয়ে ফেসবুকে গালি দিয়ে তা শোধ করতে দেখেছি মেট্রোপলিটানের গ্লোরিয়াস ছিনতাইকারীদের। সুতরাং ঐ মন্ত্রীর চেয়ে আমি নিজে অনেক বোকা; সে তো বলাই বাহুল্য।
কিন্তু এই ধরণের মোটিভেশনাল স্পিকিং-এর সমস্যা হলো; বাচ্চাদের জীবনের সাফল্যের একটা ভুল সংজ্ঞা উপহার দেয়া। টাকাই জীবনে সবচেয়ে বড়; এর চেয়ে ভুল চিন্তা কিন্তু আর কিছুই হতে পারে না। টাকা হচ্ছে ‘লাস্যময়ী আলেয়া’র মতো; তার পিছে দৌড়ালে সে কখনো ধরা দেয়না। আর তাকে অবহেলা করলে টাকা গেয়ে ওঠে, প্রিয় যাই যাই বলোনা। টাকা দিয়ে সুখ কেনা যায় না। সুখ অনেকটা দেবী স্বরস্বতীর মতো; ঘরে টেকাটুকার দেবী লক্ষীর আরাধনা দেখলে; স্বরস্বতী চলে যায়। এরপর লক্ষীর মুখ ঝামটা খেয়ে বাকি জীবনটা কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়তে হয়।
আমার ছেলে একবার ঈশ্বরদীতে গিয়ে আমার বন্ধু নয়নের ডাল ফ্যাক্টরির সামনের অফিস রুমে বসে ছিলো। কিছু মানুষ আষাঢ় মাসে সাহায্য প্রার্থনায় এলে নয়ন তাদের সাহায্য করে হাসিমুখে। সাহায্য প্রার্থীরা চলে গেলে ছেলে জিজ্ঞেস করে, চাচ্চু ওরা কী বেগার! নয়ন উত্তর দেয়, পৃথিবীতে কোন বেগার নেই; সাহায্যপ্রার্থী আছে। মানুষকে সাহায্য করা আমাদের কর্তব্য। ঢাকা-কোলন-বন শহর ঘুরে আমার ছেলে যে ভুল ‘বেগার’ শব্দটি শিখেছিলো সেটা ঈশ্বরদীতে এসে নয়নের কাছ থেকে সংশোধন করে নেয়। এরপর দলীয় ছেলেরা চাঁদা নিতে এলে নয়ন তাদের ধমক দিয়ে বিদায় করে আমার ছেলেকে শেখায়, এই যে দেখো চাচ্চু; এরা সেই বেগার; যারা ‘লোভ’-এর কারণে চাঁদা তুলে বেড়ায়; আমি এদের চাকরি দিতে চেয়েছি এই কারখানায়; কিন্তু কাজ করে খাওয়ার কোন ইচ্ছা ওদের নেই। এরা হচ্ছে পলিটিক্যাল বেগার; আরেকরকম বেগার আছে যারা ধর্মের নামে ভিক্ষা করে বসে খায়। এরা অলস মানুষ।
নয়নের কাছে এইসব জ্ঞান নিয়ে ছেলে স্থির করে সে, পলিটিক্যাল সায়েন্স নিয়েই পড়বে। দাদা-দিদাকে জানিয়ে দেয় তার জীবনের লক্ষ্যের কথা।
এইরকম সচেতন জনপদ হচ্ছে; ঢাকার বাইরের পুরো বাংলাদেশ। যেখানে চায়ের স্টলগুলো এক একটা এরিস্টোটলের পাঠশালা। সেইখানে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে করে রাজকীয়-মোটিভেশনাল স্পিকার বা ওয়াজিটিউবার নিয়ে যাওয়া অর্থহীন। যে জনপদ শতবছরের প্রজ্ঞার আলোয় দেদীপ্যমান; সেখানে নতুন সব পিঁপড়াবিদ্যা হাজির করার অর্থ রাজধানীর লোভের ভাইরাস সারাদেশে স্প্রে করা।
মহানগর বারোরকম মানুষের জায়গা। ভাগ্যান্বেষণে চোর-ডাকাত-পকেটমার-ছিনতাইকারী মহানগরীতে আসে। তাদেরকেই আদর করে, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, আম ও জলপাই আমলা, ১৫ মিনিটের সেলিব্রেটি, মোটিভেশনাল স্পিকার; ইত্যাদি নামে ডাকি আমরা।
অল্প জায়গায় ঠাসাঠাসি করে অনেক মানুষ বাস করলে; দোজখের কড়াইয়ের মতো হয়ে যায় জায়গাটা। সেই দোজখের কড়াইয়ের জীবনকে মিডিয়ার বিজ্ঞাপনের ইলিউশানে ‘ফেয়ার এন্ড লাভলি’ বসুন্ধরা বা রাজকীয় রঙ্গভবন কিংবা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার শাকা ক্লাব ও শাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সফল যারা কেমন তারা’ হিসেবে দেখিয়ে দৈনিক শেষের আলো; মিলন কন্ঠ আর বাতাবিত্তোর জার্নাল-ভিত্তিক যে জ্ঞান; ঐটাই দোজখ বিদ্যা, দেশের সম্পদ লুন্ঠন করে পশ্চিমের বেহেশতে সেকেন্ড হোমার হবার দুর্নীতি নামের অন্ধত্ব।
আমাদের পাবনা-রাজশাহী এলাকায়; কোটিপতিদের বসবাস কয়েকশো বছর ধরে। কিন্তু এলাকার শিক্ষা, সাদাসিধে জীবনযাপন ও সুনাগরিক হয়ে ওঠা। জালালউদ্দীন রুমির মতো করে বাইরে সুখ না খুঁজে মনের মাঝে সুখ খোঁজার শিক্ষা সেই কবেই দিয়ে গেছেন কুষ্টিয়ার লালন। জন লেননের ইমাজিন দেয়ার ইজ নো হেভেন; কী অবলীলায় লালনের ‘মিলন হবে কতো দিনে; আমার মনের মানুষের সনে’ দর্শনের সঙ্গে মিলে যায়। সেইখানে নতুন করে আম বেচে কোটিপতি-কলা বেচে রথ দেখার শিক্ষাগুলো এ এলাকায় এখন যারা দিচ্ছেন; এরা মহানগরে গিয়ে ‘আশার ছলনে ভুলি’ জীবনে সাফল্যের ভুল সংজ্ঞাকে আঁকড়ে ধরেছেন। ‘লোভে পাপ আর পাপে মৃত্যু’ কিংবা ‘ডালিম পাকিলে তা নিজেই ফেটে যায়; ছোটলোক বড় হলে বন্ধুকে কাঁদায়’ এরকম প্রবচন মিশে আছে যে সরল-সবুজ-জনপদে; সেইখানে সিক্স ডিজিট, স্মার্টনেস আর বাঞ্জি জাম্পিং শেখাতে যাওয়া নেহাত বোকামি।
–