ধারণা করছি, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নাহিদের সাম্প্রতিক বক্তব্য নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হবে না। যদিও এই বক্তব্যটির বিপদজনক ব্যাখ্যার বিপুল সুযোগ রয়েছে বলেই গণমাধ্যমে এটি নিয়ে অনেক আলোচনা হবার কথা ছিলো। কিন্তু যেটা বাংলাদেশের গণমাধ্যমের এখনকার বৈশিষ্ট্য, পতিত লোকগুলোর নিন্দা বৈধ, কিন্তু ক্ষমতাসীনদের নিয়ে আলাপ পরিত্যাজ্য।
নাহিদ বলেছেন, ” কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের মধ্যে যাঁরা ফ্যাসিবাদের সঙ্গে জড়িত ছিলেন কিংবা গণহত্যায় উসকানি দিয়েছেন, তাঁদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনা হবে।”
কোন আইনে? কোন ধারায়? নাকি নতুন আইন তৈরি করে? এগুলোর কোন ব্যাখ্যা আমরা পাইনি।
নাহিদের সাথে আমরা একমত, “কেবল সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও কবি পরিচয়ে কেউ রেহাই পাবেন না।” এই দৃষ্টিভঙ্গি সঠিক, কোন অপরাধ করে কারোই এমন রেহাই পাবার আশা করা ঠিক না, কারণ তিনি সম্মানিত, বা তার একদল ভক্ত সমর্থক আছেন।
কিন্তু, “যাঁরা বিভিন্ন লেখনী ও মতামতের মাধ্যমে জনমত তৈরি করে গণহত্যার পক্ষে পরোক্ষভাবে কাজ করেছেন এবং গণহত্যার জন্য উসকানি দিয়েছেন, তাঁদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনা হবে।” এই মন্তব্যটির মাঝে অনেক বিপদজনক সম্ভাবনা রয়েছে। শিথিল এই বক্তব্যটি বলতে গেলে বহু রকম ব্যাখ্যা, উস্কানি এবং নিপীড়ন ও হয়রানির পথ খুলে দেবে।
পতিত স্বৈরাচারের বিচার নিয়ে আমরা খুব পরিস্কার একটা কথা শুরু থেকেই বলে আসছি, যাদের যাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং নিপীড়নের অভিযোগ আছে, তাদের বিচার করতেই হবে। এটা বাংলাদেশকে মুক্ত করার জন্য বিকল্পহীন একটা কাজ। ভবিষ্যতেও কেউ যেন স্বৈরাচার হয়ে উঠতে না চান, তাদের জন্য এই দৃষ্টান্ত একটা হুঁশিয়ারি হিসেবে থাকবে।
এই কারণেই আমার মনে হয়, সরকারের, এবং সহযোগী দলগুলোর যে সংসদ সদস্য নামধারীরা জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়াতে প্রত্যক্ষ ভুমিকা রেখেছেন, তাদেরও আইনের আওতায় আনা দরকার। এটা রাজনৈতিক অপরাধের একটা রূপ, কিন্তু যার বিচার ফৌজদারী আদালতে হওয়া সম্ভব।
কিন্তু যারা এমন অপরাধ করেননি, কিন্তু ফ্যাসিবাদের সমর্থক ছিলেন? সত্যি যে, আওয়ামী আমলের একটা বড় দিক ছিলো যে, তার দুর্নীতির সাথে লেখক, শিল্পী সাহিত্যিকদের যুক্ত করেছিলো এবং তাদের সম্মতি আদায় করেছিলো স্বৈরতন্ত্র ও স্বৈরশাসকের সাথে।
এদের অনেকের বিরুদ্ধেই রীতিমত ফৌজদারি কার্যক্রম চালানো সম্ভব, এবং সেটা না করার কোন কারণ নেই। সাংবাদিকতা, লেখকবৃত্তি, নিয়োগ ইত্যাদি সূত্রে তারা অবৈধ অর্থের মালিক হয়েছেন বলে যদি প্রমাণ করা যায়, তাহলে বিচার না করাটা বরং অন্যায় হবে।
কিন্তু ফ্যাসিবাদের রাজনীতিবিদদের সাথে সম্ভবত ফ্যাসিবাদের চিন্তাবিদদের পার্থক্য করার দরকার আছে, আইনের বিবেচনায়।
কেউ যদি চিন্তা করেন যে, বাঙালি জাতিয়তাবাদের তার নিজস্ব সংস্করণটি একটা মানবশ্রেষ্ঠ তত্ত্ব, বাকিদের উচিত সেটাকে মেনে নেয়া, রাষ্ট্রের উচিত সেটাকে কায়েম করা, সেটা একটা ফ্যাসিবাদী চিন্তা। এই রকম ফ্যাসিবাদী চিন্তা হবে কেউ যদি ধর্মীয় কোন নির্দিষ্ট ব্যাখ্যাকে আরোপ করতে যায়, বা মতাদর্শকে।
শুধু এই চিন্তা করাটা, সেই চিন্তা প্রকাশ করাটা কি অপরাধ? এমনকি, রাষ্ট্রকে সেটা ঘটাতে উদ্বুদ্ধ করাটা? নাটক চলচ্চিত্র সংগীত বা অন্য মাধ্যমে সেটার অভিব্যক্তি প্রকাশ করাটা?
এটা বলা যাবে না যে, “খারাপ” কাজের সমর্থক হবার দায়ে শিল্পী সাংস্কৃতিক কর্মী সাংবাদিকদের শাস্তি দেয়ার দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে একদম নেই। তেমন দৃষ্টান্ত আছে।
কিন্তু ইতিহাসের উদাহরণগুলো থেকে যতদূর বুঝি, সেটা সাধারণত হয় সরকারগুলোর প্রতিশোধস্পৃহা কিংবা ভীরুতা থেকে। আপাতদৃশ্যে শক্তিশালী হলেও এই রকম নিধনযজ্ঞের ধোঁয়ায় ভবিষ্যতের সব অপশাসন, পাল্টা রক্তপাত আর দুঃশাসনের সূচনা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের মহান একটি বিপ্লবের পরিণামের সাথে সম্পর্ক আছে লেখকদের ভিন্নতা সহ্য করবার ক্ষমতার। ওদিকে ভীরুতার উদাহরণ ছিলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংস্কৃতি জগতে সিনেটর ম্যাককার্থির কাণ্ডকীর্তি।
ভবিষ্যত নিয়ে দৃঢ় আত্মবিশ্বাস আছে, এমন সরকারগুলো সাধারণত একে সহ্য করে ভিন্নমত হিসেবে।
সহজ একটা প্রশ্ন আসতে পারে, অমুক কিংবা তমুকের মত লোক মাফ পেয়ে যাবে?
না, তার যদি ফৌজদারী আইনের সংজ্ঞার আওতায় পরবার মত কোন কাজ থাকে, তার মাফ পাবার কোন কারণ নেই।
যারা এর বাইরে থাকবেন? কোন প্রমাণিত অপরাধ যাদের নেই, কিন্তু যারা নিজেদের প্রতিভা ও দক্ষতাকে ব্যবহার করেছেন এই কাজে?
আমার পরামর্শ যদি চান, দয়া করে তাদেরকে চিন্তা ও সৃজনশীলতার শক্তি দিয়েই মোকাবেলা করুন। মানুষ তাদের নিয়ে আজ উপহাস করছে, সেটাই তাদের জন্য যথেষ্ট শাস্তি। তাদের সৌধ ভেঙে পড়েছে, সেটার যন্ত্রণা নিয়েই তারা অনুতাপ করতে থাকুক।
রাষ্ট্রগঠনে আপনারা যোগ্য ভূমিকা রাখলে এরা বিস্মৃতির অতলে চলে যাবে।
কিন্তু যদি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুর্নিতিবাজদের ছেড়ে, কিংবা ভেজালে ভরা হাজারো মামলা দিয়ে একইসাথে এইসব লেখক সাংবাদিক বুদ্ধিজীবী শিকারেও নামেন, তাতে দুটো ফায়দাই কেবল হবে।
একটা হবে, বিপুল শক্তির অপচয়। নিপীড়ন করার শক্তির কেন্দ্রীভবন ও প্রয়োগ। আপনাদের রাষ্ট্রগঠন কোন লক্ষ্যে আর পৌঁছাবে না। বরং অচিরেই জনতার মুখোমুখি হতে হবে।
দ্বিতীয় বিষয়টা হবে, ফ্যাসিবাদের সমর্থক এই বুদ্ধিজীবিতা আক্রমণের মুখে বহুগুন শক্তি সঞ্চয় করবে। আপনাদের ভুল কাজ তাদের বৈধতা দেবে। মানুষের মনে তারা আর বিস্মৃত হবে না।
খুব স্পষ্ট করে বলি, ফ্যাসিবাদের সমর্থক বুদ্ধিজীবী বর্গে থাকা শাহরিয়ার কবীরকে নিয়েও একই কথাই আমরা বলবো।
বাংলাদেশকে মুক্তিযোদ্ধা বনাম রাজাকার; প্রগতিশীল বনাম মৌলবাদী ইত্যাদি বর্গে বিভক্ত করতে ভূমিকা রাখা অন্যতম বুদ্ধিজীবী তিনি। মুক্তিযুদ্ধ কিংবা প্রগতিশীলতার মত শব্দও বিতর্কিত হয়েছে তার কল্যাণে। মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়াকেও সমর্থন করেছেন তাদের অনেকেই।
কিন্তু চিন্তা হিসেবে এগুলো যতই ঘৃণ্য হোক, আমার মনে হয় না এগুলোর কারণে একটা লোককে গ্রেফতার করা যায়।
আমি এখনো জানি না কী কী মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে, বা আরও অনেকের গ্রেফতারের আশঙ্কা করছি নাহিদের কথা থেকে।
শাহরিয়ার কবীর কিংবা ইত্যকার বুদ্ধিজীবীরা যে পরিহাসের বস্তু হিসেবেই বহু কাল ধরে যথাযথ স্থানে ছিলেন জনগণের বড় একটা অংশের কাছে, ৫ অগাস্টের পর গৌণ এবং অপ্রয়োজনীয় একটা মানুষ, তাকে পুনর্বাসনই করবে রাষ্ট্রের দিক থেকে যে কোন প্রতিহিংসা মূলক কর্মকাণ্ড।
বরং এই বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে সত্যিকারের দুর্নীতি, হুকুম প্রদান বা এমনি প্রত্যক্ষ যোগাযোগ থাকলে সেগুলোকে আমলে আনা এবং বিচারে প্রাধান্য দেয়ই অন্তবর্তীকালীন সরকারের কতর্ব্য বলে মনে করি।
সারসংক্ষেপে বলি, চিন্তাপরাধকে আর সব অপরাধের মত করে ভাবা গুরুতর ভুল, এটা মনে রাখতে হবে। আর, লেখক বা শিল্পী বলেই ফৌজদারী অপরাধের দায় থেকে কেউ যেন রেহাই না পায়, এটাতে একমত।
- ফিরোজ আহমেদ, রাজনৈতিক সংগঠক ও বিশ্লেষক( বানান রীতি ও মতামত লেখকের নিজস্ব। – সম্পাদক, সোজা কথা ডটকম)