অল্প কয়েকদিন আগে সাফ অনুর্ধ ১৯ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশীপে শক্তিশালী ভারতকে ১–০ গোলে পরাজিত করে শিরোপা জয়লাভ করে বাংলাদেশের দুরন্ত কিশোরীরা। পুরো টুর্নামেন্টে একমাত্র বাংলাদেশ ছিল অপরাজিত দল। সর্বোচ্চ সংখ্যক আদিবাসী খেলোয়াড়দের উপস্থিতি দেখা গেছে এবার সাফ অনূর্ধ্ব ১৯ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশীপের বাংলাদেশ দলে। মারিয়া মান্দা, মনিকা চাকমা, ঋতুপর্ণা চাকমা, রিপনা চাকমা, আনুচিং মগিনি আর আনাই মগিনি এই ছয় নিয়মিত খেলোয়াড় ছাড়াও দলে ছিল দু‘জন সাঁওতাল নারী ফুটবলার। আমার পুরো মনে নেই, সম্ভবত লিওনি আজিম নামে আরো একজন গারো খেলোয়াড়ও ছিল দলে। বিজয়ী পুরো দলের সাফল্যে আনন্দে ভাসছে বাংলাদেশ আজ কয়েকদিন ধরেই। দলের দুই আদিবাসী খেলোয়াড় আনাই মগিনি আর ঋতুপর্না চাকমা এবার অন্যরকম নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে পুরো দেশের মানুষের, যদিও এবারের পুরো টুর্নামেন্টেই দলের সকল খেলোয়াড়ের খেলাই ছিল অসাধারণ। তবে একথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই গত কয়েকবছর ধরে দলে কৃতি আদিবাসী কিশোরী খেলোয়াড়দের অন্তর্ভুক্তি দলে এনেছে এক ভিন্নমাত্রা, দলকে যুগিয়েছে বাড়তি শক্তি। মারিয়া মান্দার নেতৃত্বে দেশের বয়সভিত্তিক জাতীয় দল কৃতিত্ব দেখিয়ে আসছে প্রথম থেকেই।
যা–ই হোক, এতো গেল বর্তমানে দলে সক্রিয় থাকা আদিবাসী কিশোরী খেলোয়াড়দের সফলতার কথা। এবার শোনাবো ঠিক এদের মতোই আরেক আদিবাসী কিশোরী খেলোয়াড়ের করুণ গল্প।
আজকের আনুচিং মগিনি, আনাই মগিনি, মনিকা চাকমা, রিপনা চাকমা ও ঋতুপর্না চাকমাদের সাথী ছিল চাথুইমা মারমা নামে পার্বত্য চট্টগ্রামেরই আরেক আদিবাসী কৃতি খেলোয়াড়। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে আনুচিং, আনাই, মনিকা, রিপনা, ঋতুপর্নাদের খেলোয়াড়ী জীবনের জন্মের পেছনে যে ইতিহাস সে একই ইতিহাস চাথুইমা মারমারও। একসাথে একই মাঠে খেলে, একই প্রশিক্ষকগণের তত্ত্বাবধায়নে থেকেই এদের সবার খেলোয়াড়ী জীবনের সূচনা হয়েছিল। চাথুইমা ছিল অনূর্ধ্ব ১৪ জাতীয় দলের একজন নিয়মিত খেলোয়াড়। খেলতো স্ট্রাইকার পজিশনে, পরিচয় ছিল দুর্ধর্ষ একজন কিশোরী স্ট্রাইকার হিসেবে। ২০১৪ সালে শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত এএফসি অনূর্ধ্ব ১৪ আঞ্চলিক মহিলা ফুটবল চ্যাম্পিয়নশীপে বাংলাদেশ জাতীয় দলের সদস্য ছিল চাথুইমা মারমা। সেই প্রতিযোগিতাসহ জাতীয় এবং স্থানীয় পর্যায়ে তার কৃতিত্ব ছিল উল্লেখযোগ্য। চাথুইমা ছিল গোল্ডেন বুট জয়ী একজন খেলোয়াড়। তার অসাধারণ নৈপূন্যের কারণে ২০১১ সালের বঙ্গমাতা ফুটবল প্রতিযোগিতায় তার তখনকার বিদ্যালয় রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার কাউখালি উপজেলার ঘাগড়া এলাকায় অবস্থিত মগাছড়ি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। এরপর ২০১২ এবং ২০১৩ সালে পরপর দুইবার তার দল জাতীয় পর্যায়ে রানার্সআপ হয়। ২০১৩ সালে তার দল বিজয়ী হতে না পারলেও সর্বোচ্চ গোলদাতা হিসেবে চাথুইমা জিতে নেয় গোল্ডেন বুট।
কিন্তু সবকিছু শেষ হয়ে গেছে একটা দূর্ঘটনার শিকার হয়ে। ২০১৫ সালে নেপালে অনুষ্ঠিত একটা প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার জন্য জাতীয় দলের হয়ে অনুশীলন করার সময় মারাত্মক আহত হয় চাথুইমা, ছিঁড়ে যায় পায়ের লিগামেন্ট। অথচ দুঃখের বিষয় দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনার লক্ষ্যে খেলতে গিয়ে মারাত্মক আহত হলেও তখন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন, সরকারসহ কেউই দাঁড়ায় নাই তার পাশে। বাদ দিয়ে দেওয়া হয় তাকে জাতীয় দল থেকেও। একটা জটিল অপারেশন সফলভাবে সম্পন্ন করতে পারলে হয়তোবা চাথুইমা আবারও মাঠে ফিরে আসতে পারতো, কিন্তু দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান চাথুইমা মারমার সেই সক্ষমতা ছিল না। অনেক চেষ্টা তদবির করেও কোন সহযোগিতা পায়নি সে তখন, কেবলমাত্র রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে তাকে ৫০ হাজার টাকা অনুদান দিয়েছিলেন তখনকার জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মহোদয়। সেই টাকাও প্রাথমিক চিকিৎসা করাতে গিয়ে শেষ হয়ে যায়। অথচ তখন মাত্র দুই তিন লাখ টাকার বন্দোবস্ত করা গেলে হয়তোবা চাথুইমা এখনও সমানতালে তাল মিলিয়ে মাঠে থাকতো আনাই, ঋতুপর্নাদের পাশে। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা না হওয়ায় এক সময় পায়ে পচন ধরে চাথুইমা মারমার।
মাত্র পাঁচ বছর আগেও নারী জাতীয় ফুটবল দলের আনুচিং, আনাই ও মনিকা চাকমাদের অনুপ্রেরণা ছিল চাথুইমা মারমা। তারা জানিয়েছিল, চাথুইমা মারমা তাদের সঙ্গে খেলতে না পারায় তার শূন্যতা সবসময় অনুভব করছে তারা। চাথুইমা ছিল তাদের অনুপ্রেরণা। সে অসাধারণ ফুটবল খেলত। কিন্তু চোট পাওয়ার পর থেকে পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। তারা নিজেরাও চাথুইমার চিকিৎসার জন্য সরকারের সহায়তা কামনা করে তখন।
অবশেষে অনেক সময় পার হওয়ার পর প্রায় দুই বছর পরে আমাদের তখনকার লেখালেখি, আর কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হওয়া সংবাদের কারণে বিষয়টি চোখে পড়ে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় নিয়োজিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নজরে। তখনকার জোন কমান্ডার সাহেবের আন্তরিক চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত মেয়েটির দীর্ঘ সময় ধরে চিকিৎসা চলে চট্টগ্রাম সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে। তাতে করে চিরকালের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করার কবল থেকে বেঁচে যায় চাথুইমা ঠিকই, কিন্তু খেলার মাঠে ফিরে আসার সুযোগ আর হয়নি তার। কারণ ততদিনে সেই সক্ষমতা হারিয়েছে মেয়েটি।
সেদিনের সেই কৃতি খেলোয়াড় চাথুইমা মারমা আজ একজন কারখানা শ্রমিক। সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় খানিকটা সুস্থ হয়ে উঠলেও আগামী দিনগুলো কিভাবে কাটবে সেই চিন্তা ঘিরে ধরে চাথুইমা মারমাকে। একটা কাজের সন্ধানে ২০১৯ সালের প্রথমদিকে রাঙ্গামাটি থেকে চট্টগ্রামে আসে সে। কিন্তু কোন কাজ জোগাড় করতে পারে নাই। চরম হতাশায় নিমর্জিত চাথুইমার সহযোগিতায় তখন দেবদূতের মতো এগিয়ে আসেন তার এক বান্ধবী। সে তাকে আশ্বাস দেয় কাজ জোগাড় না হওয়া অবধি তার আশ্রয়ে থাকবে চাথুইমা, তার থাকা খাওয়া কাপড়চোপড় সবকিছুর ব্যবস্থা করে সেই বান্ধবী। শেষ অবধি গত পাঁচমাস আগে কয়েক হিতাকাঙ্খীর সহায়তায় জুতা তৈরির কারখানায় সহকারী অপারেটর হিসেবে একটা কাজ পায়। দেশের সম্মানের জন্য যে মেয়েটি পায়ে বল নিয়ে ক্ষিপ্তগতিতে ছুটে যেতো প্রতিপক্ষের গোলবার লক্ষ্য করে, জীবন সংগ্রামে লিপ্ত সেই দরিদ্র পরিবারের সন্তান চাথুইমা জীবন বাঁচানোর আর কোন অবলম্বন না পেয়ে খেলার মাঠের পরিবর্তে চট্টগ্রামের কালুরঘাট শিল্প এলাকায় একটা কারখানায় বেছে নিয়েছে শ্রমিকের জীবন।
বাংলাদেশে ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন বাফুফে। বাফুফে‘র সামান্য পৃষ্ঠপোষকতা একজন খেলোয়াড়কে নিয়ে যেতে পারে সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরে, এমনকি খেলোয়াড় জীবন শেষে সেই মানুষটি হতে পারে কোন সফল ব্যবসায়ী কিংবা বৃহৎ একটা কারখানার মালিক (আরো অনেক কিছুই হতে পারে)। আর একইভাবে বাফুফে‘র অবহেলার শিকার হয়ে কোন কৃতি খেলোয়াড়ও জীবন সংগ্রামের জন্য বনে যেতে পারে শেষ পর্যন্ত কারখানার এক সাধারণ শ্রমিক!
বাফুফে‘র অর্থের অভাব ছিল না কখনো, এখনো নাই। কিন্তু সদিচ্ছার অভাব যে শতভাগ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বয়স ভিত্তিক জাতীয় নারী ফুটবল দলের সাবেক কৃতি স্ট্রাইকার চাথুইমা মারমা যখন দেশের হয়ে খেলতে গিয়ে গুরুতর আঘাত পায় তখনই যদি বাফুফে চিকিৎসার জন্য সামান্য সহায়তা দিয়ে মেয়েটির পাশে দাঁড়াতো তাহলে মেয়েটি আবারও খেলার মাঠে ফিরে আসতে পারতো, দেখাতে পারতো তার নৈপুণ্য, দেশের জন্য বয়ে আনতে পারতো সম্মান। কিন্তু তা হয়নি বলেই খেলার মাঠ থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে এই অসাধারণ দক্ষতার অধিকারী খেলোয়াড়টা।
আজ যে কিশোরী ফুটবল খেলোয়াড়দের নিয়ে এতো মাতামাতি সারা দেশজুড়ে, কাল খোদা না করুন তাদের কারো কোন অঘটন ঘটে গেলে সে–ও যে চাথুইমা‘র মতোই দূর্ভাগ্য বরণ করতে হবে না – তার নিশ্চয়তা কে দিবে? বাফুফে‘র নীতিমালায় কি শুধু খেলোয়াড় খেলতে পারলে তবেই তার পাশে থাকা যাবে, নয়তো নয়– এমন কোন নীতিমালা আছে কি–না তা আমার জানা নাই। যদি থাকে তো অবশ্যই সেটা পরিবর্তন করা দরকার খেলা আর খেলোয়াড়দের তথা দেশেরই স্বার্থে। এতো বছর পরে চাথুইমাকে আবারও সবার সামনে তুলে আনার একটাই কারণ – মনে করিয়ে দেওয়া, আর যেন কারো জীবনে এমন ঘোর অমানিশার উদয় না হয়। বাফুফে‘র লগো সম্বলিত, বুকে আমাদের জাতীয় পাতকা শোভিত ট্র্যাকশ্যূট পরে আজ চাথুইমা মারমা জুতা তৈরির কারখানায় দীর্ঘ সময় ধরে দাঁড়িয়ে কাজ করতে কষ্ট হলেও হাসিমুখে জুতা তৈরির কাজ করছে – এটা দেখে হলেও বাফুফে‘র লজ্জা হওয়া উচিত, লজ্জিত হওয়া দরকার আমাদেরও।