করোনা-বিংশের মুন্ডুহীন রূপের রাণীরা
করোনাকাল যেহেতু অন্তহীন; তাই নিউ নরমাল লাইফ শুরু হচ্ছে ধীরে ধীরে। করোনা থেকে বাঁচতে মাস্ক পরতে হচ্ছে; তাই রেশমি কাপড়ের মাস্ক বেরিয়েছে। এরপর বাইরে থেকে দেখা যায় না; কেবল নাকের মধ্যে পুরে রাখা যায়; এমন ফ্যাশনেবল ছাকনি দিয়ে মাস্ককে সরানো যায় কী না সে জল্পনা কল্পনা চলছে। আমস্টারডামের এক নিউ নরমাল রেস্টুরেন্টের ছবি দেখলাম; স্বচ্ছ তাঁবুর মধ্যে সোশ্যাল ডিসটেন্সে ক্যান্ডল লাইট ডিনার ফিরিয়ে আনার কসরত চলছে।
জীবন যেহেতু দোকানদারিময়; তাই করোনাকে কেন্দ্র করে বিজনেস আইডিয়া উদ্ভাবনের নেশায় বুঁদ দোকানদারেরা। বিমানগুলো ফ্লাইট চালানোর জন্য মরিয়া। এখন থেকে বিমানবন্দরে করোনা চেকিং-এ বাড়তি দু’ঘন্টা সময় লাগবে।
ঘুষের টাকা ডিস-ইনফেক্ট করে তবে ঘুষখোরকে দিতে হবে। করোনাকালে ঘুষের টাকা পরিচ্ছন্ন টাকা হিসেবে এই প্রথম পরিবেশিত হবে।
এখন থেকে গুম কারিগরের অনেক সুবিধা হয়ে গেলো। “দেশের শত্রু”কে গুম করে ডোবার ধারে ফেলে রাখবে। মানুষ ভাববে ইকুয়েডরের মতো করোনায় লাশ পড়ে আছে।
জুয়ার বোর্ডে ডাইস আর কার্ড ডিসইনফেক্ট করে সাজানো থাকবে; সেইখানে স্বচ্ছ তোয়া পিপিই পরে ‘সহমত ভাইয়েরা জুয়া খেলবে’। নিরাপদ দূরত্বে থেকে পাপিয়া ভাইরাস ছুঁড়ে দেবে ‘দেশপ্রেমের লাস্য’।
আবার টিভি স্টেশানের ডিস ইনফেকশানের প্রক্রিয়া শেষে টকশোতে এসে বসবে উগ্রজাতীয়তাবাদের সিংহেরা। আবারও তারা ঘাড় ঘষতে ঘষতে “দেশের মালিকানা দাবি করবে।” রাজনীতির দোকানগুলো মাইক্রোফোন ডিস ইনফেক্ট করে প্রেস কনফারেন্স করবে। করোনা রোগীর সাহায্যের জন্য ভেন্টিলেটর নেই যথেষ্ট; কিন্তু যন্ত্র ঐ একটাই ষড়যন্ত্র আছে পর্যাপ্ত।
মসজিদে এঁকে দেয়া গোল চিহ্নের মধ্যে বসে ধর্মপ্রেমের ম্যানেজারেরা দ্বেষ ছড়ানোর রিরংসায় মাতোয়ারা হবে। মন্দিরে সামাজিক দূরত্বে ঘন হবে ধর্মপ্রেমের ম্যানেজাররা। দ্বেষ ছড়ানোর কাজে তারা সুনিপুণ। তাছাড়া করোনার কোন ওষুধ আসেনি। এখন পর্যন্ত ধর্মপ্রেমই এর একমাত্র ওষুধ।
স্বাস্থ্য খাতে করোনা রোগ; মেডিকেল সাপ্লাইয়ের দেশপ্রেমিক কাছিম কমিশনের ব্যবসার অপার সুযোগ এনে দিয়েছে। আবার কিছু সেকেন্ড হোম হবে কমিশনের কাছিমের বাচ্চাদের।
কাঁটাবনে মাস্কের শো-রুম খোলার একটা দোকান পেয়ে যাবে ইউটিউবার; যে ‘পদ্মা সেতু নিয়ে গান বেঁধেছিলো’।
“গ্লেগের কালে রবীন্দ্রনাথ” শীর্ষক অভিসন্দর্ভ হটকেক হবে একাডেমিক বলয়ে। “১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু”র কালে লেখা কবিতার সংকলন প্রকাশিত হবে প্রথমা প্রকাশনী থেকে।
করোনা যুদ্ধ জয়ী বুদ্ধিজীবীর কলামে ধারাবাহিকভাবে ছাপা হবে, “একাত্তরের যুদ্ধ থেকে করোনাযুদ্ধ।”
করোনামুখী গান করে ইউটিউবে তুফান তুলবে সদ্য গোঁফ গজানো কোন স্নিগ্ধ তরুণ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের করোনা প্রশমন ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ একসময়ের এমবিএ-কম্পিউটার সায়েন্স-ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার ক্যারিয়ারের চেয়ে বেশি ঝলক নিয়ে হাজির হবে।
তবে শিক্ষক হিসেবে সেই আদি ও অকৃত্রিম গোলাম করোনাবিদ; যে কয়েকটি জুম কনফারেন্সে করোনা সম্পর্কে বলে; মনিবের মন জিতেছে। যে পুরো করোনার সময়টিতে ছিলো, আশার সওদাগর।
“করোনা-সম্পর্কে উনাকে সীমিত আকারে ভুল বোঝানো হয়েছিলো”; এই অনলাইন সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামের মধ্য দিয়ে আবার শুরু হবে “সীমিত সহমতের গান”।
করোনা একটি গুজব ছিলো; আর তা রটিয়েছিলো দেশের শত্রুরা; সুতরাং অনলাইনের আল-করোনা জঙ্গি গোষ্ঠী পুলিশ ও এলিটফোর্সের রেজাকার হিসেবে তাদের হাতে ‘দেশের শত্রু’ বুদ্ধিজীবীর তালিকা তুলে দেবে। ‘দেশের শত্রু’ বুদ্ধিজীবীর তালিকা একাত্তরে যারা প্রণয়ন করেছিলো; তাদের প্রেতায়িত আত্মারাই অনলাইনে ফিরে এসেছে যেন। চোখে তাদের রক্ত-পিপাসা।
জিডিপি বাবা লুডুর বোর্ডে আবার নেমে আসবেন জিডিপির ডাইসটি নিয়ে; দরবেশ বাবা নেমে আসবেন ধন্বন্তরী ওষুধ নিয়ে; যা একই সঙ্গে মানুষ ও অর্থনীতি বাঁচাতে পারে করোনাভাইরাসের হাত থেকে।
করোনা প্রণোদনার টাকায় গার্মেন্ট মালিকেরা করোনা ফ্রেন্ডলি পোরশে কিনে তাতে চড়ে; সোশ্যাল ডিসটেন্সে বসে থাকা তরুণদের “করোনাকালে পৃথিবীর নিরাপদতম গার্মেন্টস” গড়ার কারিগর হিসেবে মোটিভেশনাল স্পিচ দেবেন।
সারাজীবন সোশ্যাল ডিসটেন্সে সুখে থাকা মানুষের মনে হবে, করোনাত্তর পৃথিবী বদলে যাবে; করোনার শিক্ষা; এসব হাইপোথিসিসে মানুষ কত পরিবর্তনের আশা করেছিলো। কিন্তু ঢেঁকি তো করোনাকালেও ধানই ভানবে; এটা বোঝা উচিত ছিলো।
করোনাকালের সবচেয়ে আনন্দিত দোকানদার “চিরবিদায় স্টোর”। সব মানুষই কাফনের কাপড় কিনে রেখেছিলো। যারা করোনায় মরেছে; তাদের কাফন ব্যবহৃত হয়েছে। যারা মরেনি তারা কাফনের কাপড় কেটে ঈদের পাঞ্জাবি বানিয়েছে। আর আনন্দিত ত্রাণ দোকানি; করোনা ত্রাণ লুটের পয়সায় “মমিন চোর” মমিন চৌধুরী হয়ে উঠেছে রাতারাতি; তার দালান উঠছে তরতরিয়ে; করোনা নিকেতন।
আর করোনাকালে বার্ধক্য-ভাতা তুলতে গিয়ে; একদন্ত গ্রাম থেকে আসা ফইজুন খাতুন যখন শোনেন, তার ভাতা প্রাপ্তির সময় আসেনি; তখন ক্ষুধার্ত “বিষ বিশে”র মা পাশের শপিং সেন্টারে গিয়ে হাত পাতেন; উন্নয়নের রহস্যময়ী হাসিতে আশাদায়ী ম্যানিকিনের কাছে। ঠিক তার পেছনে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে রূপকল্প একবিংশের মুন্ডুহীন রূপের রাণীরা।
ক্রমশঃ
মাসকাওয়াথ আহসানের বিচূর্ণীভাবনার ধারাবাহিক
– মাসকাওয়াথ আহসান
সাংবাদিক, সাংবাদিকতার শিক্ষক
Editor-in-chief, E-SouthAsia