হতাল (সাঁওতাল) খাল এবং বিপ্লবী সাঁওতাল ও তাদের সন্দ্বীপে আগমন
সন্দ্বীপ টাউনের গোড়া পত্তন হয়েছিল হতাল খালকে কেন্দ্র করে। সাধারণত শহর বন্দর গড়ে উঠে খাল বা নদীর পাড়ে। তবে এ যুগে সমুদ্র সৈকতকে কেন্দ্র করে টাউন শহর গড়ে উঠছে। তবে তা গ্রীস্ম কালে।
হতাল খালের নাম কি ছিল? এমন এক সময় ছিল যখন সন্দ্বীপ থেকে হাতিয়াতে হেঁটে যাওয়া যেত। আগেকার দিনের গল্প শুনতাম বয়বৃদ্ধদের কাছে। হাতিয়া সম্বন্ধে বলতো: ‘হাডি হাডি (হাঁটা) যায় যাওয়া; তারে কয় হাতিয়া’। তারও আগে যখন বর্গীরা কিংবা তারও আগে যখন আরব শেখরা, আওলিয়াগণ বা আরব বণিকরা সন্দ্বীপ এসেছিলেন। তখন এই খালের কি নাম ছিল বা কি নামে ডাকা হতো। তা কে বা জানে?
সন্দ্বীপের আয়তন যখন ঢাকা বিক্রমপুরের ১৫ মাইল দক্ষিনে ছিল বা যখন সন্দ্বীপ বাখেরগঞ্জ ও ভুলুয়ার ভূ অবস্থানের কাছাকাছি ছিল, অথবা ১৮২২ সালের আগে ত্রিপুরা রাজ্যের বর্তমান নোয়াখালী প্রশাসনিক ভাবে আওতাধীন ছিল যখন। তখন (বা তার আগে ও পরে) সন্দ্বীপের এই হতাল খাল প্রোতাশ্রয় হিসাবে ব্যবহৃত হতো। গেইট ওয়ে ছিল। সন্দ্বীপের মেয়ে বর্তমানে ভারতের প্রখ্যাত অধ্যাপক লীলা মুখার্জী তার সন্দ্বীপ গবেষনায় বলেন: ‘Our survey of Sandwip shows that it straddles both categories in its multiple roles: as gateway, as commercial depot, as port, as offensive launch pad, as defensive site and as strategic node.’’
নোয়াখালী লক্ষীপুর ভোলাও বেশি দিন আগের ভূমি ছিল না। বলা হচ্ছে, ওই সব অঞ্চলের বসতি গড়ে উঠেছে সন্দ্বীপ থেকে ও সন্দ্বীপকে কেন্দ্র করে। সন্দ্বীপের এক পাড়ে যেমন ভেঙ্গেছে; অন্য পাড়ে তেমন গড়ে উঠেছে চর। সন্দ্বীপ একটা ফার্টাইল ল্যান্ড ছিল, উর্বর ভূমি ছিল। এই দ্বীপটি ঘিরে ভূরাজনীতি কম হয়নি, যুদ্ধ বিগ্রহও কম হয়নি। বর্তমানেও কম হচ্ছে না, প্রশ্ন উঠে আসছে- সখী তুমি কার? তোমার বুকে জেগে উঠা চরাঞ্চল কার?
কিছু দিন আগে ভদ্রলোকদের এক বৈঠকে আমি বিপাকে পরে গিয়েছিলাম। আমি ১৫০/২০০ বছরকে বলেছিলাম – এইতো সেই দিন। সবায় আমাকে চেপে বসলো। বললো: আমি সময় ও বছর বলতে কিছুই বুঝি না। যখন বৈঠক টা আড্ডায় পরিণত হলো, অর্থ্যাৎ হৈ চৈ শুরু হলো। তখন আমি বললাম: শুনো, আমার দাদা আব্দুল মজিদ তালুকদার ইন্তেকাল করেছেন ১৯৭১ সালে। শুনেছি তখন উনার বয়স ছিল প্রায় ১০০ বছর। আমার আব্বা আলহাজ্ব আলী আহমেদ তালুকদার ইন্তেকাল করেছেন ২৫ জুলাই ২০০০ সালে। (রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বা’ইয়ানি সগীরা)। আমার দাদা থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় ১৫০ বছর, প্রায় ৪ কালের আসাবা। ১৫০ বছর লম্বা সময় হলেও দাদা, আব্বা ও আমি মাত্র ৩ জন মানুষ। আমি আমার দাদাকে দেখেছি অর্থ্যাৎ বলতে পারি গত ১৫০ বছরের ঘটনা প্রবাহ আমার দেখা। একেবারে ফ্রেশ এভিডেন্স। ওরাল হিস্ট্রি।
এই এলাকার জনগণ তখন এই খালকে কি নামে নামকরণ করেছিল। তা জানার আগ্রহ আমার বেড়ে যায়। কেন এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ এই খাল সন্দ্বীপের বুকে প্রবাহিত হয়েছিল। তার নাম কোনো ব্যক্তি বা এলাকার নামে হলো না কেনো? কেনো পরিচিতি লাভ করলো সাঁওতাল খাল, হতাল খাল হিসাবে। তাহলে কে সেই সাঁওতাল।
নিজাম তালুকদার আমার বন্ধু ছিল। মরহুম সুলতান আহমেদ তালুকদারের সুপুত্র এডভোকেট নিজাম। (মহান আল্লাহ যেন তালুকদার চাচাকে বেহেস্ত নসিব করেন)। আমার জানা মতে নিজাম উদ্দিন তালুকদার এখন সন্দ্বীপ আদালতের নামকরা উকিল। টাউনের উত্তরে অবস্থিত আমাদের মূল তালুকদার বাড়ির দক্ষিণ পার্শ্বে ছিল সুলতান তালুকদারের বাড়ি। তারা আমাদের কাছাকাছি পড়শী ছিল, কিন্তু তালুকদার হলেও তাদের ও আমাদের মধ্যে কোন আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল না। তারা ছিল নদী সিকস্তি। সময়ের ব্যবধানে তাদের ও আমাদের মধ্যে এক আশ্চর্য রকমের মিল হয়ে গেল; এখন আমরাও নদী সিকস্তি। কপাল পোড়া সন্দ্বীপের জনগণ পড়শীদের বিরহ ব্যথা বয়ে বেড়াচ্ছে অনবরত। এ যেন বহে নদী নিরবধি। এভাবে আমরা কত বন্ধু বান্ধবকে হারিয়েছি। পুনর্মিলনের আশায় পথ চেয়ে বসে আছি। দেখা হবে তো!
নিজাম ও আমি দুই বন্ধু মিলে একটা এডভেঞ্চারের পরিকল্পনা করলাম। কি আছে সাঁওতাল খালে, কোথায় ছিল হতাল খালের উৎপত্তিস্থল ও কোথায় গিয়ে সাগরের সাথে মিলে মিলনস্থল হলো হতাল খালের। আমরা ২ বার মিলনস্থলে গিয়েছিলাম। দেখবো এবার জগৎটাকে…….।
এই পৃথিবী হলো উত্তরে দক্ষিণে চ্যাপ্টা। কমলার মত। সন্দ্বীপে কমলার গাছ দেখিনি। দেখেছি টেবা। মারাত্মক টক। দেখতে কমলার মতো। সাধারণ মানুষের কাছে হয়তো জগৎ টা হলো ডিমের মত। ‘উম’ বা ‘তা’ দেয়ার পর ডিম্ থেকে বাচ্চা রের হয়ে ভাবে; যেন গোটা পৃথিবীটা তার। এর বাইরে আর কিছু নেয়। সন্দ্বীপের চারিদিকেও অথৈ জলরাশি। আমরাও নদীর পাড়ে গেলে ভাবতাম, সন্দ্বীপ হলো একটা পৃথিবী। অন্যান্য এলাকা অন্য কোন পৃথিবী হবে!
১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে আগস্ট মাসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী সম্রাট শাহ্ আলমের নিকট থেকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানী লাভ করেছিল। সেই থেকে শুরু হয় শোষন, অত্যাচার ও জুলুম। মুদ্রার বিনিময়ে ফসল সংগ্রহ করার নিয়ম, তাদের মধ্যে ঋণ প্রথা চালু, বাকিতে দ্রবাদি বিক্রয়, জমিদার কর্তৃক গরু ও হাতি দিয়ে সাঁওতালদের ফসল নষ্ট এবং তাদের মেয়েদের শীলতাহানি প্রভূতি কারণে সাঁওতালেরা বাধ্য হয়ে শাসকদের ও তাদের তাঁবেদার জমিদার, মহাজনদের বিতাড়িত করে এলাকায় আর্থ সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠা করা ছিল সাঁওতাল বিদ্রোহের মূল লক্ষ্য।
বিপ্লবী সাঁওতাল এ উপমহাদেশের আদিবাসী ছিল। ইংরেজ সরকারের শাসন, শোষনে, অন্যায়-নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে ১৮৫৫সালের ৩০ জুন তারিখে বিপ্লবী সাঁওতাল বিদ্রোহ ঘোষনা করে। এ বিপ্লব দানা বাঁধতে প্রায় ১০০ বছর লেগে যায়। সিঁদু, কানুর, চাঁদ ও ভৈরবের ডাকে ৩০-৫০ হাজার নর-নারী যোগ দিয়েছিল গণ-সংগ্রামে ইংরেজ শাসক, কোম্পানীর কর্মচারি, জমিদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে। ফলে ইংরেজ সরকারের ভিত কেঁপে উঠেছিল সাঁওতালদের সেই মুক্তি সংগ্রামে। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় এই যে, সাঁওতালদের মুক্তি সংগ্রাম পরাজিত হয়েছিল। পরাজয়ের গ্লানি কাঁধে নিয়ে শাসক শ্রেণীর ধর পাকড়াও থেকে নিস্তার পাওয়ায় জন্য হয়তো তারা বিভিন্ন অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিল। সম্ভবত সন্দ্বীপের হতাল খাল তার মধ্যে একটি বসতি ছিল।
ইতিহাস বলছে যে, সাঁওতালরা পূর্তগীজ আমলে দাস প্রথার যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয়েছিল। গুয়া থেকে ম্যাকাও পর্যন্ত পূর্তগীজদের বর্বর আধিপত্য ছিল। মূলত তাদের ৩ টি দ্বীপের প্রতি লোলুপ দৃষ্টি ছিল। গুয়া, সন্দ্বীপ ও ম্যাকাও। সন্দ্বীপকে তারা ধরে রাখতে পারেনি। আমাদের অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধ, ফড়িয়া ফড়িয়া যুদ্ধ, ফড়িয়া ফিরিঙ্গি যুদ্ধ হয়েছে সন্দ্বীপের দখল ও আধিপত্য নিয়ে। রোহিঙ্গারা কিছু কালের জন্য আমাদের লোমহর্ষক অত্যাচার করেছে, দাস বানিয়েছে, নিয়ে গেছে তাদের আস্তানায়, বিক্রি করেছে। জলদূস্য ছিল তারা। মোঘল সুবেদার ও নবাবদের নিস্রংসভাবে হত্যা করেছে। সেই থেকে সন্দ্বীপে জুজুর ভয় দেখাতে ‘হোলা ধরা’ বলে ছেলে সন্তানদের ভয় দেখানো হয়।
আজও রোহিঙ্গাদের আরাকান/রাখাইন অঞ্চলে সাঁওতালদের দেখা মেলে। অন্যদিকে আদিবাসি সাঁওতালরা ধাওয়া খেতে খেতে পশ্চিম বঙ্গের পাশে ঝাড়খণ্ডে গিয়ে ঠেকেছে। আর সমুদ্রপথে আসা সন্দ্বীপের সাঁওতাল খালে বসতি স্থাপন করেছে যারা, তাদেরকে রোহিঙ্গারা নিশ্চিন্ন করেছে।
নদী সিকস্তির পাশাপাশি উপার্জন ক্ষমতা হারানো সাঁওতালরা হতাল খাল থেকে বিদায় নিয়েছে। উজানের পাহাড়ি এলাকার এককালের আদিবাসিরা আবাস গড়েছে সন্দ্বীপের গ্রামে। হিন্দু সম্প্রদায়ের সাথে তাদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের মিল থাকায়, তারা সহজে মূল জনগোষ্ঠীর সাথে একত্রীভূত হয়ে পড়ে। তাদের দৈহিক গড়ন ও চেহেরার অবয়ব ঝাড়খণ্ডের সাঁওতালদের সাথে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তাদেরকে হয়তো দেখতে পাবেন সন্দ্বীপের হাটে বাজারে চুন বিক্রেতা হিসাবে। শামুক ও ঝিনুকের খোসা থেকে চুন বানিয়ে তারা জীবিকা নির্বাহ করে। পান সুপারির সাথে (শামুক/হামুক) চুন মিশিয়ে বাহারি ঠোঁট রঙিন করে গৌরীরা। এই চুনে ঔষধী গুনাগুনও আছে।
সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোক বংশপরম্পরায় নদী ও ডাঙ্গায় বাস করতো। সিলেটের সুরমা থেকে সাতক্ষীরার ইছামতি, পঞ্চগড়ের করতোয়া থেকে টেকনাফের নাফ নদী। হিমালয় থেকে সুন্দরবনের মাঝে যত খাল নদীতে আদিবাসি মানুষের বসতি ছিল; তার বেশিরভাগই এখন জনশূন্য। জসিমউদ্দিনের সুজন বাদিয়ার ঘাটের আলতা বিক্রেতাদের ফিল হাল চোখে পড়ে না। জীবনানন্দ দাশের ধানসিঁড়ি এখন মরা খাল।
ঐতিহ্যবাহী হতাল খাল এখন নদী সিকস্তিতে বিলীন স্মৃতি ভরা এক অতীতের নাম।
স্মৃতিচারণে: শিব্বীর আহমেদ তালুকদার
আইনজীবী, সমাজ সংগঠক ও কথ্য ইতিহাস গবেষক।
sandwip21st@gmail.com
বাংলাদেশ সময় সকাল ৯ টা, তাং: রোববার, ৩১/৫/২০ইং।
———
আশা করি, এই পর্বটি আপনাদের ভালো লেগেছে। লাইক ও কমেন্টের মাধ্যমে মতামত দিবেন, প্লিজ। ফলে ভুল শুধরে নিতে পারবো। আর এই পোস্টটি শেয়ার করে নিন আপনার অনলাইনের সোশ্যাল বন্ধুদের মাঝে। যাতে আগামী পর্ব থেকে উনারাও সরাসরি এই স্মৃতিচারণের সাথে যুক্ত হতে পারেন। সন্দ্বীপকে নিয়ে নস্টালজিয়া ও কেতাদুরস্ত সন্দ্বীপিয়ানা স্মৃতিচারণমূলক পরবর্তী পর্বের উপর ‘চোখ রাখুন’ – আগামী রোববার ৭/৬/২০ইং, সময়: সকাল ৯ টা: পর্ব নং ৫, পোস্ট হবে ইনশাআল্লাহ।
শিরোনাম থাকবে: কার্গিল হাই স্কুল।
আশা করি আপনাদের ভালো লাগবে। ধন্যবাদ