বুয়েটের উপাচার্য নিয়োগের পর যার মাথায় এ প্রশ্ন আসবে; উনি কী হিন্দু নাকি মুসলমান; তার জানা প্রয়োজন শিক্ষা ও শিক্ষকের কোন ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-দল নেই; শিক্ষা নিজেই সত্য-সুন্দর-কল্যাণের সাগর।
সারাক্ষণ লোকটা হিন্দু না মুসলমান, আওয়ামী লীগ না বিএনপি এই রকম পিং পং চিন্তা করতে করতে বৃদ্ধ বয়সে মাথাটা টিং টিং করে নড়তে থাকে। ডিম-এর ওপর মুখ এঁকে তা স্প্রিং-এর ওপর রাখলে ঠিক যেমন টিং টিং করে নড়ে।
এটা অনস্বীকার্য যে বাংলাদেশই পৃথিবীর একমাত্র দেশ; সেখানে শিক্ষক হতেই ক্ষমতাসীন দলে নাম লেখাতে হয়; উপাচার্য “ছা-ছপ-ছমুছা”-কে শিক্ষার মান পরীক্ষার সূচক বলে ভাবেন; উপাচার্য যুবলীগের দায়িত্ব নিতে চান; শিক্ষক ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডারের মতো মারপিটে নেমে পড়ে। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসেনারা; হলের মধ্যে টর্চার সেল খুলে “চেতনা টেস্টিং কিট” দিয়ে নিরাপরাধ ছাত্র খুন করলে; হলের ও ছাত্রকল্যাণের দায়িত্বে নিয়োজিত শিক্ষকেরা অস্ট্রিচের মতো বালিতে মুখ গুঁজে দুই কানে তুলা দিয়ে ছাত্রের মৃত্যুর আর্তনাদ না শোনার ভান করেন। ধামাচাপা দিতে চেষ্টা করেন নিজ দলীয় ছাত্রসেনাদের অপকর্মগুলো।
এরকম রাজাকার শিক্ষক আমরা একাত্তরে দেখেছি; যারা জগন্নাথ হলে ছাত্র-হত্যার রিরংসায় খুনে পাকিস্তানি সেনাদের পথ দেখিয়েছিলো; সবচেয়ে ভালো শিক্ষক; যারা ভালো পড়ান; তাদের কালো তালিকা করে খুনেদের হাতে তুলে দিয়েছিলো।
স্বাধীন বাংলাদেশের ভাগ্যেও এমন নিওরাজাকার শিক্ষক জুটেছে। যারা ছাত্র খুনের পর নিজের পছন্দের খুনিকে পুলিশ এজাহার থেকে মুক্তি দিতে “এই কাদের সেই কাদের নয়”-এর মতো বুদ্ধি খাটায়। কেন এই পাপের ইতিহাস ফিরে ফিরে আসে এই অভিশপ্ত জনপদে! কী পাপ করেছিলাম আমরা সাধারণ মানুষ যে আমার সন্তান লাশ হয়ে ফেরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
সেইরকম একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিন্দু নাকি মুসলমান এ প্রশ্ন অমূলক; লোকটা আদৌ মানুষ কীনা সেটাই এখন মূল প্রশ্ন।
আমাদের মাথার ভেতরে এই ধর্ম-গোত্র-দলের আত্মপরিচয়ের পাতকূয়াটিই আমাদের জীবনকে অপরিবর্তনীয় ট্র্যাজেডির বিষাদ সিন্ধু করে তুলেছে।
রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা কপালে টিপ পরবেন কীনা; উনি রবীন্দ্র ভক্ত হবেন কীনা; সেটা তাঁর একান্ত নিজস্ব বিষয়। কাউকে ধর্ম বা সংস্কৃতির ম্যানেজার বানানো হয়নি; সে এসে ঈমান-আকিদার চেকপোস্ট বসিয়ে জিজ্ঞাসিবে, কপালে টিপ কেন?
পাতকূয়ার জরিমনকে অমন করি হাঁটিও না বিবি; মাটিয়ে কষ্ট পাইবো টাইপের মাছলা-মাছায়েলের ফতোয়া দিয়ে দিয়ে; এখন যদি মনে হয়; ফেসবুকে এসে নারী কী পোশাক পরবে, কপালে টিপ দেবে কীনা; এসব ফতোয়া দেয়া যাবে; সেটা ভুল ভাবনা। ফেসবুক ছাগল নাইয়ার পাতকূয়া না; হাট হাজারির কলতলা না; ফেসবুক হচ্ছে পৃথিবীর আকাশ; ২৪ ঘন্টা জেগে থাকা জীবনানন্দের নগরী।
নিজের “গ্রাম্যতা নিজের পাতকূয়া”-তে রেখে; ফেসবুকে আসতে হবে বিশ্বসংস্কৃতির বহু রঙ এর সৌরভ মাখতে; মানুষের জন্য মানুষের ভালোবাসার কল্যাণ চিন্তা খুঁজতে। কেউ যদি গ্রাম্য মাতবরি ঝেড়ে ফেলতে না পারে; আগামিটা তার জন্য দুনিয়াতেই দোজখ।
রেজওয়ানা চৌধুরী রাজ সংগীত শিল্পী হিসেবে রাজকীয় সংগীত বিদ্যালয় গড়ে তুললেও; সংগীতে তাঁর যে সামর্থ্য তা তাঁকে সংগীত প্রিয়দের কাছে আদৃত করেছে।
বাংলাদেশে অর্থের দৈন্য তো নেই; কিন্তু মানসিক দৈন্য শুরু হয়েছে একবিংশ শতকে। এখানে “ক্ষমতা-কাঠামো”-র অভিজ্ঞান ছাড়া কবিতা কবিতা হয়না, গান গান হয়না। জীবনের উচ্চ নম্বরের সিঁড়ি হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের আশীর্বাদ। সে আপনি উপাচার্য হতে চান, গান গাইতে চান কিংবা পাপলু-পাপিয়া যা-ই হতে চান। পাপের সঙ্গে সম্পর্কিত যা কিছু; তার সঙ্গে দিনবদলের পাপাচার্য জড়িত।
রাজা-বাদশাদের আমলেও দু”রকম সুফি ছিলো; লাল ও সবুজ সুফি। লাল সুফিরা রাজা-বাদশাহর পরোয়া করতো না। লালন-কবির-বুল্লে শাহ যেমন সার্বভৌম শিল্পী ছিলেন। তারা তো দার্শনিক রাজা; দার্শনিক রাজা কী কখনো যায় রাজার গৃহে ভিক্ষা চাইতে! নাহ তা তারা কখনো করেনা। তারা গ্রিক দার্শনিক ডিয়োজিনিজের মতো শাক-পাতা খেয়ে সার্বভৌম চিন্তার স্বাধীনতা ধরে রাখে। তারা রাজার অনুদান ফিরিয়ে দেয়।
সেইকালে আর ছিলো সবুজ সুফি; এরা রাজা-বাদশাহ’র সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। তাদের কারো নাম আমার মনে নাই। আপোষের গান-কবিতা হয়তো মরে যায়; তাই আমার মতো পাঠক শ্রোতার কাছে শিল্পের মৃতদেহের কোন মূল্য নেই।
– মাসকাওয়াথ আহসান
সাংবাদিক, সাংবাদিকতার শিক্ষক
Editor-in-chief, E-SouthAsia