সিগেরেট ব্যাপারটা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর; এই সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ দিয়ে আজকে সিগেরেটের স্মৃতিকথা শুরু করছি।
শিশুকালে আব্বাকে সিগেরেটের ধোয়ার রিং বানিয়ে গোল গোল করে ছাড়ার ম্যাজিকের অনুরোধ করতাম প্রায়শই। আব্বার বন্ধুদের আয়েশ করে ধোয়া ছেড়ে অবসর আড্ডা মাতাতে দেখে নিকোটিনের ভক্ত হয়ে যাই রীতিমতো।
কিন্তু আম্মা যেহেতু আমাদের গৃহ সরকারের প্রধান ছিলেন; ফলে বিরোধী দলীয় নেতা আব্বাকে দমন-নিপীড়নের একটাই ভাষা ছিলো তার, এতো চিমনির মতো ধোয়া ছেড়ো না তো।
এ কারণে যে বয়সে ছেলেরা সিগেরেট ধরে; সে বয়সটাতে সিগেরেট ধরিনি। গৃহের প্রধানমন্ত্রীর সিগেরেট বিরোধী স্বৈরমনোভাবের কারণে; ভয় পেয়ে একসময় স্বৈরশাসকের ভক্ত হয়ে গেলাম। এরকম হয়; দেশের জনগণের মাঝেও স্বৈরশাসনের ভয় এভাবে ভক্তিতে রূপ নেয়।
তবে আব্বার ধারে কাছে থেকে; প্যাসিভ স্মোকিং-এর ভালো লাগাটা পুরোপুরি উপভোগ করতাম। পরীক্ষার আগে একবার সকালে উঠে অংক কষতে গিয়ে কিছুতেই বুদ্ধির তালা খুলছিলো না। অপেক্ষা করছিলাম ব্রেক ফাস্টের পর আব্বার প্রথম সিগেরেট ধরানোর। আব্বার সিগেরেটের গন্ধ পেয়েই মাথাটা খুলে গেলো। আনন্দের সঙ্গে অংক কষতে শুরু করলাম।
আম্মা ব্যাপারটা ধরতে পেরে আব্বাকে জানালেন আমার প্যাসিভ স্মোকার হয়ে ওঠার ইস্যুটা। আব্বা বেশ কিছুটা সচেতন হয়ে গেলেন। ধীরে ধীরে আমি নিকোটিনের সৌরভহীন জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়লাম। দেশের জনগণ যেমন মুক্তমতের সৌরভহীন জীবন মেনে নেয়। মন খুলে কথা বলা যাবে না; হাসা যাবে না; এরকম রুটিন জীবন মেনে নেয়।
কলেজে ওঠার পর আমার এক কবি বন্ধু লাবু আমাকে নিয়ে রাজশাহীতে পদ্মা নদীর ধারের টিবাঁধে গিয়ে খুব রিল্যাক্সড মুডে সিগেরেটে টান দিতো আর তার নতুন কবিতা পড়ে শোনাতো। আরেক কবি বন্ধু লীন তো রীতিমতো আমার আব্বার মতো ধোয়ার রিং বানাতে পারতো। এসময় লাবু বা লীন আমাকে সিগেরেট খাওয়ার জন্য কোন সাধাসাধি করেনি; করেনি অন্য বন্ধুরাও। স্কুল-কলেজের বন্ধুরা “এরিয়া অফ প্রাইভেসি”-কে রেসপেক্ট করতো। একারণে “অমুকের সঙ্গে মিশে আমার ছেলেটা গোল্লায় গেলো” নিখিল বঙ্গ অভিভাবক সমিতির এরকম প্রবাদ বাক্যের কোন সত্যতা পাইনি যাপিত জীবনে।
ফলে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় এতো সিগেরেট মুক্ত জীবন কাটলো যে, ঢাকা ইউনিভার্সিটির ইংলিশ ডিপার্ট্মেন্টের আলী নিয়ামত ভাই তার সংগঠন “আমরা ধূমপান নিবারণ করি (আধুনিক)-এ যোগদানের সস্নেহ আমন্ত্রণ জানালেন। কিন্তু আমার বন্ধু বৃত্ত ছিলো “আমরা ধূমপান নিয়মিত করি” (আধুনিক) সংগঠনের সদস্য। ফলে আলী নিয়ামত ভাইয়ের ধুমপান বিরোধী আন্দোলনের সদস্য হতে চাইনি আদর্শিক কারণে।
কবি বন্ধু হুমায়ূন রেজা সিগেরেট খেতো; আর নতুন লেখা কবিতা স্মৃতি থেকে আবৃত্তি করতো । ফলে ভালো কবিতা লিখতে সিগেরেট খেতে হয় এটা নিশ্চিত হয়ে গেলাম।
সুতরাং গদ্য লেখাই একমাত্র অপশন হিসেবে রইলো। ভোরের কাগজে “বিষণ্ণতার শহর” নামে একটি ধারাবাহিক লেখার সুবাদে ভোরের কাগজের সাংবাদিক ও কবি হূমায়ূন রেজা পরিচয় করিয়ে দিলো, ফিচার সাংবাদিকতার কিংবদন্তী সঞ্জীব চৌধুরীর সঙ্গে। সঞ্জীব’দার কবিতা-গানের খুশিজলে একটা আনন্দময় লেখালেখির ভুবন খুঁজে পেলাম। সিগেরেটের সঙ্গে কালে ভদ্রে দেখা হতো; কেবল খুশিজলের আসরে।
এভাবে চলতে চলতে জার্মানিতে সে সময়ের আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক সুমন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা হলে; উনি আমাকে নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে বুঝলেন আমি সিগেরেট খাইনা। উনি জিজ্ঞেস করলেন, সাংবাদিকতা করো, লেখালেখি করো; কিন্তু সিগেরেট খাওনা।
উনাকে সৎ ভাবে বললাম, এমনিতে কোন কিছুতেই তেমন নেশা নেই। তাই সিগেরেট খাইনা; তবে খুশিজলের আড্ডায় সামাজিকতা রক্ষায় একটা দুটো সিগেরেটও ধরাই।
সুমনদা বললেন, সর্বনাশ তুমি তো ঠান্ডা মাথায় মানুষ খুন করতে পারবে; এতো সেলফ কন্ট্রোল যার।
এই বলেই একটা বেনসনের কার্টন উপহার দিলেন। এরপর ডয়চেভেলের নাইট শিফটে দীর্ঘ সময় প্রায় জনশূন্য নিউজ রুমে কাজ করতে করতে সিগেরেট বন্ধু হয়ে গেলো।
কিন্তু এসময় গোটা পৃথিবী সিগ্রেটের শত্রু হয়ে পড়ে; যারা সিগ্রেট খায় তাদের ছুঁড়ে ফেলা হয় ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টগুলোর স্মোকিং রুম নামের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের গ্যাস চেম্বারে।
আমি ডয়চেভেলে যে মাসে ছাড়লাম; তার পরের মাস থেকে অফিসে সিগেরেট খাওয়া নিষিদ্ধ হয়ে গেলো পুরোপুরি।
তারপর থেকে পৃথিবীতে কমে গেলো ভালো কবিতা কিংবা উপন্যাসের সংখ্যা। ভালো চিত্রকলা ভালো গান আর কী সেই সিগেরেট যুগের মতো হয়। কিংবা কোন ক্লাস লেকচার কী আর সিগেরেট যুগের মতো মন্ত্রমুগ্ধ করে। সিগ্রেটোত্তর যুগের সম্পাদক কী আর তেমন ঋজু সম্পাদকীয় লিখতে পারেন? উত্তর হচ্ছে না।
আজ সকালে ঘুম ভেঙ্গে দেখি আমার স্ত্রী সিগেরেটের বিরুদ্ধে পত্রিকায় নিবন্ধ লিখে; আমাকে হোয়াটস এপে তার লিংক পাঠিয়েছে।
সিগেরেটের এই “ঘরের শত্রু বিভীষণ” যেন আবার সেই আম্মা যুগের সিগেরেট বিরোধী স্বৈর মনোভাব নিয়ে উপস্থিত। খানিকটা সেই মন খারাপ থেকেই এই স্মৃতিকথার সূত্রপাত।
লেখার শেষে আবার ইন্টারনেট যুগের পলিটিক্যালি কারেক্ট এলগরিদমের মতো লিখি, স্মোকিং ইজ ইনজুরিয়াস টু হেলথ। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।
– মাসকাওয়াথ আহসান
সাংবাদিক, সাংবাদিকতার শিক্ষক
Editor-in-Chief : E-SouthAsia