করোনা সেনাদল ঘিরে রেখেছে সরকারি দপ্তরগুলো; ঢুকে পড়েছে কী পয়েন্ট ইন্সটলেশন গুলোতে।
এসময় করোনার সামনে এক ক্ষমতাহীন মন্ত্রীকে প্রেস কনফারেন্স করতে দেখে করোনা সেনারা খিল খিল করে হাসে।
–ভাব দেখে মনে হচ্ছে এখনো ক্ষমতায় আছে; বিরাট বিরাট গালগল্প দিচ্ছে রে। একে বলে প্যাথলজিক্যাল লায়ার। লকই নাই যার সে এসেছে লকডাউন করতে।
–গাল গল্প দিয়ে অভ্যাস হয়ে গেছে; তাই ক্ষমতায় আছে কী নাই সেই হুঁশ নাই। কথার ভাব এমন যেন; করোনার ওপর পিএইচ ডি মেরে এসেছে।
এক সিনিয়র করোনা কর্মকর্তা এসে নির্দেশ দেয়, যাও তোমরা গিয়ে লাঞ্চ করো; কিছু মানুষ খেয়ে এসো।
এক জুনিয়র কর্মকর্তা বলে, গোটা করোনা সাম্রাজ্যের মধ্যে এই রাজ্যে খাবার খুব সস্তা। আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে এখানে করোনা গিয়ে মানুষ খেলে; করোনার দোষ হয় না। দোষ হয় সর্দি-জ্বর নাইলে ভাগ্যের।
–তাই বলে বেশি বেশি খেওনা। ওভার ওয়েট হলে করোনা সেনাদল থেকে বাদ পড়বে। তখন ঐ সর্দি-জ্বর-শ্বাস কষ্ট হয়ে বেঁচে থাকতে হবে।
জুনিয়র কর্মকর্তা জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা স্যার, প্রত্যেকটা প্রেস কনফারেন্সে এরা খালি ভাবমূর্তি রক্ষার কথা বলে। ভাবমূর্তি আবার কী?
–শুনেছি এদেরকে সবাই ‘চোর’ বলে জানে। তাই সব সময় একটা সাধুর ভাবের মূর্তি ধারণ করে চলতে হয়। ভং ধরতে হয়। ঐ ভং নিয়ে লোকে খুব হাসাহাসি করে। ঐ হাসিটা বন্ধ করতে “ভাবমূর্তি” রক্ষার কথা বলে।
–এতোদিনে বুঝলাম; একদল লোক বুকে থাবা দিয়ে দিয়ে কেন বলে “আমরা সবাই হাসি না।” খুব গম্ভীর ভাব ধরে রাখে তারা।
–ঐ যে চোর তো তাই গম্ভীর হয়ে সাধু সেজে থাকে। যাও লাঞ্চ সেরে এসো। মন্ত্রীদের হাউজ এরেস্ট করার কাজ আছে বিকেলে।
–করোনা সেনারা তো সব জায়গায় অবস্থান নিয়েছে। হাউজ এরেস্ট থেকেই তো মন্ত্রীরা কাজ করার ভান করছে।
–ওদের আবার কী কাজ; এখন কাজ তো আমাদের। এদের অর্থনীতির ধস নামিয়ে দিতে হবে।
–ঐটা এমনিতেই হয়ে যাবে। এরা বড় বড় গালগল্প দিতে গিয়ে জিডিপি লাইট জ্বেলে “ধনী হয়ে গেছি” এমন প্রচারণা চালিয়েছে বিশ্বজুড়ে। ফলে ধনীদের করোনাকালের অর্থ-সাহায্য তো আর পাবে না।
সিনিয়র কর্মকর্তা হেসে বলে, ভাবমূর্তির নেশাটাই এদের সারলো।
যা নয় নিজেকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তাই দেখানোর এমন বাতিক মেলা ভার। আর ধনী দেশগুলোকেও আমরা দখলে রেখেছি; ওদেরকে পথে নামিয়ে ছাড়বো। কীসের অন্যকে সাহায্য করা; করোনা সাম্রাজ্যে পতিত রাষ্ট্রনায়কদের এখন ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা।
জুনিয়র করোনা কর্মকর্তারা দুপুরের আহারে মানুষ খেতে চলে যায়।
সিনিয়র কর্মকর্তার কাছে তার বস আসে। গভীর দুঃশ্চিন্তার সঙ্গে বলে, যাই বলো, চীনে-ইটালিতে মানুষ খেয়ে যত মজা আছে; এইখানে তা নাই। জীবন্মৃত মানুষ খেলে কেমন যেন বাসি-পচা খাবার মনে হয়।
টিভিতে করোনার কাছে আত্মসমর্পিত সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের “কোথাও করোনা নাই” ভিডিও কনফারেন্স শুরু হলে; সিনিয়র করোনা কর্মকর্তা হো হো করে হেসে ফেলে, ওরে “ভাবমূর্তি-গাধা” চেয়ে দ্যাখ তোর ল্যাপটপে করোনা সেনারা বসে আছে।
–কী বললো শুনেছেন! ওরা নাকি করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে!
–এমেরিকাকে করোনা সৈনিকরা শুইয়ে দিয়েছে; হাতি-ঘোড়া গেলো তল; মশা বলে কত জল?
এমন সময় এক দার্শনিক প্রকৃতির করোনা কর্মকর্তা বলে, ধনী দেশ; উন্নত দেশ খেয়ে দিতে মজা লাগে; কিন্তু এই পান্তাবুড়ির গল্পের দেশে মানুষ খেতে বড্ড মায়া হয়। আহারে মানুষ কত সরল; করোনায় মরতে মরতে শপিং-এ যায়, ভীড় জমিয়ে ধান কাটার ছবি তোলে, ইফতারের জিলাপি কিনতে দল বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে। এখানে মানুষ খেলে বড্ড অনুতাপ হয়।
সিনিয়র করোনা কর্মকর্তা ধমক দিয়ে বলে, তুমি কী জানো এই মায়া করে করে গ্রিক বীর আলেকজান্ডার এ রাজ্যে ঢোকেননি। যুদ্ধ জয় করতে চাইলে কক্ষণো এসব মায়ার খেলায় ভুলবে না।
–কিন্তু এদের এতো শখ অপূর্ণ আছে। প্রতিদিনই দেখি ফেসবুকে এরা কত কৌশলে ভিখারির মতো একটু এফলুয়েন্স তুলে ধরে। এদেরকে ক্ষমা করে দেয়া যায় না!
–শুনেছি এখানে “ঘুষ” খুব জনপ্রিয় সংস্কৃতি; তুমি আবার এদের কাছে ঘুষ টুষ নিলে নাকি!
–ভেবে দেখুন স্যার কত কষ্টে “ফইন্নি থেকে ফড়িয়া হয়ে অবশেষে ফন্ত্রী” হয় এরা। দপ্তর নির্দেশ দিয়ে নিজেদের “গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি” বলে জাহির করে। মৃত্যুতেও এদের কাস্ট সিস্টেম আছে; কারো জন্য মেডিকেল বোর্ড বসে আবার কেউ হাসপাতালে জায়গা না পেয়ে সামনের রাস্তায় ছট ফট করে মরে যায়। এখানে জন্মেও কাস্ট সিস্টেম আছে। একটু পয়সা আছে যাদের তারা করোনা বেবি জন্ম নিলে তার বাবা ফেসবুকে এসে বলে, এই দুঃসময়েও রাজকন্যা আমাদের ঘর আলো করে এলো। আর যাদের পয়সা নাই; তাদের করোনা বেবি হাসপাতালে জায়গা না পেয়ে ভ্যান গাড়িতে জন্ম নেয়।
–এদের জাতীয় রোগ ভাবমূর্তি; আর কিছু নয়। এখনো বুঝতে পারেনি; এখন এ রাজ্যে গুরুত্বপূর্ণ বলে যদি কেউ থাকে; সে হচ্ছে করোনা। অথচ এখনো ফেইক ভি আইপি হয়ে বসে আছে গ্যারগেন্ডিভাসগুলো।
সিনিয়ার করোনা কর্মকর্তা দার্শনিক কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করে, করোনা উপনিবেশ টিকিয়ে রাখতে এ রাজ্যে একটা প্রণোদনা সংগীত প্রয়োজন। যা করোনা শাসনের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করতে পারবে। জনগণকে করোনায় মৃত্যুবরণে আরো প্রণোদিত করতে পারবে। এমন কোন গানের কথা জানা আছে কী?
–এখানকার লোকেরা অবশ্য টেকাটুকার প্রণোদনা ছাড়া আর কোন প্রণোদনা বোঝেনা। তবে যেহেতু খুব ভাবমূর্তি সচেতন; তাই নিজেকে অত্যন্ত কালচার্ড দেখাতে মাঝে মাঝেই কেন যেন “রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ” বলে চেঁচায়। খোঁজ নিয়ে দেখলাম, রবীন্দ্রনাথের একটি গান আছে; যা খুবই করোনামুখী।
“ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে
ও বন্ধু আমার!
না পেয়ে তোমার দেখা, একা একা দিন যে আমার কাটে না রে ॥”
সিনিয়ার করোনা কর্মকর্তা মুগ্ধ হন, আহা এমন করোনামুখী গান আগে কখনো শুনিনি। ঠিক আছে। তবে এভাবে গাও,
“ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে
ও করোনা আমার!
না পেয়ে তোমার দেখা, একা একা দিন যে আমার কাটে না রে ॥”
– মাসকাওয়াথ আহসান
সাংবাদিক, সাংবাদিকতার শিক্ষক
Editor in Chief : E-SouthAsia