কার্গিল হাই স্কুল (২)
সন্দ্বীপে ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠার সাথে যাঁরা জড়িত ছিলেন; তারা স্কুলের নামকরণ করলেন ‘সন্দ্বীপ কার্গিল হাই স্কুল।’ স্থাপনার তারিখ হলো ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯০২ খ্রিস্টাব্দ। কিন্তু ১৮৭৯ সালের ১২ এপ্রিল পুরানো সন্দ্বীপ শহরে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা ১২ জন শিক্ষার্থী নিয়ে একটি মাইনর স্কুল শুরু করেছিলেন। ওই সবেধন নীলমনি মাইনর স্কুলটি পরে কার্গিল হাই স্কুল নাম ধারণ করে। কমরেড মুজাফ্ফর আহমেদ, কাকাবাবু স্মৃতিচারণ করেছেন এইভাবে:
“সবেধন নীলমনি ছিল সন্দ্বীপ মধ্য ইংরেজি স্কুল। শুনেছি এটিও আগে বাঙলা স্কুল ছিল।“
মন্জুর ও আমি চিন্তা করতে লাগলাম। তাহলে সবেধন নীলমনির আগে কি, কোনো স্কুল ছিল না। আমাদের পর্বপুরুষগণ কি শিক্ষিত ছিলেন না। আমরা বই খুঁজতে লাগলাম। কার্গিল হাই স্কুল প্রতিষ্ঠার পূর্বে কোনো প্রতিষ্ঠান ছিল কিনা। তা দেখার জন্য সন্দ্বীপ টাউনের কলাভবনে বই খুঁজতে গেলাম। তখন কলাভবনের লাইব্রেরী থেকে বই ধারে পড়া যেত ও পাঠকক্ষেতে বসে পড়া যেত। হাতে দু’একটা বই থাকলে টাউনের মুরুব্বি শ্রেণীর লোকজন বেশ সমীহ করতেন। কোন ক্লাসে পড়ছো, কি পড়ছো ইত্যাদি জেনে নিজের ছেলেমেয়েদেরকে মোটিভেশন লেকচার দিতেন। পড়ুয়া ছেলে মেয়েদের কদরই ছিল আলাদা। মুরুব্বিদের স্নেহ মমতা কে না আশা করে, বলুন!
সন্দ্বীপের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দুই ভাগে ও নামে বিভক্ত ছিল। হিন্দু শিক্ষার্থীর জন্য টোল আর মুসলিম শিক্ষার্থীর জন্য ছিল মাদ্রাসা। টোলে ধর্মশাস্ত্র, পুরান, দর্শন, নীতিশাস্ত্র, ব্যাকরণ, সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে পাঠদান হতো। আর আরবী-ফার্সী মাদ্রাসাগুলোর অবস্থান ছিল সাধারণত মসজিদের পাশে বা মসজিদে। মাদ্রাসায় ধর্মতত্ত, ইতিহাস, ফারায়েজ-গণিত, অর্থনীতি, নীতিশাস্ত্র, দর্শন প্রভৃতি বিষয় পাঠ্যভুক্ত ছিল।
মাদ্রাসার অধিকাংশ শিক্ষক ছিলেন মুসলমান। তবে ফার্সী শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে হিন্দু শিক্ষকও ছিলেন। সে সময়ে সরকারি ভাষা ফার্সী ছিল বলে চাকুরীর জন্য হিন্দু কায়স্থরা ফার্সী ভাষা শিখত।
সন্দ্বীপের অপেক্ষাকৃত অবস্থাশালী ও ধনাঢ্য ব্যক্তিরা এই অবৈতনিক শিক্ষার জন্য আর্থিক সহায়তা দান করতেন। দূরাগত শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষকগণ নিজ ও অন্যদের গৃহে থাকার ও খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। ইহা জায়গীর ও লজিং নামে পরিচিত ছিল। শিক্ষকবৃন্দ নিজগৃহে বা ধনী ব্যক্তিদের বৈঠকখানায় বা চন্ডীমন্ডলে পাঠদান করতেন।
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাবের পতন, ১৭৬৫ সালে বক্সারের যুদ্ধে ও ১৭৬৭ সালে সন্দ্বীপ যুদ্ধে, বিলাতীদের জয়ের মাধ্যমে এলাহাবাদ চুক্তির ভেতর দিয়ে ভারতবর্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন শুরু হয়। মুঘল শাসকদের অনেক বছর রাজত্বের করার ফলে এই অঞ্চলে আরবি আর ফার্সি ভাষা প্রচলিত ছিল। এমনকি আদালত আর দপ্তরের প্রধান ভাষা ছিল ফার্সি। আর সন্দ্বীপে হিন্দু মহাজন, জমিদার ও হিন্দু জন সংখ্যার বসবাস উল্লেখ করার মত ছিল। তাই এ এলাকায় সংস্কৃত ভাষার চর্চাও প্রচলিত ছিল।
প্রাক-ঔপিনেবিশক সন্দ্বীপে ‘পড়া-শুনা’ এবং ‘লেখা-পড়া’ করার জন্য বাড়ি বা এলাকা ভিত্তিক ব্যবস্থা ছিল। বাড়ির সামনে টং এ, বড় গাছের নিচে, মেয়েদের জন্য বাড়ির আঙিনায় ‘পড়া-শুনা’ এবং ‘লেখা-পড়া’ করার ব্যবস্থা ছিল। তখন আজকের দিনের মত বই খাতা সমেত লেখা-পড়া ছিল না। ছিল পড়া-শুনা। ছন্দ দিয়ে কবিতার মত করে পড়া-শুনা হতো। খনার বচন দিয়ে অঙ্ক পড়া হতো। অঙ্ক কষা হতো না। মুখে মুখে ও হাতের কড়ের সাহায্যে অঙ্ক করা হতো। নীতিবাক্য পড়ানো হতো। কলা পাতা ও মাটিতে এঁকে এঁকে লেখা পড়া হতো। মাটির স্লেটের প্রচলন এর পর হতে থাকে। পন্ডিত মশায় ও হুজুর মুখস্ত পড়াতেন। তাই আমরা অনেক সময় জিজ্ঞাসা করি,পড়া-শুনা করছো? বা লেখা-পড়া করছো? কদাচিৎ জিজ্ঞাসা করা হয়, কোন ক্লাসে পড়?
বাঙলায় পর পর ৩ টি যুদ্ধে হেরে যাওয়ার পর সন্দ্বীপী ও বেনিয়াদের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের জন্য ভাষা জ্ঞান অপরিহার্য হয়ে পড়ে। স্বাভাবিকভাবেই কোম্পানির ব্যবসায়ীরা এমন কাউকেই তাদের অধীনে কর্মচারী হিসেবে চাইবে যারা তাদের ভাষা বুজতে পারে। এক্ষেত্রে ইংরেজি একটি মুখ্য ও বিজয়ী ভাষা হয়ে দাঁড়ালো। আর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও প্রশাসনিক কার্য ভালভাবে চালানোর জন্য স্থানীয় লোকেদের মুখের ভাষায় দক্ষ হওয়াটাকেও গুরুত্বের সাথে নিতে লাগলেন। কিন্তু বেনিয়ারা সংখ্যায় ছিল কম। মাত্র ১৮০ জন ইংরেজ গোটা বেঙ্গলকে শাসন করতে লাগলো।
শিক্ষার প্রসারে খ্রিস্টান মিশনারীরাও বাংলার অন্যান্য এলাকায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে । কিন্তু সন্দ্বীপে মিশনারীর তেমন খবর মিলে না। ইংরেজরা যখন পাকাপোক্তভাবে বসে গেছে ও ডিভাইড এন্ড রুল নীতি প্রয়োগ করতে লাগলো। তখন আমরা নিজেদের মধ্যে বিভেদ শুরু করি ও তারা আমাদের শাসন করতে থাকে। বানরের রুটি বন্টন করার মত।
সন্দ্বীপে কোর্ট কাচারী প্রতিষ্ঠা লাভের পর ইংরেজি স্কুলের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে বিক্রমপুরী আদিপত্যকে কেন্দ্র করে। ১৭৮১ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস কলকাতায় একটি মাদ্রাসা স্থাপন করেন যেখানে সাধারণত প্রথমদিকে শরীয়া-আইন কানুন, আরবি আর ফার্সি ভাষায় শিক্ষাদান করা হতো। পরে জোনাথান ডানকান ১৭৯১ সালে সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন যেখানে সাধারণত হিন্দুদের রীতি নীতি, দর্শন আর সংস্কৃত ভাষার উপরেই জ্ঞান দান করা হতো। ১৮০০ সালে লর্ড ওয়েলেসলি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের দেশীয় ভাষা ও আদবকায়দা শেখানোর উদ্দেশ্যে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ চালু করেন। এরপর ১৮১৭ সালে ডেভিড হিউম কলকাতা হিন্দু কলেজ স্থাপন করেন। ১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। নারীদের জন্য কলকাতায় গড়ে উঠে বেথুন কলেজ। তাঁদের এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু রাখার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল কম-মাইনেতে ইংরেজি-শিক্ষিত কেরানির দল তৈরি করা।
ঠিক সে সময়ে অন্যান্য এলাকার মত সন্দ্বীপে দুই শ্রেণির লোকের আবির্ভাব ঘটে। এক শ্রেণির চাইত যে, শিক্ষাদান নিজ নিজ অঞ্চলের মাতৃভাষা, আরবি, ফার্সি আর সংস্কৃত ভাষার মাধ্যমেই হোক। তাদেরকে বলা হয় প্রাচ্যবাদী যারা ভারতীয় সংস্কৃতিকে ধরে রাখাই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য বলে মনে করতেন। অন্য শ্রেণীর হলেন পাশ্চাত্যবাদী যারা ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানকে প্রাধান্য দিতেন। এদের অনেকেই পাশ্চাত্যের শিক্ষা সংস্কৃতিকে প্রাচ্যের তথা ভারতীয় উপমহাদেশের শিক্ষা সংস্কৃতিকে বড় করে দেখতেন। অনুদানের ক্ষেত্রেও পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যবাদীদের মধ্যে পক্ষ বিপক্ষের শিবির তৈরী হলো। নিজেদের মধ্যে ডিভাইড এন্ড রুল শুরু হলো।
যাঁরা পাশ্চাত্যের শিক্ষা সংস্কৃতিকে প্রাচ্যের তথা ভারতীয় উপমহাদেশের শিক্ষা সংস্কৃতির চেয়ে বড় করে দেখতেন। তাঁরা খুশি হলেন। কারণ ১৮৩৫ সালে ইংরেজি ভাষাকে ভারতের উচ্চশিক্ষার একমাত্র মাধ্যম হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এর পর অবশ্যই পরিবর্তন আসে। যখন ১৮৫৪ সালে ‘উড’স ডেসপ্যাচ অন এডুকেশন’ প্রকাশিত হয়। প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চস্তর পর্যন্ত শিক্ষার একটি যুক্তিসঙ্গত পাঠক্রম প্রকাশ করেন। যাতে প্রাথমিক স্তরে, মাধ্যমিক স্তরে এবং উচ্চশিক্ষা স্তরে কি পড়ানো হবে। তা বলা হয়। উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসাবে ইংরেজি এবং প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্থানীয় ভাষাকে গ্রহণ করা হয়।
১৮৩৫ সালের পর বাঙলায় ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে অনেক স্কুল কলেজ নির্মিত হয়। বিভিন্ন এলাকায় সমষ্টিগত উদ্যোগে গড়ে উঠে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ব্রিটিশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া মাতৃভাষাতেই শিক্ষাদান চলতে থাকে। সন্দ্বীপে ইহার প্রভাব আসে ১৮৭৯ সালে। অধুনালুপ্ত সন্দ্বীপ টাউনের আদালত প্রাঙ্গনে জীর্ন শীর্ন কুড়েঘরে `সবেধন নীলমনি` নামের বাঙলা স্কুলটি অনুদান লাভের আশায় রূপান্তরিত হলো কার্গিল হাই স্কুল নামের ইংরেজি স্কুলে। টাউনের দক্ষিণে ও পোলঘাট সংলগ্ন ৫ একর জমির উপর নির্মিত হলো ইংরেজি শিক্ষিত শ্রেণী তৈরী করার কাজ যাঁরা বিক্রমপুরীদের আধিপত্য রোধে ভূমিকা নিতে সমর্থ হয়েছিল ও দেশে-বিদেশে অনবরত অবদান রেখে চলেছে।
সন্দ্বীপে এইভাবে মাতৃভাষায় জ্ঞান চর্চা বাড়তে থাকে ও ইংরেজি ভাষায়ও দক্ষতা বাড়তে থাকে। পরে অবশ্যই ব্রিটিশদের অনুদানে কয়েকটি স্কুল প্রতিষ্ঠা লাভ করে। আর এভাবে সন্দ্বীপের একমাত্র অবলম্বন সবেধন নীলমনি সন্দ্বীপ কার্গিল হাই স্কুল নামে রূপান্তরিত হয়ে জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চায় প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদী সমাজের যোগ সূত্র তৈরী করে।
প্রাক ইংরেজ ঔপনিবেশিক আমলের আরবী ও মুঘলদের প্রয়োজনে সৃষ্ঠ আরবী ফার্সি ও ধর্মীয় ধারার বাহক এবং ইংরেজদের কর্মচারী জন্য ১৭৮১ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসার লিগ্যাসি হিসাবে সন্দ্বীপে প্রতিষ্ঠা লাভ করে বশিরিয়া আহমদিয়া (আলহাজ্ব আবু বকর ছিদ্দিক) ফাজিল মাদ্রাসা। স্থাপিত ১৯০২ সাল এবং একই সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে কার্গিল হাই স্কুলও ।
ফলে প্রাচ্য, প্রাশ্চাত্য ও ধর্মীয় ভাবধারায় বিশাসীদের মধ্যে কোনো রকমের বিভেদ তৈরী হয় নি; ঐক্যই ছিল সন্দ্বীপের একমাত্র সামাজিক বন্ধন।
স্মৃতিচারণে: শিব্বীর আহমেদ তালুকদার
আইনজীবী, সমাজ সংগঠক ও কথ্য ইতিহাস গবেষক।
sandwip21st@gmail.com
বাংলাদেশ সময় সকাল ৯ টা, তাং: রোববার, ১৪/০৬/২০ ইং।
—————-
আশা করি, এই পর্বটি আপনাদের ভালো লেগেছে। লাইক ও কমেন্টের মাধ্যমে মতামত দিবেন, প্লিজ। কোনো রকমের তথ্য বিভ্রাট হলে ইনবক্সে ম্যাসেজ দিবেন বা ইমেইল করবেন। ফলে ভুল শুধরে নিতে পারবো। আর এই পোস্টটি শেয়ার করে নিন আপনার অনলাইনের সোশ্যাল বন্ধুদের মাঝে। যাতে আগামী পর্ব থেকে উনারাও সরাসরি এই স্মৃতিচারণের সাথে যুক্ত হতে পারেন। সন্দ্বীপকে নিয়ে নস্টালজিয়া ও কেতাদুরস্ত সন্দ্বীপিয়ানা স্মৃতিচারণমূলক পরবর্তী পর্বের উপর ‘চোখ রাখুন’।