গবেষণা বিষয়ক কিছু কথা:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে পড়ার সময় সন্দ্বীপের নদী ভাঙ্গন ও উন্নয়নবিষয়ক অনেক সভা সমিতিতে উপস্থিত থাকতাম। কখনও কথা বলতাম আবার কখনো তাদের কথাগুলো মন ভরে শুনতাম। সন্দ্বীপকে নিয়ে তখন আমাদের অনেকেই বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখা-লেখি করতেন। আমিও লিখতাম তখন বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকীতে। বলতে গেলে সন্দ্বীপকে নিয়ে এলাকাভিত্তিক কম বেশি অনেক লেখা ও গবেষনা হয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিকমন্ডলে সন্দ্বীপকে নিয়ে বলতে গেলে কোনো গবেষণাই হয়নি। বিশেষ করে একাডেমিক্যালী বা উন্নত বিশ্বের কোনো নামি-দামি বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্দ্বীপের নদী ভাঙ্গন নিয়ে কোনো গবেষণা আমার চোখে পড়েনি। আমি ভেবেছি, যদি কখনো আমার উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশ যাওয়া হয়, তখন হয়তো সন্দ্বীপের নদী-ভাঙ্গন, বাস্তহারা মানুষদের পূণর্বাসন ও গ্রামীণ গরিব-দুঃখী মানুষদের ক্ষমতায়ন ও ভাগ্য উন্নয়নে আন্তর্জাতিক মানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করবো যা হবে মূলত পলিসি বা পরিকল্পনা ভিত্তিক।
তারই ফলশ্রুতিতে প্রায় পনের বছর আগে সন্দ্বীপের নদী ভাঙা ও বাস্তুহারা জনপদের (আইডিপি) ক্ষমতায়ন নিয়ে আমিআন্তর্জাতিকভাবে কানাডার কনকোর্ডিয়া ইউনিভার্সিটিতে পাবলিক পলিসি ল্যাবে ১৩৮ পাতার একটি থিসিস রচনা করি। আমার থিসিসের শিরোনাম হল: Empowering internally displaced persons (IDPs): a case study of Sandwip (an island of Bangladesh, Department of Public Policy and Public Administration, Concordia University, Montreal, Canada, 2005)। এ গবেষণাটা মূলত পৃথিবীর সেরা স্কলাদের অভিমত ও মাঠ পর্যায়ে গবেষণার মাধ্যমে রচনা করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, আমার এই গবেষণাটি সন্দ্বীপের (মূলত দক্ষিণ, পশ্চিমে ওউত্তরে)) জেগে উঠা চরে সন্দ্বীপের অভ্যন্তরীণ বাস্তুহারা জনপদেরপুনর্বাসন ও বিভিন্ন সেবামূলক কার্যক্রম হাতে নেয়ার ব্যাপারে একটিদিকনির্দেশনা হিসেবে কাজ করবে বলে আমার বিশ্বাস।
আমরা কি নদী-সিকিস্তি, নাকি অভ্যন্তরীণ বাস্তুহারা জনপদ (IDPs/internally displaced persons) নাকি climate migrants (জলবায়ু অভিবাসী) বা নাকি Environmenat migrants (পরিবেশগত অভিবাসী)?
আসলে আমরা কোনটি?
নদী সিকস্তির “সিকস্তি” শব্দটি মূলত ফার্সি শব্দ সিকস্ত “شکست” থেকে নির্গত যার অর্থ হলো “পরাজিত”। অর্থাৎ আমরা নদীর সাথে যুদ্ধ করে হেরে গেছি। মোগল-বৃটিশ ও পাকিস্তানআমল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত আমরা এ শব্দটি ব্যবহার করে থাকি। এটি একটি ঔপনিবেশিক ডিসকোর্স বা কলোনিয়াল কনসেপ্ট। এই শব্দ চয়নে সূক্ষ একটি রাজনীতি। নদী সিকস্তির অর্থ হচ্ছে জনগণ নদীর কাছে যুদ্ধ করে হেরে গেছে। অর্থাৎ সন্দ্বীপবাসী নদীর সাথে যুদ্ধ করে পরাজিত। তাই বাস্তুহারার আজ পরাজিত হিসেবে সরকারের কাছে গণ্য। তাদের কে নিয়ে তাই সরকারের কি আর ভাবার দরকার আছে? সরকার নদী-সিকিস্তিদের নিয়ে কম কথা বলে, কম পরিকল্পনা নেয় আর তাদের উন্নয়নে কম টাকা খরচ করে।
বিপরীতে এখানে একটা উদাহরণ তুলে ধরছি যা আপনাকে আরো সচ্ছ ধারণা দিবে। যখন আমাদের দেশে সাইক্লোন হয় (সিডোর মতো), জলোচ্ছাস হয়, ঘূর্ণিঝড় হয়, তখন সারা পৃথিবীতে একটা হয় হৈ চৈ লেগে যায়। বিদেশ থেকে টাকা আসতে থাকে, প্রচুর রিলিফ আসে, কন্সাল্ট্যান্টস ও গবেষকরা আসেন অনবরত নতুন সব পরিকল্পনা ও মতামত নিয়ে। ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কও বসে থাকেনা। ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক বলে থাকে: “কম সুদে লোন নিন, আমাদের জনবলকে নিয়োগ দিন, আর আমাদের প্রেসক্রিপশন গ্রহণ করুন”।
বিদেশী মিডিয়া তখন দেশে ভরে যায়। GO-NGO-INGO (সরকার-এনজিও-আন্তর্জাতিক সংস্থা) ও অন্যান্যরা একযোগে কাজ করতে থাকে। সরকার দ্রুত গ্রতিতে লন্ড-ভন্ড এলাকা পুনর্বাসনের জন্য পরিকল্পনা হাতে নেয়। কারণ আক্রান্ত জনপদেরতো মাটি আছে, ফসলের মাঠ আছে; শুধু ঘর-বাড়ী ভেঙে গেছে, ফসল তলিয়ে গেছে বা বিনিষ্ট হয়েছে, তাতে কি- তারাতো আর পরাজিত হয়নি। তাদের বাড়ি-ঘর, সম্পত্তি আর ফসলের মাঠতো নদীতে ভেঙে যায়নি। তারাতো সরকারকে মোটা অংকের ট্যাক্স দিবে। গ্রামীণ বিশাল এগ্রি-মুভমেন্টকে সামনে নিয়ে যাবে। তাদের জন্যতো কিছু একটা করতে হবে। তখন সরকার নিজের দায়িত্ব মনে করে বিশাল একটি প্ররিকল্পনা প্রণয়ন করে তা আবার দ্রুত পাস করিয়ে ফেলে। এটাই বাস্তব এবং এটাই সত্য।
কিন্তু নদী-ভাঙ্গাদের বা অভ্যন্তরীণ বাস্তুহারা জনপদের (আইডিপিএস) জন্য তেমন কিছু করা সম্ভব না, কারণ তারা হেরে গেছে নদীর কাছে। নদীর সাথে যুদ্ধ করে তারা পরাজিত। সরকার তখন বলতে থাকে, “নদীতেতো আমাদের কোনো হাত নেই, আল্লাহ দিয়েছেন আবার আল্লাহ নিয়ে গেছেন, আল্লাহর সাথে বেশি বেশি ক্ষমা চান আর দোয়াকরেন।” আসলে এগুলো সব শুভঙ্করের ফাঁকি।
নদী -ভাঙ্গাদের জায়গা কোথাও নেয়, না সরকারের কাছে, না বড় বড় আন্তর্জাতিক সংস্থাদের (INGOদের) কাছে, না কর্পোরেট মালিকদের কাছে। ওদেরতো আর দেবার কিছু নেই। সরকার ট্যাক্স পাবেনা, এরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলে যায়, তাই স্থানীয় রাজনীতিবিদদের মাথা ব্যথা নেই। এরাতো অন্য স্থান বা এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছে, তাই এদেরকে নিয়ে মাথা ঘমানো বড় বোকামি।
গবেষণায় অভ্যন্তরীণ বাস্তুহারা জনপদ (IDPs/internally displaced persons) ব্যবহার করেছি।
ইউনাইটেড নেশনস, ইউনাইটেড নেশনস হিউমান রাইটস সহআন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ও আন্তর্জাতিক জলবায়ু আইনে ইদানিং নদী-সিকিস্তি শব্দটি আর ব্যবহার হয়না, বরং জাতিসঙ্গে IDPs (অভ্যন্তরীণ বাস্তুহারা জনপদ), climate migrants (জলবায়ু অভিবাসী) ও Environmenat migrants (পরিবেশগত অভিবাসী) মতো শব্দগুলো ব্যবহার হয়। তাই আমি আমার গবেষণায় “অভ্যন্তরীণ বাস্তুহারা জনপদ” ব্যবহার করেছি। এই আইনের মধ্যে বাংলাদেশ সরকার ও উন্নত বিশ্বের রাষ্ট্র প্রধানদের করণীয় ও দায়বদ্ধতা রয়েছে। আন্তর্জাতিক জলবায়ু আইন ও অভ্যন্তরীণ বাস্তুহারা জনপদের উপর রাষ্ট্রকে দায়িত্ব পালনের উপর কঠোর ভাবে বলা হয়েছে। সরকার এই সমস্ত আইনগুলি এড়িয়ে যেতে পারবেনা।
কি আছে আমার এই গবেষণায়?
মূলত আমি বাস্তুচ্যুতদে পুনর্বাসন এবং জনগণ-কেন্দ্রিক উন্নয়নের ধারা প্রবর্তন ও প্রয়োজনের কথা বলেছি। দুর্যোগ নিরসনে সরকারের দায়িত্ব, এনজিওসমূহ, কর্পোরেট সেক্টর, সুশীল সমাজ, মিডিয়া ও রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকার কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করেছি। কেননা সন্দ্বীপের বাস্তুহারা জনপদকে ক্ষমতায়ন ও পুনর্বাসন করা বড় একটি চ্যালেঞ্জ। প্রায় বিশ পাতার এ দীর্ঘ উপসংহারে আমি অনেক ব্যাপারে বিষয় ভিত্তিক দীর্ঘ ভাবে আলোচনা করেছি। নিম্মে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট তুলে ধরছি।
এক:
আমি জাতিসংঘ সহ অন্যান্য বৈশ্বিক সংস্থার আইডিপি সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োগের কথা বলেছি। এই আইন অনুযায়ী লক্ষ্য লক্ষ্য দারিদ্র্যপীড়িত বাস্তুচ্যুত মানুষকে সুরক্ষা দেওয়া বাংলাদেশসরকারের অন্যতম দায়ীত্ব। সন্দ্বীপের এই বাস্তহারা জনপদকে একটিটেকসই পরিকল্পনার আওতায় এনে জরুরি ভিত্তিক একটি কর্মসূচি প্রণয়ন করা অপরিহার্য।
International Humanatarian Law, UN Guiding Principles on IDPs, The United Nations High Commissioner for Refugees (UNHCR), The International Committee of the Red Cross (ICRC) ও the Universal Declaration of Human Rights এর মতো আইনগুলো সরকারকে বিশেষ ভাবে করা নজরে রাখতে পারে বা বলতে গেলে চাপ ও দিতে পারে। এই আন্তর্জাতিক মানবিক আইনগুলো সন্দ্বীপের বাস্তহারা মানুষের অর্থনীতি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষা করার কবচ হিসেবে কাজ করবে যা সরকার কখনো অস্বীকার করতে পারবেনা। কেননা সরকার এই আইনগুলোর অনেকগুলিতে সম্মতি হিসেবে স্বাক্ষরও প্রদান করেছে।
গত সপ্তাহে কৌতুহূল বশত পনেরো বছর পর স্বল্প সময় নিয়েই বিভিন্নতথা উপাত্ত ঘেটে দেখলাম আসলে কি বাংলাদেশ সরকার বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য কি কোনো পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে? মনে হলো, সরকার বাস্তুচ্যুতদের পুনর্বাসনের জন্য কোনো পরিকল্পনা বা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য তেমন কোনো আইনী এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গ্রহণ করেনি। এখানে বলে রাখা দরকার, সমস্যাগুলি কার্যকরভাবে মোকাবেলা করার জন্য সরকারের সদিচ্ছারও অভাব রয়েছে। জনগণকে রক্ষা কল্পে সরকারকে উপকূলীয় দুর্যোগ ও নদী ভাঙার ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে এবং পাশাপাশি, সরকারকে নতুন জেগে উঠা চরগুলোকে বাস্তুচ্যুতদের মাঝে বিতরণ করার জন্যLand Reclamation প্রজেক্টের (এলআরপি) ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
দুঃখের বিষয় হলো, বাংলাদেশ সরকার এখনো কারা বাস্তুচ্যুত বা কারা বাস্তুহারা, এগুলো নির্ধারণ বা নিরুপন করতে পারেনি। “বাস্তহারা কারা” – সেই বিষয়ে সরকারের তরফ থেকে এখনো কোনো সার্বজনীনসংজ্ঞা আসেনি। তাদের জন্য কি করা দরকার, সরকার সেই উপসংহারে এখনো পৌঁছুতে পারেনি। তবে একটা ভালোর দিক আছে,সরকার ২০১৫ সালে অভ্যন্তরীণ বিপর্যয় এবং জলবায়ু বাস্তুচ্যুতকরণ সম্পর্কিত একটি জাতীয় কৌশল প্রণয়ন করেছে। এখানে বাস্তুচ্যুত জনপদের জন্য কিছু সুপারিশও করা হয়। সরকার ২০১০-২০১৫ পঞ্চম বার্ষিকী পরিকল্পনায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জাতীয় পরিকল্পনা খসড়া তৈরি করে। আবার ডাচ সরকারের সাথে বাংলাদেশ একটা ডেল্টা পরিকল্পনা ২১০০ প্রণীত করে যেখানে জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাপ মেটাতে প্রয়োজনীয় ভূমি-ব্যবহার পরিকল্পনা এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার কথা উলেখ রয়েছে ।
দুই:
আমার গবেষণায় বাস্তুহারা জনপদের সুরক্ষা, আর্থ-সামাজিক উন্নতি, ক্ষমতায়ন এবং তাদের মনস্তাত্ত্বিক সুস্থতা ও কল্যাণ, সামাজিক ভাবে জনপদের সাথে আবার তাদের মিশ্রণ (সামাজিক বন্ধন ও কমিউনিটি ইন্টিগ্রেশন) এবং পুনর্বাসনের বিষয়টি নিশ্চিত করার কথা বলেছি। বিভিন্ন অর্থ সামাজিক কর্মসূচী এবং কার্যক্রমগুলি সরাসরি যেন ক্ষতিগ্রস্থদের কাছে পৌঁছে, তা যেন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও সংস্থাগুলো নিশ্চিত করেন, তবে হ্যাঁ সরকারেরও নজরদারি থাকবে এখানে।
জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক মানবিক সংস্থাগুলো বাস্তুচ্যুত দ্বীপবাসীদের সাথে খুব ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবে ও প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করবে, যাতে করে তারা নিজেদেরকে ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দুতে উপনীত করতে পারে। তারা যেন তাদের ক্ষমতা এবং অভ্যন্তরীণ শক্তি ফিরে পায় এবং পুরো উদ্যম আবার নতুন করে তাদের জীবন শুরু করতে পারে।
তিন:
বাস্তুচ্যুত লোকদেরকে স্বনির্ভরতা এবং টেকসই সম্পর্কিত উপার্জনমূলক ক্রিয়াকলাপের সাথে জড়িত করতে হবে। বাস্তুচ্যুত মানুষগুলিকে এমন একটি ব্যবস্থার সাথে জড়িত করতে হবে তারা যেনভবিষ্যতের তাদের পরিকল্পনায় অংশ নিতে পারে ও নিজের মতো করে জীবন ধারণের উৎস খুঁজে বের করতে পারে।
চার:
দ্বীপবাসীদের ক্ষমতায়ন করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দ্বীপবাসী সহ বাস্তুচ্যুত মানুষদের ক্ষমতায়নের জন্য নীতিমালা ও গ্রহণ করতে হবে,তা হচ্ছে শিক্ষা: এর মধ্যে রয়েছে বাধ্যতামূলক শিক্ষা, স্বল্প সময়ের প্রশিক্ষণ এবং প্রযুক্তিগত দিক থেকে দক্ষতা বিকাশের কোর্স প্রদান। বিশেষ করে বস্তুচ্যুত তরুণ প্রজন্মকে শিক্ষিত করতে হবে যাতে করে তারা ভবিষ্যতে তাদের পরিবারকে সহায়তা করতে পারে।
পাঁচ:
ইনকাম জেনারেটিং কার্যক্রম: সরকারি ব্যাঙ্ক থেকে নাম মাত্র সুদে যেন তারা ঋণ গ্রহণ করতে পারে। সুদের হার কম হলে তারা মহাজনদের বৃত্ত থেকে বেরুতে পারবে (কেননা মহাজনরা গরিবদের উপর অত্যধিক সুদ আরোপ করে) । যাতে করে স্থানীয়ভাবে তারা অনেক ছোট আকারের ব্যবসা শুরু করতে পারে (যেমন মৎস চাষ, হাঁস-মুরগি, ছাগল, ভেড়া, গবাদি পশু পালন, সেলাই, বুনন সহ বিভিন্ন ধরণের কাজকর্ম)।
ছয়:
মহিলাদের আবাসন: বাস্তুচ্যুত মহিলাদের আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে অৰ্থাৎ হাউজিং ফর ওমেন। এ ধরণের কার্যক্রমে পরিবারে মহিলাদের গুরুত্ব অনেক বাড়বে ও তারা স্বামীদের হাতে নির্যাতনের শিকার থেকে নিজেদেরকে বাঁচাতে পারবে।
সাত:
যুব, মহিলা ও জ্যেষ্ঠদের কর্মসংস্থান: এলাকার অদক্ষ যুবকদের ও জ্যেষ্ঠদের কর্মসংস্থানের জন্য বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচী হাতে নিতে হবে। সরকার যদি তড়িত গতিতে এ ধরণের নীতি গ্রহণ করে তা হলে এই লোকালয়ে অপরাধের হার হ্রাস পাবে।
আট:
লোকালয়ের নিঃস্ব ও বাস্তহারা জনগণ ও গরিব-দুখী পরিবারগুলোর জন্য স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা, জল এবং স্যানিটেশনের পদক্ষেপ নিতে হবে। তাদের বিনামূল্যে ডাক্তারের পরামর্শ, বিনামূল্যে ওষুধ এবং বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। খাবার ও ব্যবহারের জন্য টিউবওয়েলের পানি লোকালয়ে নিশ্চিত করা ও স্যানিটারি ল্যাট্রিন স্থাপনের উদ্যোগ নিতে হবে। এ জনপদের পুষ্টির অবস্থার উন্নতির জন্য কার্যক্রম হাতে নিতে হবে।
নয়:
জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক উভয় স্তরের নেটওয়ার্কসমূহের সাথে বিশেষ ভাবে যোগাযোগ রাখতে হবে যাতে করে রাষ্ট্র তার দায়িত্ব সম্পর্কে সদা জাগ্রত থাকে। এ ব্যাপারে বাস্তুচ্যুত মানুষের সার্বিক উন্নতির জন্য রাষ্ট্রের দায়িত্বকে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক দলগুলো, মিডিয়া এবং এনজিওগুলির ভূমিকা অপরিসীম।
দশ:
উপকূলীয় বনজ পরিকল্পনা: উপকূলীয় বনজ পরিকল্পনায় ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বৃক্ষ রোপন করতে হবে যা দুর্যোগকে অনেকাংশে দুর্বল করতে পারে। এ সমস্ত গাছপালা এবং গাছ দেখাশোনায় স্থানীয় লোকেদের অংশ গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এই দ্বীপটিকে বনভূমি কর্মসূচি প্রকল্পের আওতায় আনলে জনপদের জন্য একটি স্বস্তি কারণ হবে।
এগারো:
পুনর্বাসন প্রকল্প: নতুন জেগে উঠা চরে এদের পুনর্বাসন করতে হবে যাতে বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিরা একসাথে বসবাস করতে পারে যা তাদের তাদের সামাজিক কাঠামো মজবুত করবে ও তারা একটি শক্তিমান কমিউনিটিতে রূপান্তরিত হবে ।
বারো:
ঘূর্ণিঝড় পূর্বাভাস এবং সতর্কতা সিস্টেম: ঘূর্ণিঝড়ের সময় যোগাযোগের ভূমিকা অত্যন্ত কার্যকরি ভূমিকা রাখে। সংক্ষিপ্ত তরঙ্গ রেডিওগুলি আসন্ন ঘূর্ণিঝড়গুলির সবচেয়ে ভাল যোগাযোগের মাধ্যম। ওয়্যারলেস সেট এবং হ্যাম রেডিও একটি গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে তথ্য প্রেরণ এবং প্রচারের জন্য খুব দরকারী। সতর্কতা সিস্টেমটি ঝড়ের সম্ভাব্প্রানা, দুর্যোগ প্রস্তুতি ও ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে বিশেষ ভাবে সাহায্য করতে পারে।
মূলত আমি দুধরনের নীতিমালার কথা বিশেষ ভাবে বলেছি:
ক: প্রাকৃতিক দুর্যোগ হ্রাস করার নীতিমালা–
• ক্রস ড্যাম • উপকূলীয় বাঁধ তৈরী • সৈকতে পাথর ও ভারী অবজেক্ট ফেলতে হবে যা নদীর গতি পরিবর্তনে সাহায্য করবে। • সন্দ্বীপের চারি দিকে Reforestaion/পুনঃঅরণ্যায়ন • চর ও খাস জমি পুনর্বণ্টন • বাস্তহারাদের পুনর্বাসন • সামাজিক বন্ধন ও কমিউনিটি ইন্টিগ্রেশন •দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য প্রশিক্ষণ • কৃষি-খামারের জন্য ফ্রি সেচের ব্যবস্থা গ্রহণ করা • বীজ সরবরাহ ও কৃষি ঋণ মৌকুফ করা • ভূমি ব্যবহার ব্যবস্থাপনা।
খ: আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য নীতিমালা
• ইনকাম জেনারেশন প্রোগ্রাম • কর্মসংস্থান বৃদ্ধি • যুব, মহিলা ও জ্যেষ্ঠদের কর্মসংস্থান • স্বল্প সুদে ঋন প্রদান করা • ছোট আকারের ব্যাবসায়ীকপরিকল্পনার জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান ও ব্যবসাতে সাহায্য করা • সব বয়েসী জনপদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা ও নীতি গ্রহণ করা • দারিদ্র্য হ্রাস করার জন্য কর্মসূচি হাতে নেওয়া • জনসংখ্যা বৃদ্ধি হ্রাসের পরিকল্পনা • স্বাস্থ্যসেবা • স্যানিটারি টয়লেট • যোগাযোগ ব্যাবস্থার উন্নতিসাধন •টেলি–কম্যুনিকেশনকে সম্পূর্ণভাবে মানুষের দ্বারগোড়ায় পৌঁছানো • সার্বজনীন বিদ্যুৎ কমমূল্যে প্রদান • বিভিন্ন ধরনের বিনোদনে অঙশ গ্রহণ করার সুযোগ করে দেয়া।
পরিশেষে বলা যায়, নিঃস্ব মানুষের পক্ষে কাজ করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্যোগ ও উৎসাহ আমাদেরকে অনেকখানি সাহায্য করবে। সন্দ্বীপের অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের (আইডিপি) ভাগ্য উন্নয়নে রাষ্ট্রকে আরো উদার হতে হবে। বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও আন্তর্জাতিক এজেন্সিগুলিকে সংগঠিত করার জন্য কাজ করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। সন্দ্বীপের আইডিপিএস ও ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য অবকাঠামো তৈরির প্রক্রিয়ায় নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, কমিউনিটি নেতৃবৃন্দ, মিডিয়া, সুশীল সমাজ, প্রবাসীসহ ও এনজিওদের দায়বদ্ধতা অনেক। এ সুযোগ আমাদের সার্বিক ভাবে কাজে লাগাতে হবে যাতে করে দুর্যোগ সম্পর্কিত এজেন্সী সহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সন্দ্বীপের বাস্তুচ্যুত মানুষের সুরক্ষার জন্য একটি সুপরিকল্পিত ও নির্দিষ্ট নীতিমালার অধীনে সরকারে বিভিন্ন এজেন্সীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে পারে, এটা আমাদের সবার কামনা।
পুনশ্চ: চাইলে আপনিও গুগলে গবেষণার শিরোনামটি লিখে টাইপ করে পড়তে পারেন বা আপনি এ লিংকটি টাইপ করে গুগলে ব্রাউজ করলে পড়তে পারবেন:
https://spectrum.library.concordia.ca/8573/1/MR10193.pdf
-ডঃ ইকবাল শাইলো
Ph.D. in Critical Geopolitics (Carleton University, Ottawa), M.A. in Public Policy & Public Administration (Concordia University, Montreal), Post-Graduate Diploma in Journalism (Concordia University), B.A. (Hons.), M.A in English (Dhaka),Triple Post-Graduate Diplomas (M.A. equivalent) in Arabic Literature,Interpretation and Speeches (Dhaka)
[ডঃ ইকবাল শাইলো বর্তমানে কানাডা সরকারের ডিপার্টমেন্ট অফ ন্যাশনাল ডিফেন্স এ (DND) পলিসি এডভাইসর হিসেবে কর্মরত। বেশ কিছু দিন তিনি অটোয়ার কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। তার ত্রিশটির ও বেশি গবেষণা প্রবন্ধ আন্তর্জাতিক জার্নাল এ প্রকাশিত হয়েছে। এর আগে তিনি বাংলাদেশে ADAB News ও Grassroots এর নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন। তিনি Bangladesh Observer, Daily Star, Dhaka কুরিয়ারে ও লেখালেখি করতেন। তিনি Eastern News Agency (ENA), The Weekly Monitor(Canada), Centre East-West Dialogue (Canada), Health Asia(Canada) ও GSA Bulletin (Canada) এ এডিটর হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি চারটি পুস্তকের প্রণেতা। তার তার লেখা “সপ্ত ঝুলন্ত গীতিকায় রোমান্টিসিজম” বইটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামিক ইউনিভার্সিটি সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক স্টাডিস ডিপার্টমেন্ট, এরাবিক ডিপার্টমেন্ট ও ইসলামের ইতিহাস বিভাগে রেফারেন্স বুক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যোগাযোগ: iqbalshailo@gmail.com]
নোট: লিখেছেন শিব্বীর আহমেদ তালুকদার