ঢাকা করেসপনডেন্ট
নানা প্রলোভনে ভারতে বাংলাদেশি তরুণীদের পাচার করছে একটি চক্র। দেশটিতে নেয়ার পর যৌনকর্মে বাধ্য করানো হচ্ছে বলে গণমাধ্যমের খবরে এসেছে। সম্প্রতি বেঙ্গালুরুতে বিবস্ত্র করে এক বাংলাদেশি তরুণীকে নির্যাতনের ঘটনা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে বিষয় জোরালোভাবে আলোচনায় আসে। এ ঘটনায় ঢাকার হাতিরঝিল থানায় কয়েকটি মামলাও হয়েছে। মামলাকারী তরুণীদের একজন তার নিজ স্বামীর বিরুদ্ধেই পাচারের অভিযোগ এনেছেন। ৭০ হাজার টাকায় নিজ স্বামী তাকে যৌনকর্মী হিসেবে বিক্রি করে দেয় বলে ঢাকার অনলাইন গণমাধ্যম বিডি নিউজ টোয়েন্টি ফোর ডট কমকে জানিয়েছেন। প্রতিবেদনটি করেছেন বিডি নিউজের গোলাম মোর্তজা ধ্রুব। সোজা কথার পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো।
ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন বাস কন্ডাক্টর জাহিদুল ইসলাম রনিকে; কিন্তু বিয়ের কিছুদিন পরই উবে যায় ভালোবাসা, যখন স্বামীর উড়নচণ্ডী স্বভাব আর মাদকাসক্তির কথা জানতে পারেন। বলা-কওয়া নেই, প্রায়ই উধাও হয়ে যেতেন ২৭ বছর বয়সী রনি। গতবছরও নিখোঁজ হয়েছিলেন। ১২ দিন পর এ বছরের ১ জানুয়ারি ঘরে ফিরে এসে স্ত্রীকে ভারতে ‘চাকরি’ পাওয়ার সুখবর দেন।
এরপর ৬ জানুয়ারি ভারতে ‘বৃদ্ধাশ্রমে চাকরি করতে’ রনির সঙ্গে ভারতে রওনা দেন পোশাক কারখানার কর্মী স্ত্রী। তারপরের অভিজ্ঞতা ভয়ঙ্কর নির্যাতনের। মেয়েটিকে ভারতে জোর করে যৌনকর্মে নিযুক্ত করা হয়। দীর্ঘ সময় পর গত ১০ মে পালিয়ে দেশে আসেন ওই তরুণী। গত বৃহস্পতিবার স্বামী রনিসহ নয়জনের বিরুদ্ধে ঢাকার হাতিরঝিল থানায় মামলা করেন তিনি।
মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় আরও কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাতিরঝিল থানার ওসি আব্দুর রশীদ। তিনি বলেন, “মামলার তদন্ত চলছে। আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।”
এর আগে গত ১ মে ভারত থেকে পালিয়ে আসা আরেক কিশোরী হাতিরঝিল থানায় মানবপাচার আইনে মামলা করেছেন। ভারতে অবর্ণনীয় নির্যাতন ভোগ করে পাচারের ৭৭ দিন পর গত ৭ মে পালিয়ে দেশে ফিরতে সক্ষম হন ওই কিশোরী। তার মামলায় রিফাদুল ইসলাম ওরফে টিকটক হৃদয় বাবুসহ ১২ জনকে আসামি করা হয়।
মগবাজারের নয়াটোলার বাসিন্দা হৃদয় বাবু (২১) একটি আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী চক্রের ‘সমন্বয়ক’ বলে জানিয়েছে পুলিশ। বেঙ্গালুরুতে এক তরুণীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর চলতি মাসে ভারতের পুলিশ হৃদয় বাবুসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে।
গত বৃহস্পতিবার পোশাককর্মী তরুণী তার দায়ের করা মামলায় বলেছেন, স্বামী রনি মিরপুর-যাত্রাবাড়ী পথে চলাচলকারী একটি বাসের কন্ডাক্টর ছিলেন। বিয়ে করার পর তারা যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকায় থাকতেন। বিয়ের কয়েক মাসের মাথায় উধাও হয়ে যান রনি। এর মধ্যেই তিনি অন্তঃস্বত্ত্বা হন। স্বামী তিনমাস উধাও থাকার সময় খাবারের কষ্টে পড়লে শাশুড়ী ও ননদের পরামর্শে গর্ভের ভ্রুণ নষ্ট করতে হয় তাকে।
কয়েক দফায় প্রায় সাত মাস উধাও ছিলেন রনি। তৃতীয় দফায় ১২ দিন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকার পর বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে জানান, ৩০ হাজার টাকা বেতনে ভারতের একটি বৃদ্ধাশ্রমে স্ত্রীর জন্য কাজ ঠিক করেছেন তিনি। স্ত্রীকে রাজি করিয়ে পরদিনই ‘নদী ম্যাডাম’ নামের এক নারীর কাছে নিয়ে যান রনি। ওই নারী জানিয়ে দেন, চাকরি পেতে হলে ৬ জানুয়ারি ভারতে যেতে হবে।
মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, ৬ জানুয়ারি ঢাকা থেকে ‘নদী ম্যাডামের’ সঙ্গে বাসে সাতক্ষীরা যান রনি ও তার স্ত্রী। এরপর আরও চারটি মেয়ের সঙ্গে তারা সীমান্ত পার হন। ওপারে যাওয়ার পর তাকে উড়োজাহাজে করে চেন্নাইয়ে নেওয়া হয়। এরপর নদী ম্যাডামের আসল রূপ দেখতে পান ওই তরুণী। তাকে জবরদস্তিমূলকভাবে যৌনকর্মে নিযুক্ত করা হয়। বাধা দিতে চাইলে তার নগ্ন ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। এছাড়া বিনা পাসপোর্টে ভারতে ঢোকায় পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার ভয় দেখানো হয় বলে মামলায় অভিযোগ করেছেন ওই তরুণী। তিনি জানিয়েছেন, চেন্নাইতে কয়েকজন তাকে বলেছে, তারা ‘নদী ম্যাডামের’ কাছ থেকে ৭০ হাজার টাকায় কিনেছেন তাকে।
এজাহারে ওই তরুণী লিখেছেন, প্রতিদিন তাকে তালাবন্ধ করে রাখা হত। তার ঘরে লোক ঢুকিয়ে আবারও তালা মেরে দেওয়া হত। প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ জনের সঙ্গে যৌনকর্মে বাধ্য করা হত। এক সময় কলকাতার এক বাঙালির কাছে তিনি দেশে ফেরার আকুতি জানালে ওই ব্যক্তি তাকে গোপনে ২০ হাজার টাকা দেন। এর মধ্যেই হোটেল থেকে একটি ম্যাসেজ পার্লারের কাজে দেওয়া হয়েছিল তাকে। সেখান থেকেই সুযোগ বুঝে জানালার কাচ ভেঙে ওই তরুণী পালিয়ে প্রথমে কলকাতায় এবং পরে সাতক্ষীরা হয়ে দেশে ফেরেন বলে মামলায় উল্লখ করা হয়েছে।