বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনকে নিয়ে যে অপ্রয়োজনীয় এবং অর্থহীন বিতর্কের সূচনা করা হয়েছে তা হচ্ছে ইভিএম মেশিন ব্যবহার করা না করা। এই বিষয়ে কোনও মন্তব্য করার আগ্রহ বা উৎসাহ আমার মোটেই ছিলোনা। কেননা এই বিতর্কের মধ্যে যে এক ধরণের অসদুদ্দেশ্য আছে তা ২০১৮ সালেই প্রকাশিত হয়েছিলো এবং আমি তা তখনই সুস্পষ্টভাবে বলেছি (দেখুন, ডেইলি স্টারে প্রকাশিত আমার নিবন্ধ, ‘ইভিএম: এ পয়েন্টলেস ডিবেট’, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৮)। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর দলের সভায় এই নিয়ে মন্তব্য করার পরে ডেইলি স্টারের প্রতিবেদক আমার মন্তব্য চাইলে এই বিতর্ক কেনো অপ্রয়োজনীয় তা পুনরায় ব্যক্ত করি (দেখুন, দ্য ডেইলি স্টার, ১৮ মে ২০২২)। কিন্ত এখন এই মেশিন নিয়ে বাংলাদেশের ‘বিজ্ঞানীরা’ যে ধরণের কথাবার্তা বলছেন তা দেখে মনে হচ্ছে নির্বাচন কমিশনের হাত ধরে ক্ষমতাসীনরা গত দুই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গোটা নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেবার পরে এখন নির্বাচনকে একটা হাস্যকর বিষয়ে পরিণত করার দায়িত্ব তাঁদের ওপরে বর্তিয়েছে।
বাংলাদেশে কয়েক শো কোটি টাকা খরচ করে (এবং সম্ভবত এর মধ্যে কিছু লুটপাট করে) যেসব মেশিন কেনা হয়েছে এবং কেনা হবে বলে আয়োজন চলছে সেগুলোর সবচেয়ে বড় প্রযুক্তিগত দিক হচ্ছে এগুলোতে কোনও পেপার ট্রেইলের ব্যবস্থা নেই। সারা দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ এগুলো বাতিল করে দিয়েছে যে এই ধরণের মেশিন অস্বচ্ছ এবং এগুলোর মাধ্যমে সহজেই কারচুপি করা যায়। এগুলোর বিষয়ে জ্ঞান লাভের জন্যে সংবাদপত্র পাঠই যথেষ্ট। কিন্ত দুর্ভাগ্য হচ্ছে এই প্রযুক্তির বিক্রেতারা পত্রিকা পাঠে অনুৎসাহী, কেনো তা তাঁরাই বলতে পারবেন।
এই প্রযুক্তি আসলে ‘লো-টেকনোলজি’ না ‘নির্ভুল প্রযুক্তি’ এই বিষয়ে মনস্থির করতে অক্ষম বা অনীহরা এখন সার্টিফিকেট দিচ্ছেন। এইসব সার্টিফিকেট দেয়া বিজ্ঞানীদের একজন খোলামেলাভাবে স্বীকার করেছেন যে তাঁরা আসলে এই মেশিন পরীক্ষা করেই দেখেননি (দেখুন, ‘ইভিএম আমরা নিজেরা কিন্তু পরীক্ষা করে দেখিনি: ড. কায়কোবাদ’, দ্য ডেইলি স্টার, ২৯ মে ২০২২)। এখানে আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এই যে, তিনি যে প্রযুক্তির পক্ষে সাফাই গাইছেন সে বিষয়ে তিনি নিজেই একটা বিশাল ‘যদি’ ব্যবহার করেছেন – “আমরা আমাদের প্রযুক্তিগত জ্ঞান দিয়ে বুঝেছি, সত্যি যদি এমন হয়ে থাকে, তাহলে এটা খুব ভালো একটি মেশিন।” আমি এই বাক্য কয়েকবার পড়েছি, আপনারাও পড়তে পারেন – ‘সত্যি যদি এমন হয়’। কিন্ত ইভিএম নিয়ে কথাবার্তার সমস্যাটা কেবল এখানে নয়। সমস্যাটি হচ্ছে যারা এই নিয়ে কথা বলছেন তাঁরা এমন ভাব নিচ্ছেন যেন এই মেশিন কেনো ব্যবহার হবে সেটা তাঁরা জানেন না। এই মেশিন মুদি দোকানের ক্যাশ কাউন্টারের টাকার হিসেবের জন্যে ব্যবহৃত হবেনা, ফলে এর সঙ্গে ব্যাংকের এটিএম মেশিনের তুলনা বেশ কৌতুহলোদ্দীপক একাধিক কারণে। এটিএম মেশিন যে একটা কাগজের প্রিন্ট দেয় সেটা নিশ্চয় আমরা সবাই জানি। তা ছাড়া আপনার একার টাকার হিসেবের গোলমাল আর দেশের ভবিষ্যত নির্ধারন যে একই জিনিষ নয় তা কে কাকে বোঝাবে। সরকারের সমর্থকরা এখন সবাইকে এটিএম মেশিন দেখানো শুরু করলে অবাক হবার কিছু থাকবেনা
ইভিএম-এর কথিত সার্টিফিকেট যারা দিচ্ছেন তাঁরা গত এক দশকের বাংলাদেশের খবর নিশ্চয় জানেন। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে কী হয়েছে সেটা না জানার উপায় আছে বলে মনে হয়না। কিন্ত এই প্রযুক্তির কথা বলতে গিয়ে তাঁরা এমন এক ধরণের উত্তর দিচ্ছেন যেন এগুলো কোনও বিষয় নয়। যদিও এইসব পরীক্ষাকারীদের একজন বলেছেন – ‘নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সাফাই গাওয়ার জন্য আমি নির্বাচন কমিশনে যাইনি। …… নির্বাচন কমিশনের জন-আস্থা বা গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর দায়িত্ব নিয়ে নির্বাচন কমিশনে যাইনি।’ কিন্ত তাঁদের কথা যে শেষ বিচারে একটি বিতর্কিত নির্বাচনের পটভূমি এবং আগাম বৈধতা দিচ্ছে তা না বোঝার কারণ দেখিনা, অবশ্য যদি বুঝতে চান। ইতিমধ্যে ইভিএম যেখানে ব্যবহৃত হয়েছে সেখানে কী হয়েছে তাঁর নমুনা জানার জন্যে সাংবাদিকদের ওপরে ভরসা না করে এখনকার নির্বাচন কমিশনের সদস্যের কথাই শোন যাক। ইসি কমিশনার বলেছেন “গোপন কক্ষে একজন করে ‘ডাকাত’ দাঁড়িয়ে থাকে, এটাই ইভিএমের চ্যালেঞ্জ” (প্রথম আলো, ৩০ মে ২০২২)। এই ডাকাত কারা তা আর কোনও ধরণের গোপন ব্যাপার নয়। চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার চাম্বল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নৌকা প্রতীকের প্রার্থী বর্তমান চেয়ারম্যান মুজিবুল হক চৌধুরী সোজা সাপটা বলে দিয়েছেন, ‘‘বাটন টিপে দিতে কেন্দ্রে আমার লোক থাকবে” (প্রথম আলো, ৩০ মে ২০২২)। আসল কথাও বলেছেন, ইভিএম না থাকলে রাতেই সব ভোট নিয়ে ফেলতেন।
কাগজে ব্যালট ছাপলে রাতে ভোট দেবার ব্যবস্থা আর ইভিএম থাকলে নিজের লোক দিয়ে বাটন টেপার ব্যবস্থার কারণ কি সেটা নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিবের ভাষা ধার করে বলি, ‘ডাকাত’ থাকা। এই ডাকাতদের কেনো নির্বাচন কমিশন ঠেকাতে পারেন না সেটা আমরা সবাই জানি। তাহলে আসল কথা হচ্ছে নির্বাচন করার আগে ডাকাত না থাকার ব্যবস্থা করা। ‘ডাকাত’ থাকলে প্রযুক্তি বা কাগজে ফারাক হয় না। বাংলাদেশে কাগজের ব্যালটে অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা গেছে।