“আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন
খুঁজি তাঁরে আমি আপনায়”
সেদিন বৃষ্টি ঝরছিল পুরো দেশ জুড়ে, আর হাজার মাইল দূরে নীরবে বিদায় জানিয়েছিলেন বাংলাদেশের এক অকৃত্রিম বন্ধু। তাঁর মহাপ্রয়াণে সমাপ্ত হয়েছিল একটি উজ্জ্বল অধ্যায়। আজ থেকে ঠিক তিন বছর আগে…
একাত্তরে বাঙ্গালীর সহমর্মী, মানব হিতৈষী, সংস্কৃতিসেবী মহান মানুষ ফাদার মারিনো রিগান, ইতালীর ভিসেনজায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০ অক্টোবর ২০১৭ সালের সন্ধ্যায় সার্থক জীবনের সমাপ্তি টানেন।
৯২ বছর বয়সী মানবহিতৈষী, ফাদার মারিনো রিগান ১৯২৫ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারী ইতালীর ভেনিসের কাছে ভিল্লভেরলা গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন, ২০০১ সালে অসুস্থ্যতাজনিত কারণে তাঁর স্বজনেরা ইতালী নিয়ে যাবার আগে প্রায় পাঁচ দশক তিনি এ মাটিতেই রচনা করেছেন ‘মানবসেবা’র এক অতুলনীয় কাব্য।
১৯৭১ সালে ফাদার রিগন তখন বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার বানিয়ারচর গ্রামের ক্যাথলিক মিশনের প্রধান ধর্মযাজক।পাকিস্তানীদের বর্বরতা, হত্যা-লুণ্ঠন, নারী নির্যাতন, আর হানাদারদের অগ্নিসংযোগে পুড়ে যাওয়া গ্রামের পর গ্রাম নিজে পরিদর্শন করে দেখলেন। যুদ্ধপীড়িত ও যুদ্ধাহত মানুষের পাশে এসে দাঁড়ালেন তিনি। চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য ঢেলে সাজালেন ক্ষুদ্র চিকিৎসা কেন্দ্র। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসা দিতে লাগলেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের। শুধু তাই নয়, আহতদের আশ্রয় ও খাদ্য সংস্থানের ব্যবস্থাও করলেন।
ফাদার রিগনের কাছেই চিকিৎসাসেবা পেয়েছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় বৃহত্তম গেরিলা বাহিনীর প্রধান হেমায়েত উদ্দিন। হেমায়েত বাহিনীর প্রধান হেমায়েত উদ্দিন বীরবিক্রম ফাদার রিগন সম্পর্কে বলেছিলেন, “১৯৭১ সালের ১৪ জুলাই পাকিস্তানী সৈন্যদের সঙ্গে এক সম্মুখযুদ্ধে আমার মুখমণ্ডলে গুলিবিদ্ধ হয়। শত্রুর বুলেট আমার মুখের বামপাশ দিয়ে ঢুকে চোয়ালের দাঁতসহ ডান দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। জিহ্বার একটি টুকরাও সেই সঙ্গে উড়ে যায়।
দলের চিকিৎসকদের কাছে প্রাথমিক চিকিৎসা পাওয়ার পর আমি উন্নত চিকিৎসার জন্য চলে যাই ফাদার রিগনের চিকিৎসাকেন্দ্রে। ফাদার নিজে দাঁড়িয়ে থেকে আমার শরীরে অস্ত্রোপচার করান। সে সময় আমার চিকিৎসা করতে গিয়ে ফাদার নিজের জীবনের যে ঝুঁকি নিয়েছিলেন, তার ঋণ কোনোদিন শোধ হওয়ার নয়। ওই সময় ওপরে ছিল ঈশ্বর, নিচে ফাদার রিগন। হয়তো তাঁর সেবা না পেলে বাঁচতেই পারতাম না। শুধু আমার নয়, তিনি অনেক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাকে চিকিৎসাসেবা দিয়েছিলেন।”
কর্মসূত্রে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে অবশেষে স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলেন সুন্দরবনসংলগ্ন মংলার শেলাবুনিয়া গ্রামে। আর দশজন মিশনারির মতো তিনি কেবল ধর্মীয় কর্মের মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি, নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি আর মানবকল্যাণমূলক বহুমাত্রিক কর্মকান্ডে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার কাছে হয়ে উঠেছেন প্রিয় মানুষ।
তাঁর সামগ্রিক জীবনে চিরন্তর মানবতাবাদী দিকটিই স্পষ্ট হয়েছে বারবার। বাংলা শিল্প-সাহিত্য প্রেমে মগ্ন এই মানুষটি কেবল এ দেশের সাহিত্য পাঠ করেননি, সেগুলোর ব্যাপক অংশ ইতালীয় ভাষায় অনুবাদ করে বাংলা সাহিত্যকে করেছেন মহিমান্বিত।
তাঁর হাত দিয়ে ইতালীয়ান ভাষায় অনুদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলীসহ প্রায় ৪০টি কাব্যগ্রন্থ, লালন সাঁইয়ের ৩৫০টি গান, জসীমউদ্দীনের নকশীকাঁথার মাঠ, সুজন বাদিয়ার ঘাট ছাড়াও এ দেশের গুরুত্বপূর্ণ কবিদের অসংখ্য কবিতা।
ফাদার রিগান প্রথম ইতালীয় অনুবাদক, যিনি গীতাঞ্জলী কাব্যগ্রন্থ সরাসরি বাংলা থেকে ইতালীয়ান ভাষায় অনুবাদ করেন। গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৪ সালে। একাধিক সংস্করণ হয়েছে গ্রন্থটির। তাঁর ইতালীর অনুদিত রবীন্দ্রকাব্যের একাধিক গ্রন্থ ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ ও পুর্তগীজ ভাষায়ও অনুদিত হয়। যা থেকে স্পষ্ট হয় তিনি কেবল রবীন্দ্রনাথকে নিজ জাতির কাছে নয়, ইউরোপের অন্য জাতিগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দিতে রয়েছে তাঁর উজ্জ্বল ভূমিকা।
প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসে এই সংস্থা আড়ম্বরপূর্ণভাবে পালন করে রবীন্দ্র উৎসব। রবীন্দ্র কেন্দ্রের আয়োজনে ফাদার রিগান কর্তৃক পরিচালিত শেলাবুনিয়া সেলাই কেন্দ্রের উৎপাদিত নকশিকাঁথার চারটি প্রদর্শনী হয় ইতালীর বিভিন্ন শহরে।
বাংলার ঐতিহ্যময় এই শিল্পকর্মটি ইতালীর শিল্পবোদ্ধাদের মধ্যে প্রশংসা কুড়ায় দারুণভাবে। ফাদার রিগান হলেন রবীন্দ্র অধ্যয়ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার মূল প্রেরণা।
ফাদার রিগানের কর্মপরিধির বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে শিক্ষামূলক কার্যক্রম। তাঁর হাত দিয়েই মংলার স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সেন্ট পলস্ উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৪ সালে।
ফাদার রিআনের প্রত্যক্ষ ভূমিকায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয় ১৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া হাজার হাজার সুবিধাবঞ্চিত ছেলেমেয়ের স্পন্সরশিপের মাধ্যমে পড়াশুনা করার সুযোগ করে দেন তিনি।
ফাদার রিগান কেবল বাংলা সাহিত্য নয়, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক দলের নেতৃত্ব দিয়ে এ দেশের সংস্কৃতিকে ইতালীর মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন বহুবার। তাঁর নেতৃত্বে যাওয়া নকশীকাঁথার মাঠ অবলম্বনে নৃত্যনাট্যের দল ইতালীর সুধীজনের নজর কাড়ে। ১৯৮৬ সালে ফাদার রিগানের সহযোগিতায় আন্তর্জাতিক সংগীত প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় বাংলাদেশি শিশুশিল্পী অরিন হক। রবীন্দ্রনাথ রচিত ‘আমরা সবাই রাজা’ গান গেয়ে অরিন অর্জন করে প্রথম হওয়ার গৌরব, যা ছিল বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের একটি গৌরবময় ঘটনা। ফাদার রিগান ছিলেন সে ঘটনার নেপথ্যের নীরব মানুষ।
২০০১ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হলে তার পরিবারের সদস্যরা তাকে ইতালী নিয়ে গিয়েছিলেন। সে সময় তিনি, স্বজনদের শর্ত দিয়েছিলেন যে, ইতালীতে যদি মৃত্যু হয় তাহলে তাঁর দেহ বাংলাদেশে পাঠাতে হবে। স্বজনেরা মেনে নিয়েছিলেন এ শর্ত। এরপর তিনি উন্নত চিকিৎসায় ইতালী যান। সেখানেও অস্ত্রোপচারের আগে স্বজনদের কাছে তার শেষ মিনতি ছিল, ‘আমার মৃত্যু হলে লাশটি বাংলাদেশে পাঠাবে,”
আমাদের আপনতম মানুষ ফাদার মারিনো রিগান মিশে গেছেন পরমের সাথে। তাঁর অবদান থেকে যাবে, আমরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ভোগ করবো তাঁর স্থাপিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু, স্বজন, ফাদার মারিনো রিগনের শেষ ইচ্ছে পূরণে এগিয়ে এসেছিল রাষ্ট্র। তাঁর শেষ ইচ্ছে অনুসারে বাংলাদেশের মাটিতে ফাদার রিগনকে বাগেরহাটের মোংলা উপজেলার শেলাবুনিয়া চার্চের পাশেই চিরশায়িত করা যোগ্যতম সম্মানের সাথে সমাধিস্থ করা হয়েছিল তাঁকে, মৃত্যুর ঠিক এক বছরের মাথায় ২০১৮ সালে।
ফাদার মারিনো, আপনাকে আমরা ভুলে যাবনা। আপনার দেখানো পথ ও মানবতার উদাহরণ আমাদের পাথেয় হয়ে থাকবে। পরম করুনাময় নিশ্চয়ই চিরশান্তির স্থানে সম্মানের সাথে রেখেছেন আপনাকে।
ভালো থাকবেন ফাদার……।
– আরিফুল হক, রোম, ইতালী
ইতালী প্রতিনিধি, সোজা কথা ডটকম