হাবিব খান: বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের স্মৃতি বিজড়িত ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে ইউরোপিয়ান ক্লাব, পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্কুল মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা আবক্ষ মূর্তিটি নজর কাড়ে সবার। দূর থেকে দেখলেই বোঝা যায় এটি প্রীতিলতার আবক্ষ মূর্তি। যাকে সবাই বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দানকারী ‘বীরকন্যা’ নামে চেনে। রেলওয়ে স্কুল পার হলে দেখা যাবে বাঙালির শত বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সেই পাহাড়তলীর ইউরোপিয়ান ক্লাব।
ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়ে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের নেতা বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেনের অন্যতম সহযোদ্ধা বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার চট্টগ্রাম জেলার পটিয়ার দক্ষিন সমুরা গ্রাম, ধলঘাটে ১৯১১ সালের ৫ মে জন্ম গ্রহণ করেন। ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর আত্মহুতি দিয়ে বিপ্লবের মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ছিলেন চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক ডাঃ খাস্তগীর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী, সেখান থেকে ম্যাট্রিকুলেশন করেন ১৯২৮ সালে।
ইউরোপিয়ান ক্লাব নামে পরিচিত এই ভবনটিতে ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর সফল আক্রমণে নেতৃত্ব দেন, মূলত ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের আমোদফূর্তির উদ্দেশ্যে ক্লাবটির ব্যবহার হতো। তখন ক্লাবটিতে নিয়মিত জড়ো হতেন অথবা আড্ডা জমাতেন প্রায় ইংরেজরাই। পাহাড়তলীর এ ক্লাবে কোনো তৎকালিন ভারতীয়দের (বেংগল বর্তমান বাংলাদেশ) প্রবেশ করার অধিকার ছিল না। ক্লাবের বাইরে সাইনবোর্ডে লিখে রাখা ছিল, ‘ডগস অ্যান্ড ইন্ডিয়ানস আর নট অ্যালাউড’ গোটা ভারতবর্ষে চোর হয়ে ঢুকে রাজা বনে যাওয়া ইংরেজরা আমাদের পূর্বপুরুষদের কতটা ঘৃণার চোখে দেখত তার নজির ছিল এ সাইনবোর্ড। এই সুযোগকে কাজে লাগানোর জন্য আত্মগোপনকারী বিপ্লবীরা ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের জন্য নুতনভাবে পরিকল্পনা শুরু করে। এসময় ক্লাবেরই একজন বেয়ারা যোগেশ মজুমদারের সহযোগীতায় দক্ষিণ কাট্টলীর বাড়িতেই আশ্রয় পেলেন বিপ্লবীরা। ১৯৩২ সালের ১০ আগষ্ট ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের দিন ধার্য করে তাঁরা।
শৈলেশ্বর চক্রবর্তীর নেতৃত্বে সাতজনের একটা দল সেদিন ক্লাব আক্রমণ করতে গিয়েও ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। শৈলেশ্বর চক্রবর্তীর প্রতিজ্ঞা ছিল ক্লাব আক্রমণের কাজ শেষ হবার পর নিরাপদ আশ্রয়ে ফেরার যদি সুযোগ থাকে তবুও তিনি আত্মবিসর্জন দেবেন। তিনি পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন। গভীর রাতে কাট্টলীর সমুদ্রসৈকতে তাঁর মৃতদেহ সমাহিত করা হয়।
এরপর সেপ্টেম্বর মাসে মাষ্টারদা সূর্য সেন ক্লাবে হামলা করার সিদ্ধান্ত নেন। এই আক্রমণের দায়িত্ব তিনি নারী বিপ্লবীদের উপর দেবেন বলেন মনস্থির করেন, ২৩ সেপ্টেম্বর এ আক্রমণে প্রীতিলতার পরনে ছিল মালকোঁচা দেওয়া ধুতি আর পাঞ্জাবী, চুল ঢাকা দেবার জন্য মাথায় সাদা পাগড়ি, পায়ে রাবার সোলের জুতা।
ইউরোপীয় ক্লাবের পাশেই ছিল পাঞ্জাবীদের কোয়ার্টার। এর পাশ দিয়ে যেতে হবে বলেই প্রীতিলতাকে পাঞ্জাবী ছেলেদের মত পোশাক পড়ানো হয়েছিল। আক্রমণে অংশ নেয়া কালী কিংকর দে, বীরেশ্বর রায়, প্রফুল্ল দাস, শান্তি চক্রবর্তীর পোশাক ছিল ধুতি আর শার্ট। লুঙ্গি আর শার্ট ছিল মহেন্দ্র চৌধুরী, সুশীল দে আর পান্না সেনের পোশাক।
বিপ্লবীদের আশ্রয়দাতা যোগেশ মজুমদার ক্লাবের ভেতর থেকে রাত আনুমানিক ১০টা ৪৫ এর দিকে আক্রমণের নিশানা দেখানোর পরেই ক্লাব আক্রমণ শুরু হয়। সেদিন ছিল শনিবার, প্রায় ৪০জন মানুষ তখন ক্লাব ঘরে অবস্থান করছিল। তিনভাগে বিভক্ত হয়ে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে বিপ্লবীরা ক্লাব আক্রমণ শুরু করে। পূর্বদিকের গেট দিয়ে ওয়েবলি রিভলবার এবং বোমা নিয়ে আক্রমণের দায়িত্বে ছিলেন প্রীতিলতা, শান্তি চক্রবর্তী আর কালী কিংকর দে।
পাহাড়তলী ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ শেষে পুলিশের হাতে আটক হওয়ার আগে পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রীতিলতা পটাসিয়াম সায়ানাইড মুখে পুরে দেন। (সুত্রঃ Wikipedia, সহযোদ্ধা বিপ্লবী কল্পনা দত্ত, বীরেশ্বর রায় ও পূর্ণেন্দু দস্তিদারের স্মৃতি কথা)