সন্দ্বীপ টাউনে সভা সমাবেশ (৫)
[এ লিখাটি বা পর্বটি ওরাল হিস্ট্রি বা স্মৃতিকথন, ইতিহাস নয়। তবে ইতিহাসবিদরা এই লিখা বা পর্বগুলো থেকে তথ্য-উপাত্তগুলো গবেষণার জন্য সূত্র বা রেফারেন্স উল্লেখপূর্বক এবং সোশ্যাল মিডিয়া ও অনলাইন নিউজ পোর্টালে শেয়ার করতে হলে পূর্ব অনুমতি নিয়ে উদ্ধৃতি বা লেখকের টাইম লাইন থেকে শেয়ার করতে পারবেন। গবেষক ছাড়া অন্যরা পর্যালোচনা এবং প্রবন্ধ লেখার ক্ষেত্রে উদ্ধৃত করতে হলে লিখিত অনুমতি ব্যতিরেকে, আংশিক বা সম্পূর্ণ কোন ধরণের অনুলিপি করা যাবে না। বাংলাদেশ ও আর্ন্তজাতিক কপিরাইট আইন দ্বারা লেখক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। লিখিত অনুমতির জন্য ইমেইল: sandwip21st@gmail.com]
মতিয়া চৌধুরী ও অলি আহাদ। আমাদের দেশের জাতীয় রাজনীতির কিংবদন্তি নেতা। স্বস্ব রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অবদানের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। দু’জনেই ১৯৬৭/৬৮ সালের দিকে সন্দ্বীপে এসেছিলেন। অলি আহাদের জন্ম ১৯২৮ সালে আর মতিয়া চৌধুরীর ১৯৪২ সালে। অলি আহাদ বেঁচে নেয়। মতিয়া চৌধুরী রাজনীতিতে সক্ৰিয় আছেন। দু’জনই সন্দ্বীপ এসে জনসভায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন। অলি আহাদের সেই অগ্নিঝরা বাক্যবান। অগ্নিকন্যার সেই অগ্নি স্ফুলিঙ্গ।
অলি আহাদ, গণমানুষের অধিকার রক্ষার্থে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিতেন। মতিয়া চৌধুরী সমাজতন্ত্রের বক্তৃতা করতেন। লক্ষ্য তাদের এক ছিল গণমানুষের মুক্তি। দেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক মুক্তি। তাদের ঝালাময়ী ও অগ্নিঝরা বক্তৃতা আজও গণমানুষের আশা আখাঙ্খার প্রতীক হিসাবে রয়ে গেছে। গণমানুষের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তি আসছে কি? তাদের রাজনৈতিক জীবনে অলি আহাদ আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে গেছেন আর মতিয়া চৌধুরী আওয়ামী লীগে ঢুকেছেন।
অলি আহাদ আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন৷ তিনি আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। মতিয়া চৌধুরী আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হয়েছিলেন। দু’জনের মধ্যে মিল আছে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক পদবীতে, কিন্তু তাদের রাজনীতিতে অমিল রয়েছে। একজন সব সময় সরকার বিরোধী ছিলেন আর অন্য জন সরকারি দলে আছেন।
অলি আহাদ ভাষা আন্দোলনে অগ্রণী ও জড়িত থাকার কারণে ১৯৪৮ তারিখে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৪ বছরের জন্য বহিষ্কার করে। ১৯৪৪ সালে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন ৷ ১৯৪৭ সালে প্রথম বিভাগে আইএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন৷ দীর্ঘ ৫৮ বছর পর ২০০৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেই বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করেছে। ঢাকা কলেজে ছাত্র থাকাকালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে মুসলিম ছাত্রলীগের কর্মী হিসাবে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন৷ তিনি রাজনীতি করেছেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মাওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে।
অলি আহাদ ছিলেন ১৯৪৮ সালে গঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং ১৯৫২ এর রক্তস্নাত ভাষা আন্দোলনে অন্যতম নেতৃত্বদানকারী সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের জন্য তিনি প্রথম কারাগার ভোগ করেন।
১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি,কম পরীক্ষায় প্রথম হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকার কারণে তত্কালীন কর্তৃপক্ষ অলি আহাদকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম,কম পড়ার সুযোগ না দিয়ে চিরতরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করে। তিনি ভাষা আন্দোলনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেন ও ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন।
পাকিস্তানের গণপরিষদে বাংলা ভাষার স্থান না হওয়ায় ১৯৪৮ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমাজ প্রতিবাদ সভা, সাধারণ ধর্মঘট ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ঐ দিন পুলিশ ছাত্রদের বাধা দেয় এবং বহু ছাত্রকে গ্রেফতার করে। বন্দী নেতাদের মধ্যে ছিলেন শামসুল হক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, শওকত আলি, কাজী গোলাম মাহবুব প্রমুখ।
১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনের মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী রাজনৈতিক মেরুকরণের সময় অলি আহাদ মাওলানা ভাসানীর সাথে প্রগতিশীলদের পক্ষে যোগ দেন৷ তিনি চিরদিন গণতান্ত্রিক রাজনীতির স্বপক্ষে সংগ্রাম করেন৷ প্রিন্ট মিডিয়াতেও তিনি সোচ্চার ছিলেন। সাপ্তাহিক ইত্তেহাদ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন কালে তিনি সরকার বিরোধী জনমত গঠন করেন ৷
মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে তিনি ভারতের আধিপত্যবাদ বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেন ৷ মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনা বাস্তবায়নের জন্য বিরোধী শিবিরের রাজনীতি করেন। এই বিরোধী শিবিরে মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে দুঃশাসন বিরোধী এক তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন তিনি ৷
স্বাধীন দেশে সরকার কর্তৃক ১৪৪ ধারা জারি করে সভা সমিতি বন্ধ করার প্রতিবাদে অলি আহাদ ১৯৭৪ সালের জুনে হাইকোর্টে প্রথম রিট আবেদন করেন৷ হাইকোর্টের বেঞ্চ ১৯৭৪ সালের অক্টোবর মাসে ১৪৪ ধারা জারিকে অবৈধ ঘোষণা করেন৷ ইতিমধ্যে ১৯৭৪ সালের জুনে তিনি বিশেষ ক্ষমতা আইনে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে যান। তিনি ৪র্থ সংশোধনীর বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়ান৷ বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে পরিচালিত সকল সংগ্রামে অকুতোভয় এই লড়াকু নেতা আজীবন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
আশির দশকে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আপোসহীন ভূমিকার কারণেও তিনি কারাভোগ করেন৷ অলি আহাদ ডেমোক্র্যাটিক লীগ নামে একটি দল গঠন করেন। দলটি এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ৭ দলীয় জোটের শরীক হয়। তার সাপ্তাহিক ইত্তেহাদ গণমানুষের কথা লিখতো। ওই সাপ্তাহিকী তার মালিকানাধীন ছিল। সরকার বিরোধী লেখার জন্য প্রকাশনাও নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। যাহোক, অলি আহাদ স্বাধীনতা পুরস্কার পান। অলি আহাদ তার জীবনের দীর্ঘ ১৯ বছর কারাগারে কাটিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর বিশেষ বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও বিরোধী শিবিরে অবস্থান করে সাড়া জীবন গণমানুষের কথা বলে গেছেন।
এই রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব সন্দ্বীপ টাউনের জনসভায় প্রায় দু’ঘন্টার বেশি বক্তৃতা করেন। ওই সময় ডিবি’র লোকজন জনসভার মঞ্চের কাছে বিরোধী দলের নেতাদের বক্তৃতা নোট করতেন। ডিবি’র লোকজন তাদের লিখিত বক্তৃতার নোটগুলো জন্য স্বাক্ষী হিসাবে গন্যমান্য ব্যক্তির দস্তখত নিতো। আমাদের সন্দ্বীপ টাউনের একজন ডিবি’র লেখা কাগজে স্বাক্ষী হিসাবে নিজের দস্তখত দিয়েছিলেন। পরে জেনেছি স্বাক্ষী হিসাবে যিনি স্বাক্ষর দিয়েছিলেন, তিনি মুসলিম লীগের লোক ছিলেন। অলি আহাদের লেখা ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-৭৫’ আমাদের রাজনৈতিক কর্মীদের জন্য একটি প্রামাণ্য সিলেবাস।
মতিয়া চৌধুরীর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় বামপন্থী রাজনীতি দিয়ে। কমিউনিস্ট ঘরোনা থেকে উনি রাজনীতি শুরু করেন। ওই সময় ছাত্ররা বাম বাম রাজনীতি করতে স্বচ্ছন্দ অনুভব করতো। বাম রাজনীতি, লাল বই মাও লেনিনের বই ছাত্রপ্রিয় ছিল। শুরুটা করেছিলেন আমাদের কমরেড মুজফ্ফর আহমদ। ভারতীয় কম্যুনিষ্ট পার্টির গোড়াপত্তন করেন। ওই সময় লাল বইয়ের কদর ছিল অনেক। নিজেদেরকে আঁতেল আঁতেল মনে হতো। বলা হতো ভালো ছাত্ররা লাল বইয়ের পাঠক ও অনুসরণকারী ছিল। লুকিয়ে লুকিয়ে রাত জেগে লাল বই পড়ার রেওয়াজ ছিল।
ঢাকার ইডেন কলেজে পড়া শুনা করেন মতিয়া চৌধুরী। তখন রাজনীতিতে আগ্রহী হয়ে উঠেন ও ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। মতিয়া চৌধুরী ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হয়েছিলেন ১৯৬৫ সালে। একজন মহিলা ছেলেদের ডিঙিয়ে সভাপতি হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। তার ছাত্র-জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। আকাশ ছুঁই ছুঁই। পরবর্তীতে তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)-এ যোগদান করেন ও ন্যাপের কার্যকরী কমিটির সদস্য হয়েছিলেন। পরে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন ও প্রায় অর্ধ শত বছর আওয়ামী রাজনীতিতে বসতি স্থাপন করছেন।
অলি আহমেদ কার্গিল মাঠে বড় জনসভা করেছেন। মতিয়া চৌধুরী খালপাড়ের মাঠে বড় জনসভা করেন। তাছাড়া ঊনসত্তরের গণ আন্দোলনেও কার্গিল হাই স্কুলের চত্বরে সন্দ্বীপের নেতাদের উদ্যোগে আওয়াজিত সন্দ্বীপের সমস্ত হাই স্কুল থেকে একটি গণ মিছিল খালপাড়ের ঈদগাহ ময়দানে এসে শেষ হতো। ওই সব গণমিছিলের মধ্যে অনেকে নেতা বক্তব্য রাখতেন। তৎকালীন ছাত্র নেতা প্রয়াত সাহাবুদ্দিন ভাই যিনি সার্ভেয়ার বেলায়েত মিয়ার ছেলে ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি সোনালী ব্যাঙ্ক সন্দ্বীপ টাউনের ম্যানেজার ছিলেন।
দুই জেনারেল রাষ্ট্রপতির সময়কালে মতিয়া চৌধুরী বেশ কয়েকবার গ্রেফতার হন। আওয়ামী লীগ শাসনামলে কৃষিমন্ত্রির দায়িত্ব পালন করেন দু’বার। দেশ এখন কৃষিতে স্বয়ং সম্পন্ন। সন্দ্বীপ টাউনে তিনি অগ্নিঝরা বক্তৃতা করেন। তন্ময় হয়ে সকলে তার বক্তৃতা শুনতো। উনি গল্প বলে বক্তৃতা শেষ করতেন। ইসলাম প্রেমী মানুষের মনচেতনা বুঝাতে গিয়ে মতিয়া চৌধুরী (রাজনৈতিক স্যাটায়ার করে) বললেন:
রাত্রি বেলা নুরুল ইসলাম দৌড়ে পালাতে গিয়ে কুয়াতে পরে যায়। চারিদিকে লোকজন তাকে পাকড়াও করতে গিয়ে খুঁজে পাচ্ছে না। বেচারা কুয়োতে পরে হাবুডুব খাচ্ছে। বুদ্ধি করে চিৎকার দিয়ে বললো- মা তোর ইসলাম গেল ………..
জনগণ ইসলামকে বাঁচাতে গিয়ে চোর খোঁজা ভুলে গেলো।
স্মৃতিকথনে: শিব্বীর আহমেদ তালুকদার
আইনজীবী, সমাজ সংগঠক ও কথ্য ইতিহাস গবেষক।
sandwip21st@gmail.com
—–
আরো বিস্তারিত জানার জন্য:
১. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশি বছর; অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম
………
আশা করি, এই পর্বটি আপনাদের ভালো লেগেছে। লাইক ও কমেন্টের মাধ্যমে মতামত দিবেন, প্লিজ। কোনো রকমের তথ্য বিভ্রাট হলে ইনবক্সে ম্যাসেজ দিবেন বা ইমেইল করবেন। ফলে ভুল শুধরে নিতে পারবো। আর এই পোস্টটি শেয়ার করে নিন আপনার অনলাইনের সোশ্যাল বন্ধুদের মাঝে। যাতে আগামী পর্ব থেকে উনারাও সরাসরি স্মৃতিকথনের সাথে যুক্ত হতে পারেন। সন্দ্বীপকে নিয়ে নস্টালজিয়া ও কেতাদুরস্ত সন্দ্বীপিয়ানা স্মৃতিকথনমূলক পরবর্তী পর্বের উপর ‘চোখ রাখুন’ – ।
আগামী রোববার, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ ইং, বাংলাদেশ সময়: সকাল ৯ টা: আসছে আমার দেখা সন্দ্বীপ (পর্ব নং ১৮)
শিরোনাম থাকবে: সন্দ্বীপ টাউনে সভা সমাবেশ (৬)