ক’দিন আগে আহসান হাবীব নামে বাংলাদেশী এক জাতিসংঘ সিনিয়র কর্মকর্তার ফোন পেলাম। হাসিখুশি মানুষটির কন্ঠ ভারী হয়ে আছে। জানালেন, উনার সুফিউল আনাম ভাই ইয়েমেনে জাতিসংঘের নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় অপহৃত হয়েছেন। ফিল্ড ট্রিপে ইয়েমেনের কয়েকজন সহকর্মী নিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে যাচ্ছিলেন তিনি। সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আল-কায়েদা তাদের অপহরণ করে মুক্তিপণ চায়। সঙ্গে আল-কায়েদা বন্দী মুক্তির দাবীও জুড়ে দিয়েছে তারা। জাতিসংঘের তরফে সুফিউল আনাম ভাই ও তার ইয়েমেনি সহকর্মীদের উদ্ধারের চেষ্টা করছে। কিন্তু সাধারণত জাতিসংঘ সদর দপ্তরে অপহৃত ব্যক্তির মাতৃভূমির স্থায়ী মিশনের এই উদ্ধার কাজে সক্রিয় হবার কথা।
ইয়েমেনে অপহৃত জাতিসংঘের কর্মকর্তা ও বাংলাদেশি নাগরিক এ কে এম সুফিউল আনামের এখনো খোঁজ মেলেনি। তিনি জীবিত আছেন, এমন কোনো তথ্যপ্রমাণ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তবে তাঁর মুক্তিপণ হিসেবে ৪৩ কোটি টাকার বেশি চাওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন সুফিউলের দুই সহকর্মী।গত ১১ ফেব্রুয়ারি ইয়েমেনের আবিয়ান প্রদেশ থেকে সুফিউলসহ জাতিসংঘের পাঁচ কর্মী অপহৃত হন। তিনি ছাড়া অন্যরা ইয়েমেনেরই নাগরিক। সাবেক সেনা কর্মকর্তা সুফিউল ২০ বছর ধরে জাতিসংঘে কাজ করছেন। তিনি ইয়েমেনে জাতিসংঘের নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। ষাটোর্ধ্ব সুফিউলের কিছুদিনের মধ্যেই অবসরে যাওয়ার কথা।
আমাদের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি; জাতিসংঘের পাশাপাশি; অপহৃত ব্যক্তির মাতৃভূমির মিশন এরকম ক্ষেত্রে অপহৃত ব্যক্তিকে উদ্ধার প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ভূমিকা রাখে। দুর্ভাগ্য আমাদের; আমরা বাপে খ্যাদানো; মায়ে তাড়ানো দেশের এতিম। আমাদের রাষ্ট্র ক্ষমতার মালিকেরা কেবল নিজেদের সন্তান নিয়ে ভাবেন। অন্যের সন্তানের জীবন ঝুঁকিতে পড়লে; তারা অনুশীলিত নির্লিপ্ততায় দেখেও না দেখার ভান করেন। “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে” অন্যের সন্তানের জীবন ক্ষয়ে গেলে অবহেলায় আর শোণিতে; তাতে কী এসে যায়; দেশের অভিভাবকের। তিনি তো দিবস পালন করেন; ইতিহাস চর্চা করেন; ইতিহাসে তাঁর পরিবারের সুকৃতির প্রত্ন চিহ্ন খুঁজেন। আর মাঝে মাঝে বলেন, লিখে রেখো এক ফোটা দিলেম শিশির।
কে আর সুফিউল আনাম; বাংলাদেশের রাজবংশের রাজকুমার নন তিনি। তাঁর স্ত্রী রাজ বংশের রাজকুমারী নন। তাঁর সন্তানেরা রাজ পরিবারের দোলনায় দোল খাওয়া নাতি-নাতনি নয়। সুতরাং “আব্বু তুমি কী কান্না করতেছো”-র হতভাগ্য উপায়হীন এ পরিবারের কান্নাগুলো রাজদুর্গের দেয়ালে বাড়ি খেয়ে ফিরে আসে। কোথাও কেউ নেই; যে একটু শুনবে বেদনার কথা। সুফিউল আনামদের পাঠানো রেমিটেন্সে “ফুলের বুকে ঘুমিয়ে পড়ে ফুলের মধু খেয়ে” বাংলাদেশী দূতাবাসগুলো পরমানন্দে দিবস পালন করে; আবার টেনিসনের কবিতার লোটাস ইটারদের মতো ঘুমিয়ে যায়।
প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয়; সবাই ব্যস্ত; শত বর্ষের উন্নয়ন উদযাপনের মহাযজ্ঞে। কে এই সুফিউল আনাম; তার সম্পর্কে আপডেট জানানোর দায়িত্ব সাংবাদিকদের নেই; তারা ইতিহাসের টাইম মেশিনে চড়ে “জয় বাংলা” বলে আগে বাড়ছে; বুলেটিনে বুলেটিনে; টকশোতে; রকশোতে।কবি জন এলিয়া বলেছিলেন, এমনকী হতে পারে; অন্য কোন গ্রহের দোজখ আমার মাতৃভূমি!
মাসকাওয়াথ আহসান: সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া ওয়েব টিভি