হাবিব খান/রাউজান: দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র চট্টগ্রামের হালদা নদী । বর্তমান সরকার মুজিব বর্ষে এই নদীকে ‘বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ’ ঘোষণা করার উদ্যোগ নেয়। এতে হালদা নদী জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ ঐতিহ্যগত স্থান হিসেবে বিশ্বে পরিচিত হবে। হালদায় মাছের অভয়াশ্রমের পাশাপাশি প্রকৃতিতে আসবে নতুন প্রাণ। নদীটীর দৈর্ঘ্য ১০৬(৬৬মাইল) কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ১৩৪ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। হালদার উৎপত্তি স্থল মানিকছড়ি উপজেলার বাটনাতলী ইউনিয়নের পাহাড়ী গ্রাম সালদা। সালদার পাহাড়ী র্ঝণা থেকে নেমে আসা ছড়া সালদা থেকে হালদা নামকরণ হয়। সালদা নদী নামে বাংলাদেশে আরো একটি নদী আছে যেটি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে উৎপন্ন ব্রাহ্মনবাড়িয়া জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
প্রতিবছর হালদা নদীতে একটি বিশেষ মূহুর্তে ও বিশেষ পরিবেশে রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউস ও কার্প জাতীয় মাতৃমাছ প্রচুর পরিমাণ ডিম ছাড়ে। ডিম ছাড়ার বিশেষ সময়কে ‘তিথি’ বলা হয়ে থাকে। মা মাছেরা এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত শুধু অমাবস্যা বা পূর্ণিমার তিথিতে অনুকূল পরিবেশে ডিম ছাড়ে। ডিম ছাড়ার এই বিশেষ সময়কে স্থানীয়রা ‘জো’ বলে। এই জো’র বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অমাবস্যা বা পূর্ণিমা হতে হবে, সেই সাথে প্রচণ্ড বজ্রপাতসহ বৃষ্টিপাত হতে হবে; এই বৃষ্টিপাত শুধু স্থানীয় ভাবে হলে হবে না, তা নদীর উজানেও হতে হবে। ফলে নদীতে পাহাড়ি ঢলের সৃষ্টি হয়।
এতে পানি অত্যন্ত ঘোলা ও খরস্রোতা হয়ে ফেনাকারে প্রবাহিত হয়। জো’এর সর্বশেষ বৈশিষ্ট্য হল নদীর জোয়ার ভাটার জন্য অপেক্ষা করা। পূর্ণ জোয়ারের শেষে অথবা পূর্ণ ভাটার শেষে পানি যখন স্থির হয় তখনই কেবল মা মাছ ডিম ছাড়ে। মা মাছেরা ডিম ছাড়ার আগে পরীক্ষামূলক ভাবে অল্প ডিম ছাড়ে। ডিম ছাড়ার অনুকূল পরিবেশ না পেলে মা মাছ ডিম নিজের দেহের মধ্যে নষ্ট করে দেয়। ডিম সংগ্রহ করে জেলেরা দেশের বিভিন্ন মাছ ব্যবসায়ী থেকে শুরু হ্যাচারিতে বিক্রি করেন।
এবার মা মাছ রক্ষায় ডিম সংগ্রহকারীদের শপথ :
শনিবার চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার দক্ষিণ মাদার্শা ইউনিয়নের ৬৯ জন ডিম সংগ্রহকারী হালদা নদীর মা মাছ রক্ষায় শপথ নিয়েছেন। দুপুরে মদুনাঘাট এলাকায় বড়ুয়া পাড়া হ্যাচারিতে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রুহুল আমিনের উপস্থিতিতে এই শপথ করানো হয়।
আব্দুল মজিদ সাংবাদিকদের জানান, আমাদের ইউনিয়নে যে ডিম সংগ্রহকারী আছেন, তাদের সবাইকে খাদ্য সামগ্রী দেওয়া হয়েছে। তারা শপথ করেছেন তারা হালদার মা মাছ রক্ষায় কাজ করবেন।
পুর্বপুরুষের পেশা ও নেশা হিসাবে প্রতিবছর ডিম সংগ্রহকারী মোহাম্মাদ ওসমান বলেন, আগে আমরা দেখা যেত মা মাছ ডিম ছাড়লে ১০ কেজির অধিক ডিম সংগ্রহ করতাম। কিন্ত বিগত কয়েক বছরে সেই তুলনায় ডিম সংগ্রহ করা যায় না। তবুও পেটের তাগিদে প্রতিবছর ডিম সংগ্রহ করি।
হালদা পাড়ের বাসিন্দা মোয়াজ্জেম জানান, আমাদের ছোট বেলায় আমরা দেখতাম মা মাছ ডিম ছাড়লে এদিকে একটা উৎসবের মত একটা আয়োজন হতো। নোয়াখালি থেকে ডিম সংগ্রহের কাজে এখানে মানুষ আসতো। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে মা মাছও কমে আসছে সেই সাথে ডিমের পরিমাণও।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রুহুল আমিন জানান, হালদা নদীতে ডিম সংগ্রহকারীরা শপথ করেছেন তারা নিজেরাই হালদা পাহারা দেবেন। মাছ শিকার থেকে বিরত থাকবেন এবং অবৈধভাবে কেউ মা মাছ শিকার করলে তারা শিকারীদের ধরে প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করবেন।
উল্লেখ্য, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদায় এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে ডিম ছাড়ে মা মাছ। এসময় নদী পাড়ের বাসিন্দা ডিম সংগ্রহকারীরা এসব ডিম সংগ্রহ করেন। পরে হ্যাচারি ও মাটির কুয়ায় ডিম ফুটিয়ে রেণু পোনা হয়।
হালদা নদীর হাটহাজারী অংশে ডিম আহরণকারী মোট ২৫৮ জন। তাদের মধ্যে দক্ষিণ মাদার্শা ইউনিয়নে ৬৯ জন ডিম আহরণকারীর বাস।
দুষণ রোধে প্রশাসনের ব্যবস্থা :
হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মঞ্জুরুল কিবরিয়া বলেন, অন্যান্য বছরের চেয়ে সার্বিক বিবেচনায় ভালো অবস্থান ও অনেক নিরাপদে আছে হালদা। দূষণের বড় কারণ হাটহাজারী পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট, এশিয়া পেপার মিল বন্ধ রয়েছে। একই সঙ্গে মা মাছ রক্ষায় হাটহাজারীর ইউএনওর ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো, আইডিএফ নামের একটি এনজিওর ভালো ভূমিকা ছিল। অবৈধ বালু উত্তোলনের ড্রেজারগুলোও ছিল নিয়ন্ত্রণে।
হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিন বলেন, গত দেড় বছরে এ পর্যন্ত হালদা নদী থেকে এক লাখ ১৩ হাজার মিটার কারেন্ট জাল জব্দ করেছি। জব্দ করেছি সমপরিমাণ বালি ও ড্রেজার। নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে হালদা নদীর মা মাছের সুরক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি। এছাড়া হালদা দূষণের জন্য দায়ী দুটি প্রতিষ্ঠান (পিকিং প্ল্যান্ট ও এশিয়ান পেপার মিল) বন্ধ আছে। সব মিলিয়ে এবার হালদার মা মাছ পর্যাপ্ত ডিম দিতে প্রস্তুত। আবহাওয়া পরিস্থিতি যদি হালদার মেজাজ উপযোগী হয় তাহলে এবার ডিমের ব্যাপক উৎপাদন আশা করা যায়।