প্রতিবেশী একঘর ছাড়া বাকি সাত ঘরের কেউই এই লোকডাউনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছেন না। ঘরে আমার ছেলে এবং তার বউ দুজনেই অসুস্থ। ছেলের জন্য ডিপ্রেশন আর বউয়ের হার্টের ছিদ্র জন্মগত। একবার অপারেশন ফেল করেছে। তার উপরে জেনেটিক জন্ডিসে লিভার আক্রান্ত। ওষুধ চলছে। লিভার ভালো হলে আবার হার্টের অপারেশন করতে হবে। আমার নিজের অসুখ। ছেলে আর বউ রাগারাগি করছে, কোনোভাবেই বাইরে যাওয়া যাবে না। এরই মাঝে অফিসিয়াল কাজে তিন দিন স্কুলে যেতে হয়েছিল। ঘরে ফিরেই কিছু না ধরে গোসলখানায় ঢুকে পড়ি। মাস্ক, গ্লাভসস সব কিছু সাবান পানিতে ভিজিয়ে প্রতিদিনই ধুয়ে ফেলেছি।
যাই হোক, যে কথা বলছিলাম। ছেলে বউ রাগারাগি করছিলো আমার ঘর থেকে বের হওয়া নিষেধ। পরপর দুইদিন একদমই বের হইনি। এর ভেতর তিনদিনের দিন পাশের ঘরে মামাতো বোন এর দশ বছর বয়সী ছেলে যাকে দেখতে ছয় বছর বয়সী মনে হয় – এসে আমাকে বলল, ‘খালামণি বাবু পড়ে মাথায় ছিদ্র হয়ে গেছে। অনেক রক্ত!’ কিসের করোনা, মাথায় কিছুই নেই। ওদের ঘরে এক দৌড়েে যাই । বাবুর বাবা গিয়ে ওয়াশ করে আপাততঃ ব্যান্ডেজ করিয়ে এলো। সেলাই করা লাগেনি। অ্যান্টিবায়োটিক ও আনলো। এই করোনায় ডাক্তার কই,সেলিম ভাইই (ওষুধ বিক্রেতা) ভরসা। আমার পেছনে ছেলে, বউ সবাই গেলো। মাখামাখি হলো করোনার সাথে। ধরেই নিয়েছি এখন এখানে , মানে – এই বাংলাদেশ সবাই করোনা পজেটিভ । সবার দিক থেকেই অবহেলা তো আর কম হয়নি!
আমরা তিনজন ঘরের ভেতর প্রায়ই বলাবলি, করি আমাদের একজনের যদি হয় আমরা তিনজনই ইচ্ছে করেই পজিটিভ হবো। আমরা কেউ কাউকে ছাড়া বাঁচতে পারব না, আসলে কেউ কাউকে ছাড়া বাঁচতে চাই ও না আমি জানিনা এই আবেগ কি এশীয় আবেগ নাকি স্রেফ বাংলাদেশী আবেগ, তবে এটা বুঝতে পারি এটাই আসলে আমাদের গ্রামের মানুষ। এটাই বাংলাদেশের মানুষ। মফস্বলের মানুষ এরকমই হয়। আমার ঘরে কিছু হলে অবশ্যই ওরাও ছুটে আসতো করোনার সঙ্গে মাখামাখি হতো। এখন যে সিদ্ধান্তে এসেছি সেটা হলো এরকম যতটা সম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে চলবো, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবো তার মানে এই নয় যে, আসলে সব সময়ই পারবো। মরে গেলেও দুঃখ নেই প্রতিদিন কতো মানুষ অনাহারে মরে, রোড এক্সিডেন্টে মরে, অবহেলায় মরে। নির্যাতনের বিচার না পেয়ে আত্মহত্যা করে। ধর্ষণের শিকার হয়ে মরে। সুতরাং এই মরার রাজ্যে মরার ভয় কিসের! এখানে এসব এক রকম আদিখ্যেতা মনে হয় আমার কাছে। এখানে জীবনের চাইতে বেশি সত্য মনে হয় আমার কাছে মৃত্যুকেই।সেই ছোটবেলা থেকেই এতদূর যে পথে হেঁটেছি সে পথে সুখের চাইতে অসুখ বেশি। স্বাস্থ্য সচেতনতা বড়লোকদের মিডিয়ার ঢং মনে হয়।বেশিরভাগ মানুষ এই হিসাবের বাইরে বসবাস করছে। তাই আমার মৃত্যু হলে আমি একটুও অবাক হবো না। সেটা আমার কাছে খুব স্বাভাবিক মৃত্যু বলেই মনে হবে। এই অবস্থায় যদি অসুস্থ হই, হাসপাতালে যেতে পারবো কিনা, ভর্তি হতে পারবো কিনা বা আদৌ যাবো কিনা সে ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। নেবুলাইজার, মেডিসিন হাতের কাছে রেখেছি এইটুকুই ভরসা। হাসপাতালে যাবো, ভেন্টিলেশন পাবো এরকম দুরাশা আমি অন্তত করি না।
আমার কোনোই আশা নেই,আমি স্বপ্ন দেখতে পারছি না।আমি অবাক হতে ভুলে গেছি। এটা কী আসলেই কোনো জীবন!
– শামা আরজু, লেখক, শিক্ষক