একটা মাত্র মায়ের কোলে তিনটা শিশু দুইজন কোনরকমে বসেছে আর একজন দাঁড়িয়ে আমি বললাম আমার কোলে বসো। ছেলেটা বুঝতে চাইছিল না। কত আর বয়স ! বড়জোর ছয় – সাত। এই বয়সে আমার মেয়েটা একটা সিএনজি অটোরিকশার (আমরা বলতাম টেম্পু) সিটের জন্য সেকি চিল্লাচিল্লি করতো !
আমার চুল টেনে ছিঁড়ে হাত পরখ করে দেখতো, হাতে চলে এসেছে কিনা চুল, নইলে আবার ধরে চুল টানতে। এই করে করে করে মাইজদি টু সোনাপুর আর সোনাপুর টু মাইজদি আমার অনেকটা সময় আসা যাওয়া। এই টেম্পুর ভাড়া প্রথমদিকে ছিল দুই টাকা করে আসা যাওয়ায় চার টাকা। পরে আরও এক টাকা বেড়ে হলো তিন টাকা করে ছয় টাকা।
চাকুরিজীবী আমি কিন্তু এক টাকাও তখন আমি হাতে পেতাম না। কি করে পাব, আমার সবগুলো বেতন মুঠ মুঠ করে আমার স্বামী নিয়ে যেতো যে ! চেকবুকও আমার কাছে থাকতো না। আমি কেবল স্বাক্ষর করতে পারতাম। টাকার চেহারা কখনো দেখতাম না।
বেতন হলে অফিস থেকে এসে কোনরকমে ফ্রেশ হয়ে ক্যালেন্ডার নিয়ে বসতো। আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করতো এই মাসের ছুটি কয়দিন? নিয়ম হয়ে গিয়েছিল তাই ছুটি কয়দিন আগেই দেখে রাখতাম । শুধু ছুটির দিনগুলো বাদ দিয়ে বাকি কর্মদিবসে প্রত্যেক কর্ম দিবসে দুই টাকা করে চার টাকা হিসেবে আমাকে দিয়ে দিতো সেই স্বামী নামের প্রভুটি।
মেয়ের সিট তাই আমার কোলেই। আমার ছোট্ট শরীরে মেয়ের অনেক বড়বেলা পর্যন্ত এই সিটটিই ফিক্সড ছিলো। তাই এখনো কোনো শিশুকে যদি মায়ের কোলের অভাবে কিংবা সিটের অভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি আমার সেই তখনকার সময়টা খুব মনে পড়ে যায়। আমার মেয়েটা কত কান্না করতো একটা সীটের জন্য!
দাপ্তরিক কাজেই এই করোনাকালে লক ডাউনের ভেতর বের হতেই হলো। তারপর ভাবলাম, এসেছিই যখন ওষুধটা নিয়েই যাই। এক ছোট ভাই আছে ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করে। বেশিরভাগ সময় ওষুধগুলো সে – ই ঘরে না ঢুকে বাইরে থেকেই দিয়ে চলে যায়। ছোট ভাইয়ের জন্য খুব খারাপ লাগে। ওষুধ কোম্পানির মালিকদের টাকার কি এতোই অভাব যে, কর্মীদেরকে একটা স্যানিটাইজার পর্যন্ত দিতে পারলো না।
প্রসঙ্গ পাল্টে যাচ্ছে ।
আমার লেখাটার এই এক সমস্যা, লেখা কেবলই নানা বাঁকে ঘুরতে চায়। নদীর বাঁকের মতো জীবনের কতো বাঁকে কতো কতো গল্প ! সাজিয়ে বলা হয়না, এলোমেলো হয়ে যায়। ঠিক যেমন এলোমেলো আমার সংসার। যেমন এলোমেলো জীবন। খুব গোছানো জীবন আমার কখনোই ছিল না।
প্রসঙ্গে ফিরে আসি।
যতবারই বলছি এসে বসতে, বসতেই চাইছে না। মা অবশ্য, বলছে, তুমি বসো উনার কোলে, উনি তোমার আন্টি হয় তো! এবার ছেলেটা এসে বসলো খুব আলতো করে। আমি ব্যথা পাইনা তো বাবা ! তুমি বসোই না ঠিক করে।
পথ চলতে চলতে এরকম কত জনের সাথে সম্পর্ক, কালের স্রোতে হারিয়ে গেলো।
ওষুধ কিনতে গিয়েছিলাম মূলতঃ সুমন অসুস্থ বলে। জ্বর,গলা ব্যথা,মাথাব্যথা। ভয়ে আইসোলেশনে আছে। এই করোনায় কতোজন যে নাই হয়ে গেলো! সুমনের জন্য টেনশন লাগে। বাচ্চাগুলি ছোটো। এই অসভ্য সমাজে একা নারীর পথে চলা কতোটা কঠিন সে আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে!
ওষুধ নিয়ে আসার পথে একমাত্র রিক্সা ছাড়া অন্য কোন গাড়ি নাই। রিক্সার ড্রাইভার সুযোগ বুঝে ভাড়া কাটছে দ্বিগুণ কিংবা তিনগুণ। একটা অটোরিকশা থামালাম। বললাম আমি একা যাবো না, আপনি সঙ্গে অন্য কাউকে নেন। রিকশাওয়ালা বললো, আপনি মহিলা মানুষ আপনার সঙ্গে আরেকজনকে কিভাবে নিব? বললাম সিএনজি অটোতে কী পুরুষের সঙ্গে যাইনা ? যাই হোক রিক্সায় উঠে বসলাম। সবকিছু আসলে এই বেটি শেষ করলো ! আমি বললাম কেন? বললো, এই যে মেয়ে মানুষের পর্দা নাই! আমি পুরুষের সঙ্গে যেতে চাইলাম এটার সঙ্গে এই বেটির সম্পর্ক কি? রিক্সাওয়ালা চুপ করে গেলো আর কথা বাড়ালো না।
এই করোনায় একটা পরিবর্তন খেয়াল করার মতো ছিল। আমি কিন্তু দিব্যি অন্য পুরুষের সঙ্গে নোয়াখালীর মত একটা অনুভূতি সর্বস্ব জায়গায় পুরুষের সঙ্গে একই রিক্সায় যাতায়াত করতে পেরেছি। এটা করোনার সুফল বলতে পারি। আমার কাছে অবশ্য এটা একটা সুফল। পথ পরিবর্তন।
রিকশা থেকে নেমে বাসা পর্যন্ত আরও প্রায় পাঁচ/সাত মিনিট হাঁটার রাস্তা। আমার মাস্ক পরা ছিলো। হাতে তখন গ্লাভসও ছিল। যদিও এখন আর গ্লাভস পরি না।
একজন বিপরীত দিক থেকে আসলেন। তাঁর মুখে মাস্ক নাই। জিজ্ঞেস করলাম আপনার মাস্ক? অমনি হাত পা নেড়ে বোঝাতে শুরু করলেন, সবই তো আসলে আল্লাহর দান। বান্দা কিই বা করতে পারে! বললাম, এই যে আমি মাস্ক পরলাম, গ্লাভস পরলাম, স্যানিটাইজার নিয়ে হাঁটছি এর কোনটা আল্লাহর দান নয়, আপনি বলেন?
লোকটা আর কথা বলে না। চুপচাপ হাঁটা শুরু করে। আমি আমার গন্তব্যের দিকে। যদিও জানিনা গন্তব্য আসলে কোথায় কিংবা ঠিক গন্তব্যে যাচ্ছে কিনা। অথবা আদৌ যেতে পারবো কি না।এই করোনায় কতোজন যে রাস্তায় পড়ে মরে রইলো, কেউ ভয়ে ছুঁতেও এলো না।
শামা আরজু: লেখক