“আমায় যদি তুমি বলো ঈশ্বর,
আমি বলব, হ্যাঁ আমি তাই।
আমায় যদি বলো পাপী শয়তান,
আমি বলব, হ্যাঁ আমি তাই-ই।
-কারণ আমার মাঝে যাদের অস্তিত্ব
তার একজন ঈশ্বর; অপরজন শয়তান।”
কবিতাটির নাম ‘আমি ঈশ্বর আমি শয়তান’। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর প্রথম কবিতা। কাঁচা হাতের লেখা। আবেগ আর উদ্দীপনায় ভরা, কিন্তু জীবনদর্শন ও চিন্তাধারার ধার সুস্পষ্ট। ১৯৭৩ সালে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশ হয় কবিতাটি। কিন্তু রুদ্র এতে তার নাম ছাপেননি।
ব্যক্তি রুদ্র ও কবি রুদ্র উভয় সত্ত্বাই বাঙালি পাঠক সমাজের চেতনা ধারায় এক অনন্য সংযোজন। টালমাটাল সত্তরের দশকে সমাজ ও রাজনীতির উত্থান-পতনে ত্যাগ ও প্রাপ্তি, ধ্বংস আর নির্মাণ, প্রত্যাশা আর আশাভঙ্গের অনিবার্য অস্থিরতার সময়টিতে যারা কলম চালিয়েছিলেন, যারা সেই সময়টাকে আত্মোপলব্ধি ও সৃষ্টিশীল উন্মাদনার দ্বারা এক চিরন্তন প্রতীতি প্রদান করেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম, কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ।
রুদ্রর পিতৃপ্রদত্ত নাম মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ। ছোটবেলায় এই নামেই পরিচিত ছিলেন তিনি। লেখালেখির জগতে এসে নামটি তিনি নিজেই বদলে দেন। নামের আগে যোগ করেন ‘রুদ্র’, ‘মোহাম্মদ’-কে করেন ‘মুহম্মদ’ আর ‘শহীদুল্লাহ’-কে ‘শহিদুল্লাহ’। নিজ প্রদত্ত এই নাম শুধু লেখক হিসেবেই নয়, পরীক্ষার সনদেও তিনি ব্যবহার করেছেন।
রুদ্রর জন্ম ১৯৫৬ সালের ১৬ অক্টোবর বরিশাল রেডক্রস হাসপাতালে। তার মায়ের নাম শিরিয়া বেগম, বাবার নাম শেখ ওয়ালীউল্লাহ। তাদের স্থায়ী নিবাস ছিল বাগেরহাট জেলার মংলা থানার সাহেবের মেঠ গ্রামে।
এই কবির স্মরণে বাংলাদেশের বাগেরহাট জেলার মোংলার মিঠেখালিতে গড়ে উঠেছে “রুদ্র স্মৃতি সংসদ”।
রুদ্রর লেখাপড়ায় হাতেখড়ি আর লেখালিখিতে আগ্রহ দুটোই তৈরি হয় এই নানাবাড়িতে। সে সময় ঢাকার বিখ্যাত ‘বেগম’ আর কলকাতার ‘শিশুভারতী’ পত্রিকা আসতো তার নানাবাড়িতে। সাথে রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের বইপত্র তো ছিলই। রুদ্র মজে যান এসবের মধ্যে। নানাবাড়ির পাঠশালায় ৩য় শ্রেণী অবধি পড়েন রুদ্র, এরপর ১৯৬৬ সালে ৪র্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন মংলা থানা সদরের সেইন্ট পলস স্কুলে। এই স্কুলেই রুদ্র একসময় ৯ম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। ’৭১ এ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ায় তার আর ৯ম শ্রেণিতে পড়া হয়নি। যুদ্ধ শেষে ৯ম শ্রেণী টপকিয়ে কবি ১০ম শ্রেণিতে ভর্তি হন ঢাকার ওয়েস্ট এন্ড হাই স্কুলে। এখান থেকেই ১৯৭৩ সালে ৪টি বিষয়ে লেটার মার্কসহ বিজ্ঞান শাখায় ১ম বিভাগে রুদ্র এসএসসি পাস করেন। এরপরে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। পিতামাতার ইচ্ছা ছিল, রুদ্র ডাক্তার হোক। কিন্তু রুদ্র বিজ্ঞানের পথে আর না গিয়ে তার পছন্দের মানবিক শাখায় চলে এলেন।
১৯৭৮ সালে রুদ্র ডাকসু নির্বাচনে অংশ নেন, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের মনোনয়নে সাহিত্য সম্পাদক পদে। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন কামাল চৌধুরী (ছাত্রলীগ) ও আলী রিয়াজ (জাসদ ছাত্রলীগ)। সেবার সাহিত্য সম্পাদক হন আলী রিয়াজ। রুদ্র সরাসরি কখনো রাজনীতিতে না এলেও ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিয়ে প্রকাশ করেন তার রাজনৈতিক বিশ্বাস। সেই বিশ্বাস টিকে ছিল জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।
অভাবে সারাদিনে কেবল একটি সিঙ্গাড়া খেয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে জীবন দেখে কাগজের ঠোঙার পিঠে কবিতা লেখা। তিনি পাগলাটে রুদ্র ছাড়া আর কে?
“তারপর ফুটে ওঠে ত্বকে মাংসে
বীভৎস ক্ষরতা।
জাতির শরীরে আজ তেমনি দ্যাখো
দুরারোগ্য ব্যাধি
ধর্মান্ধ পিশাচ আর পরকাল ব্যবসায়ী রূপে।”
তিনিই বোধহয় একমাত্র কবি যার উপার্জনের উপায় ছিলো কয়টি রিকশা। রিকশার ভাড়া পেয়ে চলতো দিন। মাছের খামার আর ঠিকাদারীকেও জীবিকার উপায় নিলেও বারবার ব্যর্থ হয়েছেন।
ছাত্রজীবনেই রুদ্রর দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়, ‘উপদ্রুত উপকূল’ আর ‘ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম’। প্রথম বইটির প্রকাশক ছিলেন আহমদ ছফা। দুটি বইয়ের জন্যেই রুদ্র যথাক্রমে ১৯৮০ ও ১৯৮১ সালে সংস্কৃতি সংসদ প্রবর্তিত মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার লাভ করেন। রুদ্র ছিলেন জাতীয় কবিতা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা-যুগ্ম সম্পাদক, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের প্রথম আহবায়ক কমিটির সদস্য এবং বাংলাদেশ সঙ্গীত পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও প্রকাশনা সচিব।
ছিলেন প্রচণ্ড খ্যাপাটে। বিশেষ করে যা বলতেন দারুণ ভাবে অনুধাবন করতেন। অন্যদের চেয়ে প্রচণ্ড ব্যতিক্রম। যা সহজে মেনে নিতো অন্যরা মেনে নিতে পারতেন না লোকটা। দিনের পর দিন বেকারত্ব ছিলো কিন্তু সন্ধ্যা হলেই সেই কবিতার খাতায় মগ্ন।
রুদ্র বিয়ে করেন ২৯ জানুয়ারি, ১৯৮১ সালে। স্ত্রীর নাম লীমা নাসরিন। পরবর্তীকালে তিনিই তসলিমা নাসরিন নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন ও নিজের বিতর্কিত লেখালেখির জন্য আলোচিত হন।
রুদ্রের উৎসাহ ও প্রেরণায় তসলিমাও পুরোপুরি জড়িয়ে যান লেখার জগতের সাথে। এই অবদানকে তসলিমা অস্বীকার করেননি। তার ভাষ্যে-
“রুদ্রকে আমি আমার সতেরো বছর বয়স থেকে চিনি। সেই সতেরো বছর বয়স থেকে রুদ্র আমার সমস্ত চেতনা জুড়ে ছিল। আমাকে যে মানুষ অল্প অল্প করে জীবন চিনিয়েছে, জগৎ চিনিয়েছে- সে রুদ্র। আমাকে যে মানুষ একটি একটি অক্ষর জড়ো করে কবিতা শিখিয়েছে- সে রুদ্র।”
দারুণ সম্পর্ক ; আবার হুট করে ভেঙ্গেও গেলো। রুদ্র জড়ালেন শিমুল নামের আরেক মেয়ের সঙ্গে। উথালপাথাল প্রেম। কিন্তু কষ্টের বিষয় হলো শিমুলের পরিবার রাজি হলোনা। সেই থেকে রুদ্র আরো বেশি নিঃসঙ্গ হয়ে যান।
বিচ্ছেদ ঘটার পরেও রুদ্র মেয়েদের ঢালাওভাবে দোষারোপ করতে চাননি, যদিও জীবন সম্পর্কে মেয়েদের ধারণা খুবই সংকীর্ণ বলে তার মনে হয়েছে।
ওখানেও শেষ, মদ তখন তাঁর নিত্য সঙ্গী। আলসার হলো, পায়ের আঙ্গুল পচার দশা প্রায়। ডাক্তার বললেন সিগারেট ছাড়তে হবে নয়তো পা শেষ হয়ে যাবে দৃঢ় চিত্তে বললেন ‘সিগারেট ছাড়া অসম্ভব!’
অথচ তসলিমার সঙ্গে তাঁর ছিলো সবটুকু মিল বিয়ের পর খ্যাপাটে রুদ্র বাবাকে লিখেছিলেন,
“আব্বা,
পথে কোনো অসুবিধা হয়নি। নাসরিনকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে গত পরশু ঢাকায় ফিরেছি। আপনাদের মতামত এবং কোনোরকম আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া আমি বিয়ে করে বৌ বাড়ি নিয়ে যাওয়াতে আপনারা কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু আমি তো আমার জীবন এভাবেই ভেবেছি। আপনার সাথে আমার যে ভুল বোঝাবুঝিগুলো তা কখনই চ্যালেঞ্জ বা পিতা-পুত্রের দ্বন্দ্ব নয়,স্পষ্টতই তা দুটো বিশ্বাসের দ্বন্দ্ব। ব্যক্তি আপনাকে আমি কখনোই ভুল বুঝিনি,আমি জানি না আমাকে আপনারা কিভাবে বোঝেন। এ তো চরম সত্য যে, একটি জেনারেশনের সাথে পরবর্তী জেনারেশনের অমিল এবং দ্বন্দ্ব থাকবেই। যেমন আপনার সাথে আপনার আব্বার অমিল ছিলো, আপনার সাথে আমার এবং পরবর্তীতে আমার সাথে আমার সন্তানদের। এই দ্বন্দ্ব ও সংঘাত কোনোভাবেই রোধ করা সম্ভব নয়। আমরা শুধু এই সংঘাতকে যুক্তিসঙ্গত করতে পারি; পারি কিছুটা মসৃণ করতে। সংঘাত রোধ করতে পারি না। পারলে ভালো হতো কিনা জানি না। তবে মানুষের জীবনের বিকাশ থেমে যেতো পৃথিবীতে।
আমার মনে পড়ে না। এই ছাব্বিশ বছরে একদিনও পিতা হিসাবে আপনার সন্তানদের আদর করে কাছে টেনে নেননি। আশেপাশে অন্য বাবাদের তাদের সন্তানদের জন্য আদর দেখে নিজেকে ভাগ্যহীন মনে হয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে কখনো কষ্ট প্রকাশ করিনি।”
বিক্ষোভ, প্রেম, জাগরণের কবিতায় ভিন্ন মাত্রার অনুভূতি এনে দেয় রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কবিতা। শিহরণ বইয়ে দেয় দেহের শিরায় উপশিরায়। যেন আমরা বাস্তব প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই শব্দের মাঝে। বাক্য এবং শব্দভাণ্ডারের অফুরান ব্যবহার, সঙ্গে তারুণ্যে অবাধ্য উচ্ছ্বাস, কোলাহল উদ্যম যেন বাঁধভাঙ্গা। তাই নিয়েই রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ।
কবিতা ছিলো তাঁর মস্তিষ্কের গহীনে। তিনি রুদ্র ছাড়া আর কেইবা হবেন?
তাইতো তাঁর কবিতাই জানান দেয় তাঁর চিরকালের উপস্থিতির সম্মুখে। মংলায় তাঁর কবরের প্রস্তর ফলকে লেখা
““চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়- বিচ্ছেদ নয়
চলে যাওয়া মানে নয় বন্ধন ছিন্ন-করা আর্দ্র রজনী
চলে গেলে আমারও অধিক কিছু থেকে যাবে আমার না-থাকা জুড়ে।”
রুদ্রর জীবন নিয়ন্ত্রিত ছিল না। শরীরের উপর যথেষ্ট অত্যাচার করতেন। তুখোড় ধূমপান ও মদ্যপান, খাবারে অনিয়ম সব মিলিয়ে বাঁধিয়েছিলেন পাকস্থলীর আলসার। পায়ের আঙুলে হয়েছিল বার্জার্স ডিজিজ। গুরুত্ব তিনি কখনোই দেননি এসবকে। অসুস্থতা নিয়েও তিনি ঢাকায় ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কবিতা পড়তে যেতেন। জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি নিয়মিত আসতেন নীলক্ষেত-বাবুপুরায় কবি অসীম সাহার ‘ইত্যাদি’-তে। এ সময়টায় তিনি অনেক নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। সেই সময়ের কথা বলতে গিয়ে তসলিমা নাসরিন বলেছেন-
“কেউ তাকে সামান্য আশ্রয় দেয়নি। কেবল অসীম সাহা দিয়েছিল, নীলক্ষেতে তার টেবিলের বাঁ-পাশে রুদ্রকে একটা চেয়ার দিয়েছিল বসবার জন্য। রুদ্র সকাল, দুপুর, বিকেল ঐ একটি চেয়ারে নিমগ্ন বসে জীবন পার করতো।”
জাগরনের কবি, তারুণ্যের কবি, প্রতিবাদের কবি, প্রেমের কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’ র প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।
অনুলিখনঃ আরিফুল হক