এ লকডাউনের সময়ে মোবাইল-ট্যাব-টেলিভিশন তথা স্ক্রিনের আলোতে নিজেকে মজিয়ে রাখাটা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হবে নিঃসন্দেহে। দিনরাত কখনো সূর্য কখনো স্মার্টফোনের আলোয় ডুবে থাকলে আপনার দেহ-মন বঞ্চিত হবে অন্ধকার থেকে। কিন্তু অন্ধকারেরও আছে আপনার দেহের উপর ন্যায্য হিস্যা যাকে বঞ্চিত করলে আখেরে ক্ষতি আপনার নিজেরই।
৪ বিলিয়ন বছর ধরে পৃথিবী নামক গ্রহটির সকল জৈবানু ও জীবের জন্য মোটা দাগে ১২ ঘন্টা দিনের আলো ও বাকী ১২ ঘন্টা অন্ধকার- এমন করেই চলছে। এরমধ্যে গত আড়াই লাখ বছরের মানব জীবনও অন্তর্ভূক্ত। ৫ হাজার বছর আগে যখন কুপিবাতি আবিস্কার হয় তখনো অন্ধকার বঞ্চনা (dark deprivation) মানুষকে পেয়ে বসেনি। ১৩০ বছর আগে ইলেকট্রিসিটি আবিস্কৃত হবার পর মানুষের ২৪ ঘন্টার দিবারাত্রিতে ‘আলো’ তার প্রতিদ্বন্ধী অন্ধকারের ঘরে ভাগ বসাতে থাকলো। শহুরে মানুষেরা রাতের আধারে ছায়াপথ খুঁজে বেড়াতে ভুলে গেল। বৈদ্যুতিক বাতি ঘরের অন্ধকার দুর করে দিলো ঠিক, কিন্ত অন্যদিকে বাইরের তারাভরা আকাশকে পর করে দিলো । সভ্যতা ও বিনোদনে এ রাতের আলোর অবদান অনস্বীকার্য, একইসাথে রাতের এ আলো যদি মানুষের প্রকৃতির স্বাভাবিক ধারায় প্রাপ্য ”অন্ধকারের হিস্যা” থেকে বঞ্চিত করে তবে তা ক্যান্সার, নিদ্রাহীনতা, বিষন্নতাসহ নানা রোগের কারন হয়ে দাড়ায়। বহুবছর ধরে টেলিভিশন এ অপকর্মটা করে যাচ্ছিল। পরে স্মার্ট ফোন এসে মানুষের রাতের অন্ধকারভাগকে কমিয়ে তার ঘূম-জাগরন চক্রকে এলোমেলো করে দেয়। এখন রাতের টিভি আর মোবাইল মিলে তার নানা জৈবপ্রক্রিয়াকে করে তুলেছে বিশৃংখল।
দিনশেষে যখন ধীরেধীরে অন্ধকার ঘনায়ে আসে আমাদের মস্তিস্কের পিনিয়েল গ্ল্যান্ড তখন সক্রিয় হয়ে মেলাটোনিন নামক হরমোন নিঃস্বরন করতে থাকে। এ মেলাটোনিন অন্ধকারের হরমোন। চোখে যতক্ষন আলো পড়ে এটি আর রক্তে আসেনা। ফলে ভাল ঘুমও হয়না। আমাদের মস্তিস্কের পরিকল্পনা হলো আলোতে রক্তে কোন মেলাটোনিন থাকবেনা যাতে জীবকুল এসময়ে সক্রিয় সতেজ থাকতে পারে। অন্ধকারে এ মেলাটোনিন ফিরে এসে প্রানীকে ঘুম পাড়িয়ে দিবে। আবার ভোরের আলোর স্পর্শে মেলাটোনিন হাওয়া হয়ে যাবে ফলে আমরা (অন্ধকার ও মেলাটোনিনময় গভীর ঘুম শেষে) জেগে উঠব। এই গভীরঘুমের after effect হিসাবে সারাদিন আমাদের দেহ মস্তিস্ক থাকবে সতেজ চনমনে। একে বলে ঘুম-জাগরন চক্র বা Sleep-awakening cylce।
কল্পনা করুন মাঝরাতে আপনি যখন ঘুমাতে যাচ্ছেন তখন জানালা দিয়ে সূর্যের আলো ঠিক আপনার খোলা চোখে এসে পড়ছে। কেমন গভীর হবে আপনার ঘূম? রাতের সে কল্পনার সূর্যের কাজটি রাতের পর রাত করে যাচ্ছে আপনার মোবাইল screen বা টেলিভিশন ল্যাপটপের light!
রাতের বেলা আলো দেখে চোখের রেটিনা যখন সিগনাল পাঠায়- মস্তিস্ক তখন confused বা বিভ্রান্ত হয়ে যায়, এটি মধ্যরাতকেই ভোর ভেবে মেলাটোনিন নিঃস্বরন বন্ধ রাখে। আপনার আর ভালো ঘূম হবেনা। অনেকটা Jet leg এর মতো ব্যাপার।
এ দেহঘড়ি এলোমেলো হয়ে গেলে ডিপ্রেশান, দুঃশ্চিন্তা, মনোবৈকল্য, অনিদ্রা ছাড়াও ক্যান্সার বিশেষ করে নারীদের breast cancer ও পুরুষদের prostate cancer হতে পারে। মেলাটোনিন এর অভাবে কোষীয় চক্রে অনিয়ম ও DNA damage কে ক্যান্সারের কারন হিসাবে ধরা হয়।
রাতের অন্ধকারবঞ্চনা যে breast cancer এর risk তার কয়েকটা পরোক্ষ সাক্ষী হলো, রাতের শিফটে যারা কাজ করে তাদের এ ক্যান্সার বেশী হয়। অন্ধ নারীদের এটি হয়না বললেই চলে। যারা পর্যাপ্ত ঘূমায় (ধরে নেয়া যায় অন্ধকারেই ঘূমায়) তাদের এটি কম হয়। বেড রুমে আলোর মাত্রার সাথে breast cancer এর সরাসরি সংযোগ আছে।
স্মার্টফোন, ইউটিউব, টিভির দাস হয়ে নিজেকে প্রতি রাতের অন্ধকারের হিস্যা হতে বঞ্চিত করবেননা। আপনার প্রাপ্য অন্ধকার বুঝে নিন, মোবাইল বা টিভির আলোকে তা গ্রাস করার সুযোগ দিবেন না।
ইউটিউব টিভিতে সিরিয়াল দেখে দেখে হোমো সিরিয়ালেন্স (Homoserialens) বা মোবাইলে বুঁদ হয়ে থেকে হোমো মোবাইলিয়েন্স (Homo mobiliens) নয়, হোমো স্যাপিয়েন্স (Homo sapiens) হিসাবেই বেঁচে থাকুন।
– ডা: আমিনুল ইসলাম: বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক