যারা এসএসসি পাশ করেনি
যারা এসএসসি পাশ করেনি; তারা কখনো মানুষের ক্ষতি করেনি। যারা এসএসসি পাশ করেনি; তারা কখনো ঘুষ খায়নি; ঋণখেলাপি হয়নি, শেয়ার বাজার বা ব্যাংক লুট করেনি, কুইক রেন্টাল নামের বিদ্যুৎ কেন্দ্র ভাড়া নিয়ে কোন বিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়াই হাজার কোটি টাকা তুলে দেয়নি বেয়াই-বাদল-দীনেশের হাতে।
যারা এসএসসি পাশ করেনি; তারা রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসায়নি; সুন্দরবন হত্যার কথা তাদের মাথাতেও আসেনি। তারা রূপপুরের পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করে চলনবিলকে চেরনোবিলের মতো পুড়িয়ে খাক করে দেবার মাস্টার প্ল্যান হাতে নেয়নি।
আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে; যারা এস এস সি পাশ করেনি তারা রূপপুরে হীরকমূল্যে বালিশ বেচেনি; দালান ঢালাইয়ে বাঁশ দেয়নি রডের পরিবর্তে; রেললাইনে লোহার পাতের জায়গায় বাঁশ দেয়নি।
যারা এসএসসি পাশ করেনি; তারা ব্যাংক লুট করে বিদেশে টাকা পাচার করেনি; সেকেন্ড হোম গড়েনি; করোনাকালে স্পেশাল বিমান ভাড়া করে সেকেন্ড হোমে চলে যায়নি।
যারা এসএসসি পাশ করেনি তারা একাত্তরে রাজাকার হয়নি; তারা লুঙ্গি পরে মুক্তিযুদ্ধে গেছে; তারামন বিবির মতো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছে। তারপর মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে এসে নীরবে দেশগড়ার কাজ করেছে।
যারা এস এসসি পাশ করেনি; তারা ইতিহাস লেখেনি; তাই ইতিহাসে তাদের নাম লেখা থাকেনি; জ্ঞানী গুনী মানুষের ভীড়ে তাদের কথা কেউ মনে রাখেনি। যেহেতু তারা এসএসসি পাশ করেনি; তাই তাদের সন্তানেরা শহীদ কৃষকের সন্তান বলে মিডিয়ার ক্যামেরা-লাইট-বুম পায়নি।
যারা এসএসসি পাশ করেনি; তারা আল্লাহর ম্যানেজার হতে চায়নি; ফসলের মাঠের আলে গামছা পেতে নামাজ পড়ে ভালো ফসলের প্রার্থনা করেছে।
যারা এসএসসি পাশ করেনি; তারা বাটপারি শেখেনি; ” শাসক শোষক-পরিতোষক-স্থূল সৌন্দর্য ধারক”-দের মতো ধর্ম-রাজনীতি-সংস্কৃতি নিয়ে ভাটের আলাপ শেখেনি।
যারা এসএসসি পাশ করেনি; তারা কখনো স্যার ডাক শুনতে পায়নি; গ্রামের যে ছেলেটি এসএসসি পাশ করেছিলো; তাকে মিষ্টি খাইয়েছিলো যারা; সে একদিন বড় সাহেব হয়ে গ্রামে ফিরে এলে, স্যার ডেকেছে তাকে। তার সানগ্লাস পরা-চুল ফোলানো স্ত্রীকে ম্যাডাম ডাকতে শিখতে হয়েছে।
যারা এসএসসি পাশ করেনি তারা ফেসবুকে আসতে পারেনি; ফলে তারা সহমত ভাই হতে পারেনি; দেশপ্রেমের ঠিকাদারি নিতে পারেনি; “দালালের নিত্যতা সূত্র অনুযায়ী দালাল অবিনশ্বর; দালাল ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন রূপে জগতে ফিরে আসে; কিন্তু তাদের মোট সংখ্যাটি একই থাকে”। এসএসসি পাশ না করলে ধর্ম-রাজনীতির দালাল হওয়া যায়না; ফলে তেলের বিনিময়ে গাড়ি-বাড়ি-ভুড়ি পাওয়া যায়না।
এসএসসি পাশ করেনি তারা; তাই কীটো ডায়েট বা এটকিনস ডায়েটের প্রয়োজন তাদের পড়েনি। যারা এসএসসি পাশ করেনি; তারা বেঁচে গেছে।
এসএসসি পাশ করা মানে; বাটপার বিদ্যা লাভের দিকে এগিয়ে যাওয়া। দক্ষিণ এশিয়ায় সংস্কৃত-আরবি শিখেছিলো যারা; তারা কোন কাজ না করে যারা কাজ করে তাদের চেয়ে বিলাসব্যাসনে সারাজীবন কাটিয়ে দেবার বাটপারি কৌশল শিখেছিলো। এরাই কাস্ট সিস্টেম বা মানুষের শ্রেণীবিভাগ তৈরি করেছিলো।
আজো বাটপার বিশ্ববিদ্যালয় তাই ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা দেয়; যারা কাজ করে তাদের ম্যানেজার হয়ে কোন কাজ না করে আরামে আয়েশে সারা জীবন কাটানোর কলা।
শিক্ষা মানে পৃথিবীর নানা বিষয়ে জ্ঞান লাভ; আর এই জ্ঞান প্রয়োগ করে মানবতা ও নিসর্গের কল্যাণের মাধ্যমে শিক্ষার প্রাপ্তিটুকু ফিরিয়ে দেয়া।
যারা এসএসসি পাশ করেনি; তারা জীবনের স্কুল থেকে প্রতিদিন যা শেখে; সেই শিক্ষা জীবন আর মানবতাকে ফিরিয়ে দেয়। এ কারণেই এসএসসি পাশ না করা কৃষক বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে; প্রবাসী শ্রমিক আর সেলাই শ্রমিকেরা তাদের পরিবার ও রাষ্ট্রের পোষণের দায়িত্ব নেয়।
যারা এসএসসি পাশ করে বিশ্ববাটপারিবিদ্যার অধিনায়ক হয়; তাদের লক্ষ্য একটাই কোন কায়িক পরিশ্রম না করে; শুধু ওপরে ওপরে থাড়ুদারি করে মোটা বেতন বা মুনাফা নেয়া।
যারা এসএসসি পাশ করে; তারা আসলে কেরানি আর মিডলম্যান; এরা কিছুটা পড়তে আর লিখতে জানে। ঐটা ভাঙ্গিয়ে এরা ওয়ারেন অফ প্রিসিডেন্স, প্রোটোকল ইত্যাদি রচনা করে। এটা সেই সংস্কৃত বা আরবি জানা লোকেদের মতোই কোন কাজ না করে চর্বি জমানোর হেজিমনি।
যারা এসএসসি পাশ করেনা; তারা স্থুতি ইতিহাস, স্থুতি কবিতা, স্থুতি মানপত্র লিখতে শেখে না; ফলে তারা কোন ব্যাংক লাইসেন্স-পদক বা পদ পায়না।
তাই যারা এসএসসি পাশ করেনা, তাদের জন্য করোনাকালে মেডিকেল বোর্ড, আইসিইউ বা ভেন্টিলেটর নেই; নেই সিএমএইচ কিংবা ইউনাইটেড বুটিক হাসপাতাল। এমনকী তার জন্য নেত্রকোণার কোন গ্রামের হাসপাতালও নেই। সে যে নরোত্তম; তাই হাসপাতালের সামনের মাঠে সে প্রণাম বা প্রার্থনার ভঙ্গিতে মাটিতে মাথা ঠেকালে; তার বিশুদ্ধ আত্মাটি পাখি হয়ে আকাশে উড়তে থাকে।
যারা এসএসসি পাশ করেনা; তারা এফলুয়েন্সের মানে জানে না; পট কইরা চেক ইন দিয়া; ভেটকি দেয়া সেলফি দিতে জানেনা; দেশ উদ্ধার করা মধ্যস্বত্বভোগী দালালদের পিঠাপুলি আসরে দাওয়াত পায়না।
তারতো নবান্ন উৎসব আছে, রথের মেলা আছে, নৌকাবাইচ আছে, বাউল গান আছে; পালাগানের সাঁঝ আছে; পিঠাপুলির সেই গল্পের গাছ আছে।
যারা এসএসসি পাশ করেনা; তাদের সুখ আছে। কারণ যতক্ষণ শারীরিক পরিশ্রম আছে; ততক্ষণ ঘুম আছে; ঘুমের দেশে রূপকথার স্বপ্ন আছে; যে এসএসসি পাশ করেনা; সে সুজনের সখি আছে। ঝর্ণার মতো সরলতার প্রেম আছে; মায়া আছে। এসএসসি পাশ না করলে ইনসমনিয়া, ডিপ্রেশন, হ্যাং ওভার, হেডেক, বাইপোলার ডিস অর্ডার, পোস্ট ট্রমাটিক ডিজ অর্ডার, ওসিডি ইত্যাদি ঘোড়া রোগ থাকেনা।
তাই যে এসএসসি পাশ করেনি; সে অনুতাপহীন গভীর ঘুমে রাজপুত্তুর হয়ে ঘোড়ায় চড়ে; সে তো কোন অপরাধ করেনি; প্রকৃতিকে বিনাশ করেনি, দেশলুন্ঠন করেনি, স্বাস্থ্য-খাতের কাছিম কমিশন খায়নি, গুম করেনি, ক্রসফায়ার করেনি; ডিজিটাল আইন প্রণয়ন করেনি; দলীয় নরভোজ প্রকল্পের হিংস্র দানব হয়নি; জঙ্গি জিঘাংসার চাপাতি রাক্ষস সে হয়নি; সে ত্রাণের টাকা চুরি করেনি; সুতরাং নির্দোষ সে জীবন নিসর্গের ভালোবাসায় ঠাসা।
যারা এসএসসি পাশ করেনি; তাদের শত্রু ধর্ম-রাজনীতির মিডলম্যানেরা, উন্নয়নের ফড়িয়ারা; জীবিকার নামে যারা জীবন হত্যার ঠগী নীতি নির্ধারক অথবা ব্যবসায়ীরা। জীবিকার নামে মাংসের কারবারে স্বৈরশাসকেরা যখন নরখাদক হয়ে ওঠে; তখন জীবন বিপন্ন হয়। যারা এসএসসি পাশ করেনি তাদের সুখের জীবনে সাপ হয়ে ঢোকে উন্নয়নের হাতুড়ি; জিডিপির হেলমেট।
– মাসকাওয়াথ আহসান
সাংবাদিক, সাংবাদিকতার শিক্ষক
Editor-in-Chief : E-SouthAsia