নিজস্ব প্রতিবেদক ঢাকা থেকে
বিভিন্ন সূচক পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, ২০২১ সময়কালে রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার সর্বোপরি মানবাধিকারের ক্ষেত্রে কার্যত কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবনতি হয়েছে। ৩১ ডিসেম্বর, ২০২১ শুক্রবার বিকেলে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) উদ্যোগে আয়োজিত ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটিতে ‘বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০২১ এমএসএফ’র পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা এ কথা বলেন।
সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)-এর ফাউন্ডার প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, মূল বক্তব্য পাঠ করেন এমএসএফ ‘র নির্বাহী প্রধান অ্যাডভোকেট মো: সাইদুর রহমান আরো উপস্থিত ছিলেন এমএসএফ সমন্বয়কারী মোহাম্মদ টিপু সুলতান ও এমএসএফ কর্মীবৃন্দ।
বক্তারা বলেন, চলমান মহামারী করোনায় বিশ্বব্যাপী অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে। যদিও বাংলাদেশ সরকার করোনা নিয়ন্ত্রণে লকডাউন ঘোষণা ও দ্রুত টিকা প্রদানের মাধ্যমে করোনার ঝুঁকি কমাতে সক্ষম হয়েছে। তারপরও এ সময়ে অনেক মানুষ কাজ হারিয়েছেন এবং দারিদ্রসীমার নিচে নেমে যাওয়া মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে যার ফলে সমাজে বৈষম্য বেড়েছে এবং মানবাধিকার লংঘিত হয়েছে। তারা বলেন, জানুয়ারী থেকে ডিসেম্বর ২০২১ সময়কালে, দেশে বিরাজমান সামগ্রিক মানবাধিকার পরিস্থিতি ছিল লক্ষনীয়ভাবে উদ্বেগজনক ।
গণ মাধ্যমের তথ্যের বরাত দিয়ে তারা বলেন, ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে এ বছরের সবচাইতে উদ্বেগজনক ঘটনা ঘটেছে। এ মাসে সনাতন ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়ের দূর্গাপূজা পালনকালে তাঁদের উপর সুপরিকল্পিত ও নিরবচ্ছিন্ন সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের সার্বজনীন এই দূর্গোৎসব চলাকালে কুমিল্লায় অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির সৃষ্টি এবং এর জের ধরে ধর্মীয় উগ্রবাদী ও সুবিধাভোগী গোষ্ঠী নোয়াখালি এবং রংপুরসহ ১৯টি জেলার বিভিন্ন পুজামন্ডপ ও মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগ করে। অপরদিকে পুলিশ ও হামলাকারীদের মধ্যেও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, মানবাধিকার লংঘনের আরেকটি ক্ষেত্র ছিল ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে সহিংসতা, হানাহানি ও হতাহতের ঘটনা। মনোনয়ন না পাওয়ায় অধিকাংশ স্থানেই আওয়ামী লীগের নেতারা বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ফলে উভয় পক্ষ নির্বাচনী মাঠ দখলে সংঘাত ও সহিংসতার আশ্রয় নেন। ক্ষমতাসীন দলের নিজেদের মধ্যকার সংঘাত-হিংস্রতা নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দৃশ্যত কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। নির্বাচনী সংঘাত, সহিংসতা ও নানাবিধ অনিয়মের কারণে জনগণ স্বাধীনভাবে নিজেদের পছন্দের প্রতিনিধি নির্বাচন করার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ফলে নির্বাচনগুলি ধারাবাহিকভাবে জনগণের কাছে প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে।
তারা বলেন, এমএসএফ’র তথ্যানুসন্ধান এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ২০২১ সালে গুমের অভিযোগ কিছুটা কম থাকলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড অব্যাহত রয়েছে। বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ার, হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। অন্যদিকে দেশের সীমান্তগুলিতে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশী নাগরিকের হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। স্বাধীন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে এ বছরের চিত্র ছিল উদ্বেগজনক। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার করে সাধারণ নাগরিকের বস্তুনিষ্ঠ ও স্বাধীন চিন্তা, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা এবং মতামত প্রকাশের সংবিধান প্রদত্ত অধিকার প্রয়োগের পথ রুদ্ধ করার মত ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতার ঘটনাসমূহ এই সময়ে কমে নাই বরং অধিক সংখ্যায় ঘটেছে যা ছিল ২০২১ সালের অন্যতম একটি উদ্বেগের বিষয়। ধর্ষণ, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, ধর্ষণজনিত হত্যা, যৌন হয়রানি, নির্যাতন, আত্মহত্যা ও হত্যার ঘটনার সংখ্যা অতীতের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে।
বিভিন্ন পোষাক কারখানায় শ্রমিকদের বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধের দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের দমনে পুলিশ অযাচিতভাবে বল প্রয়োগ করেছে। কর্তৃপক্ষের অবহেলা, অনিরাপদ ও ঝুকিপূর্ণ কর্মপরিবেশের কারণে বিভিন্ন কারখানায় অগ্নিকান্ডের ঘটনায় শ্রমিক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। অপরদিকে গণপিটুনির মতো ঘটনাও বৃদ্ধি পেয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করা হয়।
২০২১ সালের মানবাধিকার পরিস্থিতির উপর এমএসএফ প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ পাঠকদের জন্য নিম্নে দেয়া হলো-
বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড
আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভাষ্য ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য মোতাবেক ২০২১ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর সাথে ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ ও গুলিবিনিময়ে ৪৮ জন নিহত হয়েছেন। ১৩ জন রোহিঙ্গাসহ ২২ জন কথিত মাদককারবারী, বিভিন্ন মামলার আসামী ৯ জন এবং ডাকাতি ও ছিনতাইয়ে ১১জন নিহতহয়েছেন। বাকী ৬ জন অন্যান্য পেশায় জড়িত ছিলেন। এ সংক্রান্ত কিছু কেস স্টাডি নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
১২ অক্টোবর, ২০২১ তারিখে চট্টগ্রামের বাঁশখালীর গণ্ডামারা গ্রামে র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মো. আলমগীর (৪৫) নামের এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। র্যাবের দাবি মো. আলমগীর ওরফে আলম, ডাকাত দলের সদস্য ছিল।
২৬ নভেম্বর, ২০২১ কক্সবাজারের টেকনাফ বন্দরের বিপরীতে পাহাড়ি এলাকায় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে কেফায়েত উল্লাহ ও কোরবান আলী প্রকাশ নামের দুই জন রোহিঙ্গা ডাকাত নিহত হয়েছেন। র্যাবের দাবি নিহত কেফায়েত উল্লাহ ও কোরবান আলী প্রকাশ চিহ্নিত ডাকাত ও মাদককারবারি। তাদের বিরুদ্ধে মাদক ও অস্ত্র আইনে একাধিক মামলা রয়েছে বলে জানানো হয়েছে।
২৯ নভেম্বর, ২০২১ কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরসহ জোড়া খুনের ঘটনায় দায়ের করা মামলার দুই আসামি মো.সাব্বির হোসেন (২৮) ও সাজন (৩২) জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) ও থানা পুলিশের সঙ্গে ‘বন্ধুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে। ১৭ আগষ্ট কক্সবাজার টেকনাফের হোয়াইক্যং এবং টেকনাফের বিজভীখাল এলাকায় বিজিবি সাথে মাদককারবারিদের বন্দুকযুদ্ধে মীর কাসেম (২৫) কে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আটক করে এবং অপর একজন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় নদীর স্রোতে তলিয়ে যান।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ, গুম ও নিখোঁজ
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে একাধিক ব্যক্তিকে অপহরণ এবং পরবর্তী সময়ে তাদের নিখোঁজ বা গুম হওয়ার অধিকাংশ ঘটনার তথ্য পাওয়া গেছে। ভূক্তভোগীদের দাবি মোতাবেক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে সাদা পোশাকে কাউকে তুলে নেওয়ার অভিযোগ করলেও সংশ্লিষ্ট বাহিনী কর্তৃক তাদের গ্রেফতার বা আটকের বিষয়টি অস্বীকার করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে থানাতে এসব ঘটনার কোন অভিযোগ নেয়া হয় না। আবার অনেক ক্ষেত্রে গুম হওয়ার বেশ কয়েকদিন পর তাদের কোন একটি মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী ২০২১ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ, গুম ও নিখোঁজ হয়েছেন ১১ জন। পরবর্তীতে ৭জনকে মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে ও চারজন এখন পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছেন। মানবাধিকার কর্মী ও নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে বারংবার দাবি করা সত্বেও বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের ক্ষেত্রে সুনির্দিস্ট ও বিশ্বাসযোগ্য কোন ব্যাখ্যা বা তথ্য দেওয়া হয় না। কেস স্টাডি নিম্নে দেওয়া হলো-
গত ২রা জুন, ২০২১ নারায়ণগঞ্জের তিনজনকে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) পরিচয় দিয়ে তুলে নিয়ে যায়, ২৫ দিন পার হলেও স্বজনরা এখন পর্যন্ত তাঁর কোন খোঁজ পায়নি। নিখোঁজ তিনজন হলেন নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের পাঁচরুখী গ্রামের বাসিন্দা মো. নোমান, মো. নাছিম ও বগুড়ার শহিদুল ইসলাম। এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ থানা পুলিশ কোন তথ্য দিতে অপরাগতা প্রকাশ করে। অপর দিকে ৪ আগস্ট ২০২১ রিজওয়ান হাসান রাকিন সকাল ৮টা ৪০মিনিটে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামেন, এরপর তাঁর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি কোথায় আছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ কিছু বলতেও পারছেন না বলে অভিযোগ করেছেন রিজওয়ানের বাবা। রিজওয়ান হাসান রাকিনের নানা ঘটনার পরপরই বিমানবন্দর থানায় সাধারণ ডায়েরি করতে গিয়েছিলেন। পুলিশ সেই ডায়েরি নেয়নি। তবে তিনি একটি নোট রেখে এসেছিলেন। পুলিশ জিডি নেয় গত ৩ সেপ্টেম্বর। এখন পর্যন্ত তাঁর কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নাই। তাছাড়া সাতক্ষীরা মোখলেছসহ আগের বছরগুলোতে যারা নিখোঁজ হয়েছেন তাঁদেরও কোন খোঁজ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২১ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে ১১ জন মারা গেছেন। কেস স্টাডি নিম্নে দেওয়া হলো-
২১ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখ সকালে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় বাবলাতলা ঢোস এলাকা থেকে ৫ জেলে একটি ট্রলার নিয়ে মাছ শিকারের উদ্দেশ্যে সাগরে রওনা দেয়। এসময় পায়রা বন্দর নৌ-পুলিশের এএসআই মামুনসহ ৪ পুলিশ সদস্য অপর একটি ট্রলার নিয়ে তাদের ধাওয়া করে। ঘণ্টাব্যাপী ধাওয়ার পরে জেলেদের ট্রলার ফের বাবলাতলা ছোট ঢোসের খালে প্রবেশ করে এবং ৫ জেলের মধ্যে ৪জন পালিয়ে যায়। ট্রলারে থাকা একমাত্র জেলে মো. সুজন হাওলাদারকে (৩০) নৌ-পুলিশের সদস্যরা আটক করে। পরে তাকে স্থানীয়রা অসুস্থ অবস্থায় উদ্ধার করে কলাপাড়া হাসপাতালে নিয়ে আসলে ডাক্তার মৃত ঘোষণা করে। মো. সুজন হাওলাদারের পরিবারসহ স্থানীয়দের দাবি নৌ-পুলিশের সদস্যদের নির্যাতনে সুজনের মৃত্যু হয়েছে।
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ যশোরে চাঁদাবাজির অভিযোগে গণপিটুনির শিকার রবিউল ইসলাম (৪৫) নামে এক ব্যক্তির ‘পুলিশ হেফাজতে’মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার বিকালে সদর উপজেলার চুড়ামনকাটি বাজারে গণপিটুনির শিকার রবিউলকে বিকাল ৪টা ৩৮মিনিটে জরুরি বিভাগে আনা হয় এবং প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে পুলিশ তাঁকে নিয়ে যায়। এরপর সন্ধ্যা ৬টা ২০মিনিটে রবিউলকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনে পুলিশ।
৩১ ডিসেম্বর, ২০২০ রাতে বরিশাল নগরীর ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাগরদী হামিদ খান সড়কের নিজ বাড়ি সংলগ্ন একটি চায়ের দোকানে বসা ছিলেন রেজা। রাত সাড়ে আটটার দিকে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এসআই মো. মহিউদ্দিন সেখান থেকে তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। পরে এসআই মো. মহিউদ্দিন জানান, রেজাউল করিমের কাছ থেকে ১৩৮ গ্রাম গাঁজা এবং চার পিস নেশাজাতীয় ইনজেকশন জব্দ করা হয়েছে। রাতেই রেজাউল করিমকে আসামি করে কোতয়ালী মডেল থানায় মাদক আইনে মামলা করেন এসআই মো. মহিউদ্দিন। ওই মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে পরদিন শুক্রবার রেজাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। বাবা ইউনুস মুন্সি জানান, ‘রেজার শরীরে মারা যাওয়ার মতো কঠিন কোনো রোগ ছিল না। তবে শুক্রবার আদালতে সোপর্দের সময় রেজা গুরুতর অসুস্থ ছিল। সে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারছিল না। আদালতের নির্দেশে রেজাকে প্রথমে কারা হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, সেখানে অবস্থার অবনতি হলে তাকে শুক্রবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে শের-ই-বাংলা মেডিকেলে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২ জানুয়ারী, ২০২১ দিবাগত রাতে রেজাউলের মৃত্যু হয় ।’
কারা হেফাজতে মৃত্যু
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী ২০২১ সালে কারা হেফাজতে ৫৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ৫১ জনের মৃত্যু হয়েছে অসুস্থতাজনিত কারণে। একজন বন্দিকে পিটিয়ে হত্যা করেছে অপর এক বন্দি, একজন আত্মহত্যা ও একজন শিশুর রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। কারাগারের বাইরের হাসপাতালে প্রতি মাসে বন্দিদের মৃত্যু হয় এবং কারাগারে বন্দীদের অপর্যাপ্ত চিকিৎসা পরিলক্ষিত হয়। কেস স্টাডি নিম্নে দেওয়া হলো-
১০ জুলাই গাজীপুরের টঙ্গী শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে শিশু হাজতি সিহাব মিয়া (১৬) এর রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। শনিবার রাত ৯টার দিকে তার মৃত্যু হয়। শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, সন্ধ্যায় রুমের ভেতর অন্যান্য হাজতিদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে ধাক্কাধাক্কির এক পর্যায়ে হাজতিদের থাকার কক্ষের ভেতরে কোনো একটি বস্তুর সঙ্গে আঘাত লেগে সিহাব আহত হয়। পরে দ্রুত চিকিৎসার জন্য টঙ্গী শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে আসলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
কারাভ্যান্তরে বন্দি নির্যাতনের ঘটনাও ঘটেছে, ভারতের পশ্চিম ত্রিপুরা রাজ্যের দুর্গাপুরের শাহজাহান বিলাস, কয়েদি নম্বর ৭১৫১/এ, ডাকাতি ও হত্যা মামলায় ৫৮ বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামি। ২৬ বছর ধরে তিনি কুমিল্লা কারাগারে বন্দী। সম্প্রতি তিনি ১২ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, এক পুরিয়া গাঁজা, নগদ ৬০০ টাকাসহ কারারক্ষীদের হাতে ধরা পড়েন। এ প্রেক্ষিতে কারাভ্যন্তরে কেস টেবিলের সামনে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে প্রকাশ্যে বন্দি বিলাসের দুই হাত পিঠমোড়া করে বেঁধে মাটিতে ফেলে বেধড়ক পেটানো হয় যার ভিডিও ইউটিউব ফেসবুকসহ নানা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে। বন্দি নির্যাতনের বিষয়টি ভাইরাল হওয়ার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ এবং কারা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের নজরে আসে। তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পরবর্তীতে কুমিল্লা কারাগারের প্রধান কারারক্ষী মোহাম্মদ শরীফ ও কারারক্ষী অনন্ত চন্দ্র দাসকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। বরখাস্ত হওয়ার পর কারারক্ষী অনন্ত চন্দ্র দাস আত্মহত্যার চেষ্টা করেন।
বিক্ষোভ দমনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে মৃত্যু, নির্যাতন ও বল প্রয়োগ
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী ২০২১ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্তৃক গুলিতে মৃত্যু, নির্যাতন ও বিক্ষোভে দমনে বল প্রয়োগের অন্তত ২১টি ঘটনা ঘটেছে। কেস স্টাডি নিম্নে দেওয়া হলো-
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে হেফাজতে ইসলামের লাগাতার বিক্ষোভ সমাবেশ ও তাদের ডাকা ২৮ তারিখের হরতালকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্নস্থানে পুলিশের সাথে দফায় দফায় সংঘর্ষে হেফাজতের দাবি ও খবরের কাগজের রিপোর্ট মোতাবেক কমপক্ষে ১৪ জন কর্মী নিহত ও শতাধিক আহত হয়। যা শুধুমাত্র অপ্রত্যাশিতই ছিল না বরং অনাকাঙ্খিতও ছিল। চট্রগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, ফরিদপুর, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকাতে সংঘর্ষের ঘটনাগুলোতে বিক্ষোভকারীদের নিয়ন্ত্রণ করতে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলপ্রয়োগকে পদক্ষেপ হিসেবে বেঁছে নেয়াতে জনমনে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়।
১৭ এপ্রিল ২০২১ তারিখ শনিবার বাঁশখালী তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের শ্রমিকদের বেতন-ভাতা নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিরোধ চলছিল। সকাল থেকে শ্রমিকরা বিক্ষোভের চেষ্টা করলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। দুপুর পৌনে ১২টার দিকে শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া নিয়ে বিক্ষোভ চলাকালে পুলিশের সাথে সংঘর্ষের একপর্যায়ে পুলিশ গুলি চালায় । এতে ৭জন শ্রমিক গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত ও অন্তত ৩২ জন শ্রমিক গুরুতর আহত হন। প্রকৃতপক্ষে হতাহতের সংখ্যা অনেক বেশি বলে শ্রমিকরা ও স্থানীয়রা দাবি করেছেন। বাঁশখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক সওগাত ফেরদৌস জানান, ‘আহত অবস্থায় অনেককে হাসপাতালে আনা হয়েছিল। এর মধ্যে চারজন মারা গেছেন। নিহত চারজন হলেন আহমেদ রেজা (১৮), রনি (২২), শুভ (২৪) ও মো. রাহাত (২২) । আহত ব্যক্তিদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হাবিবুল্লাহ (১৯), রেজাউল (২৫) ও শিমুল(২২) নামের তিনজন মারা যান।
১৩ জুন, ২০২১ তারিখে সাভারের আশুলিয়া ইপিজেড এলাকায় বকেয়া বেতনের দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের দমনে পুলিশের আক্রমাত্মক ধাওয়ায় জেসমিন বেগম (৩০) নামের এক পোষাক শ্রকিক ঘটনাস্থল থেকে নিরাপদ এলাকায় সরে যেতে গেলে সড়ক বিভাজকের সঙ্গে ধাক্কা লেগে সড়কেই পড়ে যান । এরপর হাসপাতালে আনা হলে চিকিৎসক ওই নারীকে মৃত ঘোষণা করেন।
কাঁচপুর শিল্পনগরী এলাকায় অবস্থিত পোশাক রপ্তানীকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান ওপেক্স গ্রুপের সিনহা গার্মেন্টসে হাজার হাজার শ্রমিক তাদের বকেয়া বেতন-ভাতার দাবীতে কারখানা এলাকায় অবস্থান নেয়। দিনভর বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধের ব্যাপারে মালিক পক্ষের কোনো সাড়া না পাওয়ায় ২২ সেপ্টেম্বর, বুধবার বিকেলে শ্রমিকরা ঢাকা-সিলেট সড়কে অবস্থান নিয়ে টায়ার জ্বালিয়ে অবরোধ করে রাখে। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা মহাসড়কে খন্ড খন্ড ভাবে মিছিল বের করে। পুলিশ এসময় শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করতে গুলি ও টিয়ারসেল নিক্ষেপ করে। মুহূর্তের মধ্যে পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। পথচারীসহ কমপক্ষে ১৫ জন শ্রমিক আহত হয়। আহতদের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে বকেয়া বেতন-ভাতা আগামী মাসে পরিশোধ করা হবে বলে মালিক কর্তৃপক্ষ একটি নোটিশ ঝুলিয়ে দিলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে।
ই-অরেঞ্জের গ্রাহকরা টাকা ফেরত অথবা অর্ডার করা পণ্য ডেলিভারির দাবিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি দিতে যাচ্ছিলেন । গ্রাহকরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে প্রেসক্লাব থেকে মৎস্য ভবন গেলে পুলিশ তাদের লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করার সময় অন্তত ১০ জন আহত হন এবং ঘটনাস্থল থেকে দুই জনকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়।
৫ আগষ্ট গাজীপুরের টঙ্গী ভাদাম এলাকায় ক্রসলাইন লিমিটেড পোশাক কারখানার শ্রমিক ছাঁটাইয়ের প্রতিবাদে শ্রমিকরা সকাল থেকে কারখানার মূলফটকের সামনে বিক্ষোভ করে। এ সময় ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ২১ রাউন্ড রাবার বুলেট, ৫৮ রাউন্ড শটগান ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল নিক্ষেপে অন্তত অর্ধশতাধিক শ্রমিক আহত হন। উপরোক্ত ঘটনাগুলোতে পুলিশ মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগ না করে শান্তিপূর্ণভাবেও এর সমাধান করতে পারতো বলে এমএসএফ মনে করে।
নির্বাচনী সহিংসতা
এ বছরের প্রথম থেকেই উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন শুরু হয়। কমিশনসহ দায়িত্বশীলদের পক্ষ থেকে সহিংসতামুক্ত ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সবধরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে উৎকন্ঠা, সহিংসতা, হানাহানি ও হতাহতের মাত্রা নতুনভাবে যোগ হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে দলীয়ভাবে মনোনীত একক প্রার্থী দিয়েছে আওয়ামী লীগ। মনোনয়ন না পেয়ে অধিকাংশ স্থানেই আওয়ামী লীগের নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ক্ষমতাসীন দলের নিজেদের মধ্যকার সংঘাত-হিংস্রতা নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। নির্বাচনী সংঘাত, সহিংসতা ও নানাবিধ অনিয়মের কারণে স্বাধীনভাবে নিজেদের পছন্দের প্রতিনিধি নির্বাচন করার অধিকার থেকে জনগণ বঞ্চিত হচ্ছে। এ সকল নির্বাচনে অন্তত ১৫৬টিতে চেয়ারম্যন পদে বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। ফলে নির্বাচনগুলো প্রহসনে পরিণত হচ্ছে পাশাপাশি প্রশ্নবিদ্ধ এ সব নির্বাচন ক্রমাগত জনগণের আস্থা হারাচ্ছে যা দেশের গনতন্ত্রের প্রতি হুমকি বলে এমএসএফ মনে করে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী এ বছরের জানুয়ারি থেকে ছয় ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন এলাকায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনী সহিংসতার ১৬৭টি ঘটনায় কমপক্ষে ঘটনায় ৯১ জন নিহত, ১০০ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হয়েছেন তাছাড়াও ১৮১৫ এর বেশি মানুষ সংঘর্ষ-সহিংসতায় আহত হয়েছেন । নিহত ৯১ জনের মধ্যে ২১ জন প্রতিপক্ষের গুলিতে এবং ৬ জন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে মারা গেছেন । নিহতদের মধ্যে প্রায় সকলেই ভোটে অংশ নেওয়া প্রার্থীদের সমর্থক বা কর্মী। সবচেয়ে বেশি নিহত হয়েছেন নভেম্বর মাসের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে, যার সংখ্যা ৪৯। আর এ মাসেই নরসিংদী জেলায় নিহত হয়েছেন ১১ জন। অন্যদিকে ২৯ নভেম্বর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নিহতের ঘটনা ঘটে; যা ছিল ১১ জন। উল্লেখ যে, নির্বাচনী সহিংসতায় একজন নারী, একজন শিশু, দুইজন হিন্দু ধর্মাবলী, দুইজন নৃতাত্বিক জাতিগোষ্ঠী ও একজন বিজিবি সদস্যর মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। ব্যাপক সহিংসতায় নির্বাচনী সৌন্দর্য ম্লান হয়েছে।
সীমান্ত হতাহত ও নির্যাতন
সীমান্তে হত্যা ও নির্যাতন বন্ধ করতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) সীমান্ত সম্মেলনে বিএসএফ কর্তৃক কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দেয়া সত্বেও সীমান্ত হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা বন্ধ হয়নি। ২০২১ সালে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) কর্তৃক সীমান্তে হত্যার শিকার হয়েছেন১৯, নির্যাতনে আহত হয়েছেন ১০ জন, বাংলাদেশী অপহৃত হয়েছেন ৩ জন বাংলাদেশী নাগরিক, একজন মানসিক ভারসাম্যহীন অজ্ঞাতনামা এক নারীর মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। উচ্চ পর্যায় থেকে বারংবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্বেও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশী নাগরিক হত্যা বন্ধ করা হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে সীমান্তে অনাকাঙ্খিত ঘটনাসমূহের প্রতিবাদ ও প্রতিকারে ভূমিকা নিয়ে জনমনে ক্রমাগত প্রশ্নের সৃষ্টি হচ্ছে।
সংখ্যালঘু নির্যাতন
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী সারা বছর ধরেই সংখ্যালঘু নির্যাতন, উপাসনায় ও প্রতিমা ভাংচুরের ঘটনা অব্যহত ছিল। এ সময়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৮৫ জন, ১৩৮টি ঘরবাড়িতে আক্রমন ও অগ্নিসংযোগ কর হয়েছে, উপাসনায় ও প্রতিমা ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে ১২০টি, ১০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা ও ৪টি হিন্দু পরিবারের উপর হামলা হয়েছে। সারা বছরে নিহত হয়েছে ৯জন ও আহত হয়েছে ২৪৯ জন।
২০২১ সালে অক্টোবর মাসে সবচাইতে উদ্বেগজনক যে ঘটনা ঘটেছে তা হলো সনাতন ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়ের গুরুত্বপূর্ণ উৎসব দূর্গাপূজা পালনকালে তাদের উপর সুপরিকল্পিত নিরবচ্ছিন্ন সাম্প্রদায়িক সহিংসতা। হিন্দু সম্প্রদায়ের সার্বজনীন দূর্গোৎসব চলাকালে কুমিল্লার পরিস্থিতি এবং তার জের ধরে ধর্মীয় উগ্রবাদী ও সুবিধাভোগী গোষ্ঠী দেশের ১৯টি জেলার বিভিন্ন পুজামন্ডপ ও মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগসহ ব্যাপক সহিংসতা ঘটিয়েছে। অপরদিকে পুলিশ-হামলাকারীদের মধ্যেও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী অক্টোবর, ২০২১ মাসে পূজামন্ডপ ও মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগের ৫৩টি ঘটনা ঘটেছে, ৪১টি ঘরবাড়ি ও বহু ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা করা হয়েছে। ১৩ থেকে ২০ অক্টোবর ২০২১ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় ৯জন নিহত ও কমপক্ষে দুইশতাধিক আহত হয়েছেন। গুরুতর আহতরা এখনও চিকিৎসাধীন রয়েছে। নিহত ৯জনের মধ্যে ৬জন মুসলমান ও ৩জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী । হামলা চলাকালে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা পাওয়া যায় নাই বলে অভিযোগ রয়েছে।
১৫ মার্চ, ২০২১ তারিখ সোমবার মাওলানা মামুনুল হকসহ হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নেতারা সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলা শহরে একটি সমাবেশে বক্তব্য দেন। নোয়াগাঁও এর হিন্দু সম্প্রদায়ের ঝুমন দাস ফেসবুকে হেফাজত নেতাকে নিয়ে একটি পোস্ট দিলে এলাকায় উত্তেজনা দেখা দেয়। মঙ্গলবার রাতেই হিন্দু সম্প্রদায়ের এলাকাবাসীরা ঝুমন দাসকে আটক করে পুলিশে দেন। পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয় তাঁর বিরুদ্ধে থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হবে এবং সেটি প্রক্রিয়াধীন অথচ বুধবার সকালে আশপাশের চারটি গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ জড়ো হয়ে নোয়াগাঁও গ্রামের কাছাকাছি যান। সেখান থেকে শতাধিক ব্যক্তি লাঠিসোঁটা নিয়ে হিন্দুদের গ্রামে হামলা চালিয়ে তাঁদের অন্তত ৯০টি ঘরবাড়ি ভাঙচুর, ঘরের ভেতরে থাকা প্রতিমা ভাঙচুর ও লুটপাট করে ঘরের টাকাপয়সা নিয়ে যায়। ঘটনার পর প্রশাসন ও পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে হামলাকারীদের বুঝিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করলেও পুলিশ কাউকে আটক করেনি।
নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা
দেশে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী ২০২১ সালে দেশে নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা যেমন; ধর্ষণ, গণ-ধর্ষণ, ধর্ষণ ও হত্যা ও পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা বিগত সময়ের তুলনায় চলতি বছরে উদ্বেগজনকভাবে ঘটেছে। নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতারোধে দেশে যথেষ্ট কঠোর আইন থাকা সত্বেও অপরাধ দমনে ও নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভুমিকা দেখা যাচ্ছে না। বিচারহীনতা, বিচারে দীর্ঘসূত্রিতা ও অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা ক্রমাগতভাবে ঘটেই চলেছে।
এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী ২০২১ সালে ৬৯২টি নারী ও ৯৪৫টি শিশু ও কিশোরী যৌন নির্যাতনের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনার মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ৩৯৬টি, গণধর্ষনের শিকার হয়েছেন ১০৭ জন নারী, ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়েছেন ১১ জন নারী, ধর্ষনের পর আত্মহত্যা করেছেন ৩ জন নারী, ধষর্ণের চেষ্টা করা হয়েছে ৮২ জন ও যৌন হয়রানীর শিকার হয়েছেন ৮২ জন নারী। এছাড়াও প্রতিবন্ধী নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১১ জন। অ্যাসিড নিক্ষেপে আক্রান্ত হয়েছে ১৬ জন নারী।
অপরদিকে ২০২১ সালে নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনায় শারীরিক নির্যাতনে ৩৩০ জন, ৮২ জনের অস্বাভাবিক মৃত্যুসহ ৫৭৮ জন নারী হত্যার শিকার হয়েছেন। আত্মহত্যা করেছেন ৪২৩ জন নারী। অপহরণ করা হয়েছে ৫ জন নারীকে, নিখোঁজ রয়েছেন ২৩ জন নারী। নারী প্রতি সহিংসতার শিকারে রয়েছেন ১৪ জন প্রতিবন্ধী নারী।গণমাধ্যম সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী প্রতিশোধ, পারিবারিক বিরোধ, যৌতুক, প্রেমঘটিত জটিলতা ইত্যাদি কারণে এ হত্যাকান্ডগুলো সংঘটিত হয়েছে।
উল্লেখ্য যে ৯৪৫টি শিশু ও কিশোরী যৌন নির্যাতনের ঘটনায় ৪৭৯ জন শিশু ও কিশোরী ধর্ষণ, ১১২ জন গণধর্ষন শিকার হয়েছেন। ধর্ষণ ও হত্যার করা হয়েছে ২৫ জন শিশুকে, ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ৩ জন শিশু কিশোরী, ৭৮ জন প্রতিবন্ধী শিশু ও কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, যৌন হয়রানীর শিকার হয়েছেন ১১১ জন শিশু কিশোরী ও ধর্ষণের চেষ্টার শিকার হয়েছেন ১৩৭ জন শিশু কিশোরী।
অপরদিকে ২০২১ সালে শিশুদের প্রতি সহিংসতার ঘটনায় শারীরিক নির্যাতনে ১০৬ জন, ২৪ জনের অস্বাভাবিক মৃত্যুসহ ১৯৫ জন শিশু কিশোরী হত্যার শিকার হয়েছেন। আত্মহত্যা করেছেন ২৩৬ জন শিশু । অপহরণ করা হয়েছে ৩৮ জন শিশুকে, নিখোঁজ রয়েছেন ৫৫ জন শিশু। শিশুদের প্রতি সহিংসতার শিকারে রয়েছেন ১২ জন প্রতিবন্ধী শিশুও।
২০২১ সালে দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিত্যাক্ত অবস্থায় ৩৫ জন জীবিত ও ৫৮ জন মৃত, মোট ৯৩ জন নবজাতক শিশুকে পাওয়া গেছে যা অমানবিক ও নিন্দনীয়।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যবহার/অপব্যবহার
২০২১ সালে বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যাপক ব্যবহার উদ্বেগ ও হতাশার জন্ম দিয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বর্তমানে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হলেও মামলার নামে হয়রানি কমেনি বরং অপব্যবহার অব্যাহত রয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফের সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, এই বিতর্কিত আইনে বিভিন্ন পেশার মানুষসহ সাধারণ নাগরিকরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। সরকার সন্ত্রাস সৃষ্টি করে, ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাইছে। এ বছরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ১৭৯টি মামলায় আইনজীবী, সাংবাদিক, শিক্ষক, অন্যান্য পেশাজীবীসহ সাধারণ নাগরিক গ্রেফতার হয়েছেন ১১৮ জন। উল্লেখ যে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ১৭৯ মামলার মধ্যে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ বছর ৩৭টি মামলা করা হয়েছে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গের সমালোচনা ও কথিত কটুক্তি করায় ১১১টি মামলা হয়েছে। অন্যান্য ক্ষেত্রে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৩১টি মামলা হয়েছে।
সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের অধিকার
জনগণের তথ্য পাওয়ার অধিকার রক্ষায় সাংবাদিকেরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে যেভাবে বাধা দেয়া হচ্ছে এবং তাদের যেভাবে হয়রানি ও শারীরিকভাবে আক্রমণ করা হচ্ছে তা শুধুমাত্র অনাকাঙ্খিতই নয় বরং বস্তুনিষ্ঠ ও সৎ সাংবাদিকতার কন্ঠরোধ করার সামিল যা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য অশনিসংকেত। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ২০২১ সালটির চিত্র ছিল উদ্বেগজনক। ১জন নিহতসহ ১৩৬ জন সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছেন। ১ জন নিহত, অন্তত ৭৮ জন আহত, সাংবাদিক নানাভাবে অপমান, নিপীড়ন, হয়রানি, হমকি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৫৭ জন ।কেস স্টাডি নিম্নে দেওয়া হলো-
১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২১ তারিখ বিকেলে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চরফকিরা ইউনিয়নের চাপরাশিরহাট তরকারি বাজারের সামনে সেতুমন্ত্রীর ছোট ভাই কাদের মির্জা ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান বাদল গ্রুপের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। সে সময় সাংবাদিক বুরহান উদ্দিন মুজাক্কির সংঘর্ষের সংবাদ সংগ্রহের সময় গলায় গুলিবিদ্ধ হন। ২০ ফেব্রুয়ারী রাতে চিকিৎধীন অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে তাঁর মৃত্যু হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারী সাংবাদিক মুজাক্কিরের বাবা মাওলানা নুরুল হুদা ওরফে নোয়াব আলী মাস্টার বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে কোম্পানীগঞ্জ থানায় মামলা দায়ের করেন।
প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলাম পেশাগত কাজে সচিবালয়ে গেলে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবের একান্ত সচিবের কক্ষে তাঁকে আটকে রাখা হয়। এ সময় তাঁর মুঠোফোন কেড়ে নেওয়া হয়। যে কক্ষে রোজিনাকে আটকে রাখা হয়েছিল, সেখানে পুলিশ সদস্য উপস্থিত ছিলেন। কক্ষের বাইরেও কয়েকজন পুলিশ সদস্য পাহারারত ছিলেন। ঘটনার বিষয়ে সচিবালয়ে উপস্থিত সাংবাদিকেরা কয়েক দফা স্বাস্থ্যসেবা সচিব লোকমান হোসেন মিয়ার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেন কিন্তু তিনি কথা বলতে চাননি, সাংবাদিকদের তাঁর সাথে দেখা করতেও দেয়া হয় নি। রোজিনাকে আটকে রাখার কারণ সম্পর্কে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদেরকে পরিস্কার করে কিছু বলাও হয়নি। একপর্যায়ে রোজিনা অসুস্থ হয়ে পড়লে রাত সাড়ে আটটার দিকে শাহবাগ থানায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং রাত পৌনে ১২টার দিকে পুলিশ জানায়, রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে মামলা হয়েছে। সেই মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। পরবর্তীতে আদালত পুলিশের আনীত রিমান্ড আবেদন এবং রোজিনার আইনজীবীর জামিন আবেদন নাকচ করেন।
কারখানায় অগ্নিকান্ড
সামগ্রিকভাবে কারখানাগুলোতে নিরাপত্তা, অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার অবস্থার কারণে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের মতো দূ:ঘটনা ঘটেই চলেছে। কারখানা পরিচালনা করার অনুপযোগি ইমারতে কারখানা প্রতিষ্ঠা করা ও কল কারখানা চালু রাখার নুন্যতম নির্দেশনা না মানাও দু:ঘটনার অন্যতম কারণ। আর এর খেশারত দিচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে নিয়জিত শ্রমিকেরা। এমএসএফ এর তথ্য অনুযায়ী এ বছরে অন্ত:ত তিনটি কারখানায় অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ৬১ জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। কেস স্টাডি নিম্নে দেওয়া হলো-
২২ এপ্রিল আরমানিটোলায় আবাসিক ভবনের নিচতলায় রাসায়নিক গুদামে আগুন লেগে চারজনের মৃত্যু হয়। ৮ জুলাই নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুডস লিমিটেডের কারখানায় অগ্নিকান্ডে ৫২ জন শ্রমিক কর্মচারি নিহত ও অর্ধশতাধিক আহত হয়। কারখানাটিতে শ্রমিকেরা ঝুকিপূর্ণ পরিবেশ কাজ করতেন এবং সেখানে অগ্নিনির্বাপণের যথাযথ ব্যবস্থা ছিল না। ৪ নভেম্বর পুরান ঢাকার সোয়ারীঘাটের কামালবাগে রোমানা রাবার নামের জুতার কারখানায় আগুন লাগলে পাঁচজন শ্রমিকের মৃত্যু ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের বক্তব্য অনুযায়ী রোমানা রাবার কারখানাটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ছিল।
গণপিটুনি
২০২১ সালে অন্যতম একটি উদ্বেগজনক বিষয় ছিল গণপিটুনিতে হতাহতের ঘটনা। প্রচলিত আইন অবজ্ঞা করে গণপিটুনীর ঘটনাগুলোকে বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ড বলে এমএসএফ মনে করে। এমএসএফ এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ বছরে অন্তত ৪৪টি গনপিটুণির ঘটনা ঘটেছে, যেখানে ২৯ জন নিহত হয়েছে ও ১৪ জন আহত হয়েছেন। গণপিটুনিতে নিহত ২৯ জন ব্যাক্তির মধ্যে ১০ জনকে ডাকাত, ১০ জনকে চোর, ৬ জনকে গরুচোর, ১ জনকে ছিনতাইকারি ও ২ জনকে হত্যা করে পালিয়ে যাওয়ার সন্দেহে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়। আইন অবজ্ঞা করে গণপিটুনির ঘটনা ঘটিয়ে হত্যা করা অবশ্যই ফৌজদারী অপরাধ। গণপিটুনির সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে পুলিশ কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে বলে গণমাধ্যমে জানা যায়নি।
এমএসএফ’র সুপারিশ
০১. এমএসএফ মনে করে, এখন পর্যন্ত কোন সাম্প্রদায়িক হামলার বিচার শেষ না হওয়া, হামলা প্রতিরোধ, হিন্দুধর্মাবলম্বীসহ তাঁদের পূজামণ্ডপের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরপ্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা, জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব পালনে অবহেলা, দোষারোপের রাজনীতি এবং প্রকৃত অপরাধীদের সনাক্ত নাকরে ঢালাওভাবে গ্রেফতার দেখিয়ে সাম্প্রদায়িক হামলার বিচার প্রক্রিয়া জটিল করা অগ্রহণযোগ্য ও সংবিধানের মৌলিকঅধিকারের পরিপন্থি। রাস্ট্রকে এ বিষয়েসতর্ক থাকতে হবে এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুসহ সকল সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তানিশ্চিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
০২. বিক্ষোভকারীদের দমনে ও সহিংস কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রনে পূর্ব থেকেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা রাস্ট্রের দায়িত্ব। বিক্ষোভকারীদের দমনে ও সহিংস কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রনে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ না করে দায়িত্বশীল ও সংবেদনশীল ভূমিকা পালন করলে হতাহতের ঘটনা বহুগুনে এড়ানো যেতো বলে এমএসএফ মনে করে।
০৩. এমএসএফ মনে করে, দেশে শিশু ও নারীদের প্রতি সহিংসতা, নির্যাতন, শ্লীলতাহানি, যৌন হয়রানি, নিপীড়ন ও ধর্ষণের ঘটনাগুলি যে হারে ঘটেছে তাতে করে সামাজিক সুরক্ষার পাশাপাশি রাষ্ট্রের দায়দায়িত্ব বিশেষ করে সমাজে অপরাধ প্রবণতা নিয়ন্ত্রনে সরকারের ভূমিকা আরও জোরদার করতে হবে।
০৪. গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) মনে করে, এদেশে স্বাধীন সাংবাদিকতা ও তথ্য পাওয়ার অধিকারের ক্ষেত্রে নিরন্তর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে যা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিরোধী এবং অবিলম্বে তা বন্ধ করতে হবে।
০৫. ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি সহিংসতা ও নির্বাচনী সহিংসতায় হতাহতের ঘটনা ও মানবাধিকার লংঘন ক্রমাগত বৃদ্ধিপাওয়ায় মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) গভীর ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করছে এবং এর পুনরাবৃত্তিরোধে যথাযথ ব্যাবস্থা গ্রহণের জোরালো দাবি জানাচ্ছে।
০৬.কারাভ্যন্তরে বন্দী নির্যাতনের ঘটনা অবশ্যই অনাকাঙ্খিত তেমনি কারাভ্যন্তরে মাদক সামগ্রি পাওয়া অপ্রত্যাশিত।ঘটনার সুষ্ঠূ তদন্ত সাপেক্ষে প্রতিবেদন প্রকাশের দাবি করা হচ্ছে।
০৭. কারাগারসমূহের অভ্যন্তরে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নের পাশাপাশি কারা হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনাসমূহের যথাযথ তদন্তকরেও তার পূর্ণ প্রতিবেদন প্রকাশিত করা উচিত বলে এমএসএফ মনে করে।
০৮. দেশের নাগরিকদের সমঅধিকার ও সমমর্যাদা রক্ষায় একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনে সরকার উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণকরবে বলে আমাদের প্রত্যাশা সে অনুযায়ী সরকারের উচিত মানবাধিকারের একটি সর্বজনগ্রাহ্য মান বজায় রাখা।সকলের জন্য মর্যাদাপূর্ণ ও সমঅধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে দেশে মানবাধিকার সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য সরকার ওনাগরিক সমাজের সম্মিলিত প্রয়াস জরুরী বলে এমএসএফ মনে করে। সর্বোপরি মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নে সরকারের কার্যকর ভূমিকা রাখার প্রত্যাশা করছি।
তথ্যসূত্র: প্রথম আলো, ডেইলি ষ্টার, কালের কন্ঠ, যুগান্তর, জনকন্ঠ, আমাদের সময়, বাংলাদেশ প্রতিদিন, দৈনিক মানবজমিন, সমকাল, ইত্তেফাক, ঢাকা ট্রিবিউন ও অন্যান্য জাতীয় দৈনিকসমূহ প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে উপরোক্ত প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। তাছাড়াও প্রায় প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রেই স্থানীয় হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডারদের মাধ্যমে তা ভেরিফাই করা হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে ১ জানুয়ারী, ২০২১ থেকে ৩০ ডিসেম্বর, ২০২১ পর্যন্ত সংঘটিত ঘটনার ভিত্তিতে এ রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে।