– শামা আরজু
এইতো মাসখানেক আগেই তো মাত্র! চোখে ঘুম নিয়ে ঢলতে ঢলতে উঠে, দৌড়াতে দৌড়াতে গাড়ি ধরে হাঁপাতে হাঁপাতে স্কুলের সিঁড়ি বেয়ে উঠতাম স্কুলে।সারাবেলা কতো কাজ ! রাত দশটা এগারোটা নাগাদ অবসর কিন্তু আবার ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। মনে হতো চাকুরিটা ছেড়ে দিলেই বুঝি কতো ভালো ভালো লেখাই না আমি প্রসব করতে পারতাম! না কোনো পুরস্কারের আশায় নয়, সেলিব্রেটি হবার আশায় ও নয় লিখতে পারলে আমার নিজেরই ভালো লাগে। হালকা লাগে। বিচার হীনতার সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা আমার ডিপ্রেশনটা আমি এভাবেই যেন একটু কমাতে পারি। কেউ কেউ দায়বদ্ধতার জন্য লিখলেও আমি কেবল আমার জন্যই লিখি। লিখেই আমার বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করে, বেঁচে থাকার জন্যও আমার লিখতে ইচ্ছে করে। কোনো দায়বদ্ধতা নামের শব্দ ব্যবহার আমি আমার ইচ্ছাটাকে তুচ্ছ করতে পারবো না। কিন্তু এই এক মাস ধরে কি লিখলাম! ঘরে বসে থেকে, মানুষের কাছাকাছি না গিয়ে, না দেখে লেখা চালিয়ে যাওয়া অন্তত আমার পক্ষে সম্ভব না। কারণ আমি কল্পনায় কিছু লিখতে পারিনা। নোট করে রাখতে পারি হয়তোবা প্লট কিন্তু তার সাথে রং তুলি দিয়ে ছবি তৈরি করতে পারি না। আমি নিরেট গদ্য দিয়েই যেটুকু লিখখি সেটুকু যখন আবার নিজে পড়ি তখন আমি দিব্যি সেই ছবি দেখতে পাই! আমার কাছের মানুষ যারা, তারাও বলে – আমি বেশ ভালোই লিখি। এটুকু হলেই আমার বেশ চলে। এর বেশি কিছু চাইনা। আমি আসলে বেশি করে কখনোই কিছু চাইতে শিখিনি। তবুও জীবন বড়ো কঠিন হয়ে গেলো অন্য মানুষ আর মানুষদের অনাচারে। সন্তান গুলি হওয়ার পর কেবল মনে হয়েছে আমার নিজের ইচ্ছায় নয়, ওদের প্রয়োজনেই আমার বেঁচে থাকতে হবে। এখন আর সেরকম মনে হয় না। এখন মনে হয় মৃত্যু একদিন আছেই যে কোনো সময় মরলেই হোলো। কিন্তু আজ কেন জানি মনে হচ্ছে, না! আমিও মরতে চাই না আসলে আমিও বেঁচে থাকতে চাই যত বেশি সম্ভব ততোদিন।
একটু আগে ছোট ভাই এসে আমার ওষুধ দিয়ে গেলো। লক ডাউনের এই কয়দিনে ও আমাকে আরও কয়েকবার ওষুধ দিয়ে গেছে। আজ ওকে দেখে আমার খুব খারাপ লাগছিলো। খুব বিষন্ন দেখাচ্ছিলো। ওকে অসুস্থ দেখাচ্ছিলো। বলেছিলো জ্বর জ্বর লাগছে। একটু গায়ে হাত দিয়েপ দেখিনি। ভাইটি আমার খুব অল্প সময় ছিল এবং এই অল্প সময়ে অনেক বেশি কথা বলেছে। আমিও বলেছি । কিন্তু ও চলে যাবার পর খুব খারাপ লাগছিল। আহা, যদি একটু দেখতাম ভাইটাকে। আসলেই জ্বর আছে কি না। কারণ ও বলছিলো, আপা শরীরটা ভালো লাগছে না। কিছু হয়ে গেলে মাফ করে দিও। ও আমার অনেক ছোট, এখনই ওর মরে যাবার কথা নয়। ওর ছোট দুটো বাচ্চা আছে। বউটা কোন কিছু করে না।সুমন চাকরি বাঁচানোর জন্য ছুটে বেড়াচ্ছে। আর মাঝে মাঝে ফেসবুকে স্যাডিস্ট পোস্ট দিচ্ছে। কোথায় আমার নিজের জন্য ভয় করবে, বয়স হয়েছে কিন্তু তা না করে আমার সুমনের জন্য খুব ভয় করছে। হ্যাঁ, আমার ভাইটির নাম সুমন। গার্মেন্টস কর্মীদের সবার জীবনে সঙ্গে জড়িত আছে আরো কিছু মানুষ। ওদেরকে এমন মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হলো কেবলমাত্র মালিক আর প্রতিষ্ঠানকে বাঁচানোর জন্য। এই দেশটা এমন হয়েছে মালিকরা জানে তারা ইচ্ছে করলেই খুব নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলতে পারবে এবং পারছে ও। বিচ্ছিন্ন ঘটনা সবক্ষেত্রেই বিচ্ছিন্ন। আমি সাধারণের কথা বলছি। মালিকরা সাধারণ মানুষ নয়। শ্রমিক সাধারণ মানুষ। শ্রমিকদের পক্ষে কথা বলার জন্য কেউ নাই। শ্রমিকনেতা! তার সাথে মালিকের দূরত্ব পুঁজিবাজারে খুবই কম। এখানে এখন এটাই সত্যি মালিক মরলে মালিক পাওয়া যাবে না কিন্তু শ্রমিক মরলে শ্রমিক পাওয়া যাবে ঠিকই। গ্রামে চাকরি করি, সেই সুবাদে দেখছিই তো! ওখানে জন্মনিয়ন্ত্রণের কাজ একদমই নেই। কেন জানি মনে হচ্ছে এটাও হয়তোবা মালিক শ্রেণীর আইডিয়া। মানুষ জন্মাক অনেক যতই জন্মাবে ততই মালিকের লাভ। এতো কম টাকায় এত সস্তা শ্রমিক পৃথিবীর আর কোথাও আছে কিনা বস্ত্র শিল্পের মতো, আমার জানা নেই। তবে যতটুকু জানি আমার যোগাযোগের ক্ষেত্র খুব কম নয়। আসলে এত সস্তা শ্রম দিয়ে এত টাকার মালিক হওয়া পৃথিবীর আর কোথাও সম্ভব নয়।
আচ্ছা, যারা গার্মেন্টসে চাকরি করে সুমন নামে কোনো ছোট ভাই কী আছে তাদের!
এইমাত্র গাজীপুর থেকে একজন ফোন করলো,গার্মেন্টসে কোনোরকম নিয়মই মানা হচ্ছে না, এই করোনার মহামারির সময়।
হঠাৎ আমার লেখা থমকে গেল। এত ভাবছি কেন সুমনের কথা, গার্মেন্টসের মেয়েদের কথা? কে যে কখন মিসিং হয়ে যাই, নাই হয়ে যাই সেটাইতো তো বলা যাচ্ছেনা। এই মহামারীর দিনে প্রত্যেকটা মানুষ যেন যেন একেকটা করোনা বিশেষজ্ঞ হয়ে গেছে। কত রকম তথ্য পাই! বিভ্রান্ত আমি। কোনটা সঠিক বুঝে উঠতে পারিনা। খুব কঠিন লাগছে আবার জীবন।
শামা আরজু : লেখক, শিক্ষক